শিল্প ও সাহিত্য

সরল অঙ্ক

‘খুন আমি করেছি। তা-ও একটি নয়, একাধিক। এতদিন দেখলাম আদালতের সীমাবদ্ধতা। প্রকৃত অপরাধী সনাক্ত করতে কতটুকু সক্ষম কিংবা অক্ষম। কিন্তু পারেননি। পারেনি এই আদালতও। আমার উপলব্ধির দরজা স্পষ্ট হলো- আদালত প্রকৃত অপরাধীর চক্ষু ছায়ায় দৃষ্টি রাখতে ব্যর্থ। যতক্ষণ পর্যন্ত আসামি সত্য স্বীকারোক্তিমূলক জবান না দেয়। প্রকৃত সত্য আরেকটি হলো— সবাই সত্য জবান দেবে না, বেঁচে থাকার সুতীব্র বাসনা থেকে বলছি। আদালতের কাজ দুইয়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে ভিন্ন রাস্তার সন্ধান বের করা। অর্থাৎ অসত্যের সামনে সত্যকে দাঁড় করানো। সত্য তথ্যের পেছনে দৌড়ে সত্য বের করার মানসিকতা সিকি আনাও নেই এই আদালতের। খুনী সুযোগ পায় বেঁচে থাকার। চায় স্ত্রী-পরিজনের সঙ্গে আরো কিছু দিন ভালোভাবে বাঁচতে। ঘুরতে ও ঘুমাতে। মহামান্য আদালত, অপরাধ মার্জনা হোক। তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখানে ন্যায় নেই। ন্যায়ের পেছনে কেউ ছোটেও না। সেই সুযোগে ব্যর্থরা নিরাপরাধীকে অপরাধী আর অপরাধীকে নিরাপরাধী ঘোষণা ছাড়া খতিয়ান খাতা একেবারেই শূন্য। আমি এতটাই অপরাধ করেছি— আদালত একাধিক বার ফাঁসির রায় কার্যকর করলেও উপযুক্ত সাজা হবে না!’

আজগরের মুখ থেকে সরাসরি এমন কথা শুনে জজ অবাক হয়! কথাগুলো শরীরে তীরের ফলার মতো বিঁধছে। অবাক হয় পক্ষ-বিপক্ষের আইনজীবিরাও! বেশি অবাক আজগর শেঠের স্ত্রী-স্বজনরা। স্ত্রী ভাবছে, এসব কি বলছে! আবার উন্মাদ হয়ে যায়নি তো! ছেলেমেয়েরা বাবার মুখের দিকে তাকানো ছাড়া কোনো কথাই বলতে পারছে না। উকিল ভাবছে, এতক্ষণ খাঁচা থেকে বের হয়ে পাখিটা আকাশে ওড়ার কথা, চক্কর মারার কথা। অথচ তা না করে আজব কথা বলছে আজগর! স্ত্রী আজগরের সততা সর্ম্পকে ভালো করে জানে। আবার এই মুহূর্তের কথাগুলো যে কোনোভাবেই সত্য না- সেটাও জানে। এখানে সত্য কিংবা মিথ্যার চেয়েও বড়ো অন্য কোনো ইস্যু থাকতে পারে। কখনও কখনও চোখ যা দেখে তা সত্য নয়। অথবা যে কোনো কিছুই হতে পারে। অন্যদের মতোই আজগরের উপর স্ত্রী আয়েশা বিরক্ত। মাঝ পথে এসে স্ক্রিপ্ট এলোমেলো করে দিলো। এতদিনের শ্রম তাহলে বৃথা যাবে! যদি এমনটাই আজগরের পরিকল্পনা হয় তাহলে আগে বললেই পারত।

উপস্থিত মানুষগুলোও আছে বিভ্রান্তিতে। কার কথায় বিশ্বাস রাখবে। উকিলের যুক্তি তর্কে? জজের রায়ে? নাকি আজগরের কথায়! এবার কিছুটা অবিশ্বাসস তৈরি হয়েছে উপস্থিত মানুষের মনে। আজগর এই খেলাটাই খেলতে চেয়েছে। প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষ কিংবা নির্দোষ কিছুতেই বলা যাবে না।  কেউ সোচ্চার কণ্ঠে আওয়াজ তুলে বলছে, আজগর মাস্টার ঠিক আছে। আবার কেউ কেউ বলছে, আজগর মাস্টার এমনটা কিছুতেই করতে পারেন না। আজগর মাস্টার পরিবারের উপর প্রতিশোধ নিয়েছে। পরিবার নিশ্চয়ই তাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়ে ছেড়েছে। এক দুইজন চিৎকার করে বলছে, আজগর মাস্টার, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা আপনিই বলুন। না হয়, আদালতে দ্বিধাবিভক্তির জন্ম নেবে। সমাজে ফাটল ধরবে। জজের বিবেক ঘরে সন্দেহ দানা বাঁধলে পরবর্তী যে কোনো রায়ে প্ররোচিত হবেন, উকিলদের আত্মবিশ্বাস তলানীতে ঠেকবে। আদালতের প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি হবে।

একজন উকিল বলছে, আজগর মাস্টার মানসিকভাবে অসুস্থ। সুচিকিৎসা দরকার। একজন সন্ত্রাসী দাঁড়িয়ে বলছে, তাকে পাবনা পাগলা গারদে পাঠানো হোক। সাত খুনের আসামি বলছে, শালা একটা ধোঁকাবাজ, মৃত্যুদণ্ড তার ন্যায় শাস্তি। এটা কার্যকর করা হোক। একজন প্রেমিক বলছে, সে নয়া বিপ্লবের জন্ম দিতে চায়। পুরাতন পাগলের ভাত নাই।  কমিশনার দম্ভোক্তি ছেড়ে বলল, ফাঁসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে আদালতের দিকে ইঙ্গিত করা আঙুল ধ্বসিয়ে দেয়া হোক।

স্ত্রী আয়েশা বলল, না না, আমার স্বামীর কষ্ট হবে। আপনারা এমন নির্দয় হতে পারেন না। আজগর একদম নিষ্পাপ ফুল। ফুলের সুবাস ছড়িয়ে যায় একজন সত্য দেবতা। দেবতাদের মৃত্যু হয় না। তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আমি আমার সব সত্য-শক্তি দিয়েই তাকে বাঁচিয়ে রাখব। সহমত পোষণকারীরা মাথা নাড়িয়ে সব কথায় যেমন সম্মতি জানায়। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। এমন অন্যায় কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আজগর মানসিকভাবে অসুস্থ। তার চিকিৎসা হওয়া দরকার।

জজ সাহেব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কলম হাতে সেদিনের আদালত মুলতবি ঘোষণা করেন। একে একে সবাই চলে যাচ্ছে। আজগরকেও নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু এই আজগর আদালতের কাছে অনেকগুলো প্রশ্ন রেখে যায়। যা জজ সাহেবের ভেতরে তুমুল ঝড় তোলে। প্রচন্ড বাতাসের বেগে উড়ে যাচ্ছে সীমাবদ্ধ চিন্তার ঘর। কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। দেখা গেল, ধ্বংসের মাঝে কিছুদিন পর একটি সজীব গাছ জন্ম নেয়। গাছটি ধীরে ধীরে বড়ো হয়, পাতা গজায়। ফুল ও ফল হয়। পাখিরা উড়ে এসে বসে। নতুনের আহ্বান এইখানে মঞ্জুরিত হয়। বরং এই পৃথিবী আরো বেশি সুন্দর। মন মাতানো। মন ভোলানো। জজ আজগরের হেঁটে যাওয়া পথের দিকে আরেক বার চোখ রাখেন। সেখানে একটা সত্য মিথ্যার প্রলেপ উস্কানি দেয়। তারপরও জজ সাহেব নির্বিক।

০২

আজগর শেঠের উকিল ছয় কদম সামনে এসে দাঁড়ায়। মহামান্য জজ সাহেব, আমার মক্কেলের কথায় একদম কর্ণপাত করবেন না। উড়ন্ত পাখি খাঁচায় বন্দি হলে মানসিক দ্বিধায় স্বাভাবিকভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। দ্বিস্তর মগজের কোনোটাই সঠিক সিদ্ধান্তে থাকে না। ভালো হাসপাতালে নিয়ে সু-চিকিৎসা দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই মহামান্য আদালতের পূর্বের রায় বলবৎ রাখার আর্জি করছি।

উকিলের কথা থামিয়ে আজগর স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়— মাননীয় বিজ্ঞ আদালত, আমি কোনোভাবেই অসুস্থ না। সুস্থ্য ও সচেতন মস্তিষ্কে বলছি— মিথ্যার আশ্রয়ে লাভ করা জীবন আমি কিছুতেই বহন করতে চাইছি না। তারপরও আমাকে মিথ্যা প্রমাণিত করবেন! এমনটা ভেবে থাকলে আপনারা বোকা। স্কুলের সামান্য একজন শিক্ষক আমি। আপনাদের সন্তনরা আমার ছাত্র। তাদের মানুষ করার দায়িত্ব আমার উপর। ছাত্ররা এ সমাজের মানুষ। প্যারালাল আমি এ সমাজেরও শিক্ষক। মানুষ গড়ার কারিগর কখনই মিথ্যা বলতে পারে না। আপনারা আমাকে উক্ত আদালতের মাধ্যমে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন না। কর্তার ইচ্ছায় দোষ স্বীকার করছি না। আত্মদ্বন্দ্ব থেকে যে দায় তৈরি হয়েছে সেটার উপনাম কর্তব্য। কর্তব্যের ইচ্ছায় স্বীকার করছি আমি খুনী। আমি অপরাধী।

জজ সাহেব ধীরে ধীরে এক কদম দুই কদম করে আজগর শেঠের কাছে এসে দাঁড়ালেন। হাতের উপর হাত রেখে, বিনা সংকোচে, বুকে হিম্মতের পর্বত রেখে সত্য উন্মোচনের অনুরোধ করছি। আমি এমন কঠিন সত্যের সামনে এক জীবনে এমনভাবে আর কখনও পড়িনি। নতজানু হয়ে সত্যটা জানতে চাই কেবল। জানতে চাই পেছনেরও পেছনের গল্প। কথা দিচ্ছি, আমি সত্য ও ন্যায় বিচারে কোনোভাবেই প্ররোচিত হবো না।

আজগর শেঠ আড়চোখে চারবার স্ত্রীর দিকে তাকায়। সরাসরি দুইবার ছেলেমেয়ের দিকে। উপস্থিত জনতার দিকেও একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। বললেন, জজ সাহেব, এখানে কোনো অপরাধী আছে কি? থাকলেও সে কে? কী তার নাম? কী তার পরিচয়? আর তার অপরাধটাই কী? আপনার পক্ষে বলা সম্ভব? আজগর কথাগুলো শেষ করে একগাল মুচকি হেসে স্ত্রীর দিকে পুনরায় ফিরে তাকায়। স্ত্রীর পেটের ভেতরে মোচড় খায়। আজগর কী বলে ফেলে মাবুদ জানে! দীর্ঘ বছরের চেনা আজগরকে আজ বড়ো অচেনা লাগছে। কোনোভাবেই আজকের আজগরের সঙ্গে পূর্বের আজগরের মিল নেই!

জজ সাহেব আজগরের কোনো কথার জবাব দিতে না পেরে কেবল বললেন, আদালত বিনা দ্বিধায় অপরাধের মুখোশ খুলতে পারে। আপনার সেই স্বাধীনতা আছে। অপরাধী আমি হলেও বলতে দ্বিধা করবেন না।

আজগর মুচকি হাসলেন। একটা নির্বোধ আদালতকে সত্য বলবো কেনো? অপরাধী কিংবা সাক্ষীর কাছ থেকে সত্য-মিথ্যা যেখানে বিচার হয় সেটা বিচারালয় নয়। এখানে চেয়ার আছে, টেবিল আছে। মুখস্ত সংবিধান শোনার কিছু লোকও আছে। যাদের রাষ্ট্রের টাকায় রাখা হয়। ঠিক বলেছি, জজ সাহেব?

আদালত সত্য ও মিথ্যার চোখে আঙুল দিয়ে সত্যকে মুক্তি দেয়, মিথ্যাকে দেয় উপযুক্ত শাস্তি। এখানে সত্যের কেবল জয় হয়। জজ সাহেব, এতটুকু মুখ দিয়ে বলা আর কলম দিয়ে কাগজে লিখা মাত্রই একটা সীমানা টানা হয়। তারপরও আপনাকে বলছি, আমি কেনো অপরাধী। কেনো আমার সাজা সময়ের একান্ত দাবি। কেনো আদালত আমাকে স্পর্ধায় ঢাকতে পারেনি। কেনো আপনারা আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে দ্বিধায় দুলছেন হ্যাঁ না, হ্যাঁ না করছেন। কারণ একটাই, আপনাদের কোনো অনুসন্ধান নেই। পর্যবেক্ষণ নেই। আছে কেবল পর্যালোচনার চোয়াল।

আজগর শেঠ, অন্য কথা নয়, আমরা সত্য শুনতে উন্মুখ হয়ে আছি। আদালত যখন সত্য বের করতে পারছে না, তখন আমাকেই সত্য বলতে হবে। সমাজের আট-দশজনের মতোই আমি নিরীহ মানুষ। তিন সন্তানের জনক। পেশায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। অফিসিয়াল কাজে প্রায়ই থানা ও জেলা শিক্ষা অফিসে যেতে হতো। পঞ্চম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষার জরুরি কাজে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেতে হবে। ব্যক্তিগত কাজে যেতে হবে লাকসাম। ভাবলাম, প্রতিবার লঞ্চ যোগে ঢাকায় গেলেও এবার ট্রেনে যাব। চাঁদপুর থেকে ট্রেনে লাকসাম স্টেশন নামব। কাজ সেরে আবার চট্টগ্রামের ট্রেনে ঢাকামুখী হবো। ব্যস। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তড়িঘড়ি ট্রেনের পেছনের কামরায় উঠেও বসি। ঠিক সময়ে ট্রেন ধরতে পেরে মুখে তৃপ্তির হাসি তখন। ঝলসানো চাঁদকে পুরপূর্ণই মনে হতে লাগল। কয়েকদিনের পরিশ্রমের শরীর। সিট পেয়ে খুবই স্বস্তি বোধ করলাম। কিছুক্ষণ পর একই কামরায় হাস্যমুখে একজন যাত্রী ওঠে। হাতে একটি ব্যাগ। ব্যাগটি দুজনের ঠিক সামনে রেখেই পাশের সিটে বসেন ওই যাত্রী। পাশাপাশি সিট হওয়ায় তার সঙ্গে কথাও হয়। যাব কোথায় জানতে চায়। ঢাকায় যাব শুনে সে খুশিতে আটখান। বলল, গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।

বললাম, ঠিক বলেছেন।  আমাকে বলল, চাইলে লঞ্চেও যেতে পারতেন? লঞ্চের যাতায়াতটা আমার বেশি হয়। ভালোও লাগে। বলতে পারেন শখে ট্রেনে যাচ্ছি। নদীর দুই পাশের দৃশ্যগুলো বহুদিনের পরিচিত। অনেকটা পুরাতন প্রেমিকার মতোই। স্বাদ পালটাতে ট্রেনে চড়ছি। এই জার্নিও আনন্দটা নিতে চাই। ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পর ছাড়বে। হাতে কিছু সময় আছে। চাইলে ঘুরে আসতে পারি আমরা। যাবেন নাকি? চা খেয়ে একটু এদিক-সেদিক দেখেও আসি। আমি খুবই ক্লান্ত। বসে বিশ্রাম নিতে চাইছি। বরং আপনি ঘুরে আসুন। সহযাত্রী যে মন খারাপ করল, সেটা বুঝতে বাকি রইল না। আবারও অনুরোধ করে বলল, কথা দিচ্ছি ভালো লাগবে। আবারও বললাম, আমি খুবই ক্লান্ত। এবার প্রসঙ্গ পালটে বলল, এই কামরায় করেই লাকসাম পর্যন্ত যাবেন? নিশ্চয়ই। লোকজন কম, একটু ভালোভাবে যাওয়া যাবে।  মানুষের সঙ্গ ছাড়া বেশিক্ষণ ভালো লাগে না, চলুন সামনের কামরায় গিয়ে বসি। আসলে আমি এখানেই স্বস্তি পাচ্ছি। আপনি না হয় সামনে গিয়ে বসুন। ঠিক আছে, আগে চা খেয়ে আসি।  আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।

ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। অথচ সে আসছে না। আমি বারবার বাইরে তাকিয়ে শত শত মানুষের ভিড়ে খোঁজার চেষ্টা করেও ছায়া পর্যন্ত পেলাম না। চোখে মুখে একরাশ উদ্বিগ্নতা নিয়ে আবারও তাকাই। আবারও তাকাই। আবারও তাকাই। কই সেই লোক! কিছুতেই দেখা মিলে না। কোথাও দেখছি না। দরজার সামনে এসে খোঁজ করছি, নাহ্ নেই। ট্রেন চলতে শুরু করল। ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। একটা সময় চাঁদপুর স্টেশন ছেড়ে সামনের দিকে চলে আসে। তখনও আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু দেখা মিলছে না। খুঁজছি সামান্য কাছে বা দূরে। যতটুকু চোখ যায়। দেখলে ইশারা দিয়ে ব্যাগটি ফেলে যাব। কিন্তু তার কোনো পাত্তাই নেই। সেইদিন আবার বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কার মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ। মুশফিকুর রহিম আর আশরাফুলের জুটি তখনও ক্রিজে ব্যাটিং করছে। দুজনই ডাবল সেঞ্চুরির কাছাকাছি। মারমার ব্যাটিং চলছে। শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে দিতে চাইছে দুই টাইগার। সিংহ আর টাইগারের লড়াই বেশ উপভোগ্য। ডরভয়হীন ব্যাটিং করে আশরাফুল ১৯০ রানে আউট হলেও মুশফিকুর রহিম পেয়ে যায় অনবদ্য ডবল সেঞ্চুরি। লোকটি ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ হয়ে হয়ত টেস্ট ম্যাচটিই উপভোগ করছে!

একটা সময় স্টেশন থেকে ট্রেনের দূরত্ব বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক নিয়মেই কিছুটা চিন্তিত হই। এটা ব্যাগ নাকি ইতিহাস। নাকি স্বজনের জন্য বানানো খাবার। হয়ত সন্তানের জন্যে কেনা নতুন জামা। স্ত্রীর শাড়ি। অথবা অতি যত্নে রাখা প্রেমিকার রুমাল। ঢাকায় গিয়ে দেখা করবে ছোটো ভাই, ছেলে অথবা মেয়ের সঙ্গে। অথবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে। ব্যাগটিতে থাকতে পারে বাহারি পিঠা। মাছ। মাংস। শাক সবজি। অথবা জীবনের সব সঞ্চয়। কিন্তু, তাকে দেখে তেমন কিছু মনে হয়নি। জীবনের সব সঞ্চয় এই ব্যাগে রাখার মতো লোক হয়ত তিনি হবেন না। এভাবে মনে কিছুটা ভয়, কিছুটা উদ্বেগ জন্ম নিল। আবার সন্দেহও হলো। তা সত্ত্বেও ব্যাগটি নিরাপদ দূরে সরিয়ে রাখি।

০৩

হাজীগঞ্জ বটতলে ট্রেনের যাত্রা বিরতি। এখানে কিছু যাত্রী নামে। আবার কিছু যাত্রী ওঠে। এই যাত্রা বিরতিটা এক-দুই মিনিটের। কোনোভাবেই পাঁচ মিনিটের বেশি না। তাও পার হয়েছে অনেক আগে। অথচ ট্রেন ছাড়ার কোনো নাম গন্ধ নেই। একজন বলল ট্রেনে পুলিশ তল্লাশি করছে। অপরাধী খুঁজছে। পুলিশের কথা শুনলেই কেনো জানি বিরক্তি বাড়ে। বিরক্তি কাটানোর জন্যে ভাবছি চাঁদপুরে ফেলে আসা যাত্রীর কথা। বুঝতে পারছি না ব্যাগটি কী করব। একবার ভাবি, পুলিশ যেহেতু তল্লাশি করছে এখানে এলে ব্যাগটি দিয়ে দেব। না হয় এই ব্যাগ কী করব? নিয়ে যাব? নাকি রেখে যাব? এই ব্যাগ আমাকে মানসিকভাবে পীড়া দিতে শুরু করল। ব্যাগটি ফেলে দেব। না ফেললে শান্তিও লাগছে না। ভাবনার ভেতরে মানুষটাকে বহন করে চলছি। নিজেকে ভারমুক্ত করা দরকার। না হয় কোনো কাজে মনোযোগী হওয়া যাবে না।

পুলিশ ট্রেন আটকিয়ে অপরাধী খুঁজছে! আচ্ছা অপরাধী ট্রেনে যাবে! অপরাধী কখনই এত বোকা না! তারা কালো গ্লাসের গাড়িতে ভিআইপি বেশে পালায়। শুনেছি আমাদের পাশের বাড়ির টোকাই মিজান মানুষ খুন করে। খুন করাটা তার নেশা। এই কাজ খুব সহজে করতে পারত সে। শুনেছি আমেরিকায় অর্থনৈতিকভাবে ফ্রিডম কিছু মানুষ আছে হাসতে হাসতে অন্যকে রাস্তায় খুন করে। খুনের সেই দৃশ্য আবার দাঁড়িয়ে দেখে। উপভোগ করে। মিজান অনেকটা সেরকমই ছিল। একবার নিজের ভুরি নিজেই কেটেছিল। কারো সহযোগিতা ছাড়াই সেলাইও করেছিল। এমন ঘটনার কথা শুনে কেউ কেউ অবাক হয়েছিল! তারা যে অবাক হয়েছে সেটা শুনে মিজানও অবাক হয়েছিল! দুজন পুলিশ আমার কামরায় প্রবেশ করে। সামনে এসে দাঁড়ায়। রক্ত চোখের সব উদ্বিগ্নতা নিয়ে নানান প্রশ্ন করে। একজনের নজর যায় পাশে থাকা ব্যাগটির উপরG

জানতে চায় ব্যাগ কী রাখা আছে। ব্যাগের বিস্তারিত ঘটনা বললাম। তারা আবারও জানতে চায়, ব্যাগে কী রাখা আছে? বললাম, ব্যাগ আমার হলে জানতে পারতাম। যেহেতু আমার না, কী রাখা আছে তা-ও জানি না।  পুলিশ ব্যাগটি কাছে টেনে খোলার নির্দেশ দেয়। কিছুটা স্বপ্রণোদিত হয়ে খুলতে শুরু করলাম। সবাই কৌতূহলে তাকিয়ে আছে। ব্যাগের ভেতর কি রাখা দেখবে। ভেতরে ভেতরে আমারও কৌতূহল হচ্ছিল তখন। কিন্তু ব্যাগের মুখ খোলার পর সব কৌতূহল মাটি হয়ে যায়। আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছিল। চোখে কিছুই দেখতে পারছিলাম না। পৃথিবী সব পাহাড় আমার মাথার উপর বোঝা হয়ে ভর করল। সমুদ্র আমাকে একবার ভাসিয়ে একবার তলিয়ে দিচ্ছে গভীর থেকে আরো গভীরে। বেদনার মর্মমূল ব্যথিত করে ছাড়ল। নিজেকে অবিশ্বাস হতে লাগল। নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকলাম। আমি এত বড়ো ভুল করি কি করে! কেনো আমি একা আরামে থাকতে গেলাম। কেনো আমি মানুষের কাছে গেলাম না! কেনো আমি বুঝলাম না মানুষ ছাড়া মানুষের বিপদ থেকে বাঁচা যায় না। কেনো আমি এক ধোঁকাবাজকে বুঝতে পারলাম না! ব্যাগটি মানুষের কাটা মুণ্ডু দেখে ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে। কয়েক হাত পেছনে যাই। পুলিশও ভয় পায়। ভয়ে একে অন্যের চেহারার দিকে তাকায়। হয়ত নিজেরাই কিছুটা সরল সান্ত্বনার ভাষা খোঁজে।

এটা কীভাবে সম্ভব! মুহূর্তের মধ্যেই পুলিশ স্বাভাবিক হয়ে বলতে লাগল, ব্যাগ কার? আমি আবারও একই কথা বলি। কিন্তু পুলিশ কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস রাখতে পারল না। যতই বলি ব্যাগ অপরিচিত ওই লোকের। চা-সিগারেট খেতে গিয়ে ট্রেন ফেল করেছে। ততই তারা আমাকে গালি দিতে থাকে। আমাকে হাত কড়া পরানো হয়। থানায় আমার নামে মামলা দায়ের করে, কোর্টে চালান দেয় পুলিশ। তারা ভেবেছে আমি মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল। সেই সঙ্গে ভেবেছে— এত সহজে আমার মতো ক্রিমিনাল ধরা পড়ি কিভাবে!

আমার কথায় কারো বিশ্বাস ছিল না। বিশ্বাস থাকার কথাও না। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা দিশেহারার মতো ছিলাম। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে ভাষাহীন হলেও সজ্ঞাহীন হলাম না। চুপচাপ দীর্ঘদিন। নিজেকে কোনোভাবেই বুঝাতে পারলাম না। জোয়ার ভাটার মতো ভাসছি আর ডুবছি প্রবাহমান সমুদ্রে। খুন না করেও খুনী! এটা কারো কারো কাছে পরমানন্দ। অথচ আমি ভাবছি এটা আমার দায়। আমার অজ্ঞতার সাজা।

আদালতে সরকার পক্ষের উকিল বরাবরই আমাকে দোষী সাব্যস্তর আপ্রাণ চেষ্টা করে। অবস্থা দেখে এমনটা মনে হয়েছে—দোষী বানাতে না পারলে রাষ্ট্রের সব কাজ বৃথা যাবে। সেখানে বাঁধা দেয়াটা কখনই বৈধ হবে না। তাতে পালটে যাবে আইনের ব্যাকরণ। উলটে যাবে সমাজের গতি। নিচে নামবে আইনের ধারা। মিছিল নামাবে রাষ্ট্রের বিশিষ্ট সমাজসেবকরা। উত্তেজিত হবে সকল সাধারণ মানুষ— কার্ফু ডাকবে পুলিশ ও প্রশাসন। সরকার দিবে হুশিয়ার। এমন মুরগি লড়াই দেখে মুচকি হেসে নিজেকে আড়ালের চেষ্টা করেছি তখন। কখনও কখনও মনের গোপন ঘরে মিটিমিটি প্রদীপ জ্বলা আলোতে বসে ভাবছি সন্তানদের কথা। আমার পরিবারকে নিয়ে এলাকার মানুষ কি কি কুৎসিত অপবাদ দিতে পারে সেসবও। আদালতের গোল কাঠঘরে বার কয়েক দাঁড়াতে হয়েছে। কেউ অনুসন্ধান করেনি ব্যাগের উৎস। জানতে চায়নি খুনী কে? খুনই বা হয়েছে কে? রাষ্ট্র সেই চেষ্টা থেকে আড়ালে সরে খুনী বানানোর চেষ্টা করছে! যখন স্বয়ং রাষ্ট্র কারো বিরুদ্ধে তখন সব চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। কিছুই করার থাকে না। যেমন আমার ছিল না।

০৪

প্রথমবার জেলখানায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল অন্যরকম। সেখানে গিয়ে অতীতকে খুবই কাছ থেকে দেখা গেছে। মনে পড়ে পোষা টিয়াপাখির কথা। যে প্রতিনিয়ত ওড়ার জন্য ছটফট করেছে। খাচায় বন্দি থাকার কারণে উড়তে পারেনি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জীবন উলটে-পালটে খাচাবন্দি হয়ে গেলাম! অন্য কয়েদিরা আগ বাড়িয়ে আসে। কথা বলে— জানতে চায়— জেলে আসার কারণ। কী বলব, বুঝতে পারছি না। অনেকটা চুপচাপ নির্বাসনের মতো থেকেছি। চাঁদ গ্রাস করেছে সূর্যের আলো। আলোর অভাবে ধুকছে পৃথিবী। সব কিছু রঙহীন অন্ধকার। স্বাদহীন। ঘ্রাণহীন। ভাবনায় তাড়া দেয় স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা। কী জবাব দেব তাদের। যারা আমার ফেরার পথে তাকিয়ে অপেক্ষার মালা বানিয়ে বসে আছে। দুদিনের মধ্যে ফিরব বলে। দুদিন গত হয়। তিন দিন গত হয়। গত হয় সপ্তাহ মাস। অপেক্ষার সলতে আগুন জ্বালিয়ে অপেক্ষা। সেই অপেক্ষার তেল ফুরিয়ে আসে। অন্ধকার নেমে আসে আমার মতো তাদের জীবনে। তবুও বাড়িতে খবর পাঠাইনি।

ছোটো ছেলেটা বড়ো বেশি অভিমানী ছিল। আদর করে না খাওয়ালে খাবে না। ভাবছি, এখন সে কার সঙ্গে অভিমান করছে? নাকি করছে না। তাও জানি না। অন্য ছেলেমেয়েরাও নিশ্চয়ই আমাকে মিস করছে। এই মিস করাটা বেশি দিন থাকবে না, মানুষ এক সময় জীবনের প্রয়োজনে অনেক কিছু ভুলে য়ায়। নাকি মেনে নেয়? আদালত আমাকে খুনী প্রমাণ করলে পত্রিকায় আমার ছবি ছাপানো হয়। বাতাস সে খবর টেনে নিয়ে যায় আমার প্রান্তিক এলাকায়। সবাই জেনে যায় আমি একজন খুনী। স্বাভাবিকভাবেই স্ত্রী-সন্তানরা উদ্বিগ্ন হয়! উন্মাদের মতো ছুটে আসে আমার সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে। সত্যটা জানতে। স্ত্রী অনেকের দ্বারে হাত পাতে। স্বামীকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। কিন্তু পারেনি। পারবে না। কারণ, মহামান্য আদালত আমাকে দোষী প্রমাণের নিয়ত করেছিল। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়! অথচ সেই আপনারাই আজ আমাকে বেকসুর খালাস দিতে চাইছেন। এই খালাস দিয়ে আমি কী করব? এতদিনে আমার তিন বছরের ছেলে আঠারো অতিক্রম করে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। মেয়েরা বিয়ে করে স্বামীর সংসার শুরু করেছে। সন্তানের মা হয়েছে। তাদের কণ্ঠে বাবা শব্দটি আর নেই। অনভ্যস্ত মানুষের অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা দেখলে আমিও মানসিকভাবে কষ্ট পাব, যন্ত্রণা পাব। মেনে নিতে পারব না। স্ত্রীর যৌবনে ভাটা পড়েছে। বহুকাল তার ঠোঁটে চুমু না পড়তে পড়তে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। দুজন দুজনকে কাছে পেতে হৃদয়ের ভেতর যে তীব্র হাহাকার ছিল এতদিন পর তা আর নেই। ভাঁজ পড়েছে চামড়ায়। চুলগুলো শুকিয়ে বিলের দক্ষিণের কাঁশবনকে হার মানিয়েছে। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এসেছে। বাহুতে বল নেই। অন্যের সহযোগিতা ছাড়া দাঁড়াতেও পারছি না এখন। অভাব অনটনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করেছে আমার পরিবার। হিসেব করে দেখলাম— সংসার নামক পৃথিবীতে আমার আবেদন বহু আগেই ফুরিয়েছে। এই জেলাখানায় নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছি। সেখানে কিছু গাছ লাগিয়েছি। সেসবের পরিচর্যা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি।

জজ সাহেব, আমার বেকসুর খালাসের কথা শুনে সামনের লোকজন হাততালি দিচ্ছে। একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করছে। খুশির যেন অন্ত নেই। জীবনের শেষ বয়সে তাদের খুশি রক্ষা করার ইচ্ছেও আমার নেই। দুঃখিত, তাদেরকে আমি শারীরিকভাবে কিছু দিতে পারব না। এমনকি মানসিকভাবেও আমি এখন নিঃস্ব। সেই সঙ্গে এটাও সত্য, আমি একজন খুনী। খুনীর বিচার হওয়া উচিত। না হয়, পৃথিবীতে সত্য প্রতিষ্ঠা হবে না।

০৫

আজগর সাহেবের লুকিয়ে রাখা সত্য শুনতে অনেক মানুষের অপেক্ষা বাড়ছে। অপেক্ষা করছে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে। যে সত্য তারা পূর্বে কখনই শোনে না। সেই অপ্রিয় সত্য শুনবে আজ। সবার অপেক্ষা বাড়ছে। অপেক্ষার চারা গাছ বড়ো হচ্ছে। ডাল-পালাও গজাচ্ছে।

একবার সুন্দরী মুক্তা চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমে হাবুডুবু খাই। তখন দুজন দুজনকে ছাড়া ভিন্ন কিছুই ভাবতে চাইতাম না। ভাবতাম একমাত্র আমরাই সত্য। চারপাশে সব কিছু মিথ্যে ও মৃত। হৃদয়ের গহীন টানে বাঁধাহীন ছুটে যেতাম একে অন্যের কাছে। এভাবেই চলছিল আমাদের উদ্যাম দিন পঞ্জিকা। দুজন দুজনকে আরো কাছে পেতে, বিয়ের সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলি আমরা। এমনটা শোনার পর পর সমাজ ধর্মকে পুঁজি করে প্রবল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সামনাসামনি আমি আর আমার ধর্ম। সামনাসামনি আমি আর আমার মা। সামনাসামনি আমি আর আমার বাবা। মুক্তার সামনেও তার মা। ঠাকুর বাবা। আবার ঠাকুর বাবার সামনে ধর্মের করাত কল। মুক্তার বাবা মরতে রাজি, মচকাতে রাজি না। কিছুতেই মেয়েকে মুসলমান ছেলের হাতে ছাড়তে রাজি না। এতে ধর্মের মান যাবে। ধর্মের কাছে বলি হলো আমাদের প্রেম। আমাদের ভালোবাসা। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি তখন। প্রেম সিদ্ধান্তহীনতায় ঝুললেও ধর্মকে বগলে রেখে শারীরিক মিলনে পরিতৃপ্ত আমরা। মুক্তার গর্ভে আসে আমার রক্ত, আমার রন্ধ্র। কিন্তু এই অবৈধ সম্পর্ক ও সন্তানের কথা শুনলে ধর্মের গায়ে দ্বিগুণ কালি লাগবে। আমাদের দূরত্ব বাড়তে লাগল। ভাবছি, এবার মেনে না নিয়ে উপায় নেই। যখন আমার ফোটা ফোটা জল মুক্তার গর্ভে রূপান্তরিত মুক্ত মানুষ হচ্ছে। সে পৃথিবীতে আসবে একটি সন্ধি স্থাপন করতে।

ধর্ম দিয়ে সমাজ আমাদের সম্পর্কে বাঁধাও আঁকতে চাইছে। তখন আমার সামনে তিনটি পথ খোলা— উপেক্ষা, অপেক্ষা আর কৌশল। প্রচলিত কঠিন নিয়মের কাছে কোনোটাই টিকল না। উপায়ন্তর না পেয়ে ডাক্তারের সলাপরামর্শের টেবিলে বসি। ধর্মকে কাটাকাটি না করে বরং নষ্ট করি আমার অস্তিত্ব, রক্ত, রন্ধ্র ও ঘ্রাণ! একটি তরতাজা জীবন! আসলে সেদিন কেবল ওই মাসুমকে খুন করিনি। খুন হয়েছি আমিও।

০৬

দ্বাদশ ক্লাসের মেধাবী ছাত্রী জেসমিন। এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী। মেধা ও যোগ্যতায় তার ধারে কাছে দ্বিতীয় কেউ নেই। গান ও নাচে বেশ পারদর্শী। বংশ মর্যদায়ও সম্ভ্রান্ত। এলাকার প্রায় ছেলেরা তাকে পেতে এক প্রকার মহড়া বসাত। অথচ মেয়েটি কাউকে পাত্তা দিতে চাইত না। ছেলেরা বীর বাহাদুরের জাত, ওরা এটা সহ্য করবে কেনো? মেয়েটির উপর বিভিন্নভাবে চাপ বাড়তে থাকে। জেসমিন লেখাপড়া করতে চায়। তার স্বপ্ন অনেক বড়ো। আমি চাই তাকে কৌশলে পটাতে। জেসমিন এসব সহজেই বুঝে যেত, একদিন সব কৌশল বাদ দিয়ে সরসারি তাকে ভালো লাগা ও ভালোবাসার কথা জানাই। মেয়েটি আমাকে পাত্তা না দিয়ে এড়িয়ে যায়। আমার সম্মানে লাগে। এক পর্যায় হুমকি দিয়ে বশে আনার চেষ্টা করি। তাতে কাজ হল না। বরং হিতে বিপরীত।

এই নিয়ে এলাকায় দেন দরবারও কম হয়নি। কিন্তু আমি তো থেমে যাওয়ার পাত্র ছিলাম না। একদিন শুনি মেয়েটি সিলিংফ্যানে নিজেকে ঝুঁলিয়ে মুক্তির একটা পথ খুঁজে নিয়েছে। তার পরিবারের লোকজন মামলা-মোকাদ্দমায় না গিয়ে মানসিক সমস্যা বলে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়। অথচ তার মৃত্যু এখনও আমার কাছে অবিশ্বাস ঠেকে। কিছুতেই বুঝতে পারিনি- সে আত্মহত্যা করবে! এই আত্মহত্যার দায় আমি এড়াতে পারি না।

সম্মানিত উপস্থিতি এবার ভাবুন, আমি খুনী নই! একজন দাঁড়িয়ে বলল, আপনার অনেক আগেই ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। আরেকজন বলল, আপনাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা উচিত ছিল। এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে বলল, আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম প্রাণি। একজন পাশে থুথু ফেলল।

০৭

বার্ধক্যের কারণে আব্বা দীর্ঘদিন অসুস্থ। ডাক্তার কবিরাজ দেখানোর পরও কিছুতেই আরোগ্য মিলছে না। তার উপরে সংসারের বিশাল বোঝা আমার ছোটো কাঁধে। এমন দায়িত্ব নিয়ে হিমশিম খেতে হয়। তখন ছিলাম বিশুদ্ধ বেকার। কেবল প্রেমের হাওয়া হৃদয় নাড়িয়ে দূর থেকে দূরে বহুদূরে নিয়ে যায় আমাকে। বাতাসের তালে তালে হারিয়ে যেতে চাই আমিও। ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না। অনিচ্ছা থাকার পরও সব অবাধ্যতা প্যাকেটে ভরে ফেলে দিলাম পাশের নদীতে। সেই পোটলার সঙ্গে ভেসে যাচ্ছি। অবশিষ্ট যেটুকু রইলাম সেটুকু দিয়েই সংসারের হাল ধরলাম শক্ত হাতে। জমির ফসল একমাত্র ভরসা। হাতে নগদ টাকা নেই। চারপাশে কেবল অন্ধকার দেখছি। যতই দৌড় দেই ততই অন্ধকার ঘিরে ধরে। কিছুতেই অতিক্রম করতে পারছি না। অন্ধকারের ভেতর আবার নৈঃশব্দ্য। এত নৈঃশব্দ্য আমার ভালো লাগে না। এখানে জীবনের কোনো কূল নেই। এসব দেখারও কেউ নেই। যেদিকে তাকাই সে-দিকেই অন্ধকার। গভীর ক্রোধ আমাকে আহত করতে থাকল। কোথাও আলো নেই। আশা নেই। কোনো উপায়ও খুঁজে পেলাম না। দিশেহারা হয়ে একা একা ক্ষরণ নদীতে ভাসতে থাকলাম। মা প্রায়ই মাথায় হাত রেখে বলতেন, দুঃখ করিস না। দুঃখরা তিনবোন। সবাই দল বেঁধে আসে। আবার দল বেঁধে চলেও যায়। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, বাপ। মায়ের কথাগুলো তখনো বলা শেষ হয়নি। ছোটো বোনের চিৎকার— আব্বা রক্তবমি করছে! সঙ্গে কাঁপন দিয়ে জ্বর। জ্বর বাড়লে শীতও বাড়ে। কনকনে শীতের মওসুম তখন। কুয়াশার কারণে বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। একসঙ্গে রক্ত-বমি-ডায়রিয়া-জ্বর। অন্যদিকে শীতে জবুথবু অবস্থা। এমন ভয়ঙ্কর রাতে কোথাও নেয়ার মতো অবস্থাও নেই। একের পর এক কাঁথা গায়ে জাড়ানো ছাড়া। ডায়রিয়া ও বমির কারণে আব্বা সেসব নষ্ট করে ফেলেন। এমন করে করে সব কাঁথা নষ্ট হয়। রোদের অভাবে শুকানোও সম্ভব হচ্ছিল না। শেষ ভরসা গায়ের চাদর। চাদরের শক্তি আর কতটুকু যে প্রবল শীতকে দমাতে পারে। আব্বাকে জড়িয়ে ধরি। নাহ, শীত মানে না। মায়ের শাড়ি দিয়েও প্যাঁচানো হয়। কিছুতেই শীত যাবে না। সেইদিন শীত সম্ভবত ওয়াদা করে এসেছিল, তাই যেতে চাইছিল না। অসহনীয় কষ্ট আব্বাও সইতে পারলেন না। সহ্য করতে পারছিলাম না আমরাও। আব্বা ইশারা করছেন— শরীরের ওপর আরো কাঁথা দিতে। উপায় না পেয়ে ভেজা কাঁথা ছড়িয়ে দিলাম। আব্বা আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ঠান্ডা সইতে না পেরে, না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন। কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম! সে সময় আমার কিছু করার ছিল না! ছিল বলেই বলছি, আমি সেই মৃত্যুর দায় কোনোভাবে উপেক্ষা করতে পারি না। কারণ, চিন্তা করলে কোনো না কোনো উপায় বের হতো, যা আমি করিনি। আমি তৃতীয় বারের মতো খুন করলাম একজন মানুষ। যেই মানুষটি আমার পরম প্রিয় পিতা।

আজগরের ছেলে রক্তচক্ষু নিয়ে পিতার দিকে তাকায়। মেয়েরাও তাকায়। স্ত্রীর চোখে কেবল বিস্ময়ের ধোঁয়া। হয়ত ভাবছে, কার সঙ্গে এতদিন এক বালিশ শেয়ার করে নিজেকে উজার সঁপে দিয়েছি!

০৮

জজ সাহেব, এতগুলো মৃত্যুর জন্যে আমি কী কোনোভাবেই দায়ী নই? আমার মগজ একটা আদালত। সেখানে অনেকগুলো বিভাগ উপবিভাগে বিভক্ত। প্রতিটি বিভাগে একজন করে পরিচালক ও উপপরিচালকও নিয়োগ দেয়া। তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রমাণিত হয়— এইসব খুনের দায় কোনোভাবেই আমি এড়াতে পারি না। আমি খুনী। আমি খুন করেছি। খুনীকে সাজা পেতেই হবে আজ অথবা কাল। চোখ মেলে দেখুন, আমার হাতে রক্ত। ছোপ ছোপ রক্ত। মুক্তার গর্ভের সন্তানের রক্ত। জেসমিনের রক্ত। বয়োবৃদ্ধ বাবার রক্ত! রক্ত! রক্ত! সব খুনের রক্ত! তাজা রক্ত! আজ এরা সবাই জীবিত হয়ে জনতার কাতারে চিৎকার করছে। আমি দেখছি। আমি শুনতে পারছি ওদের হৃদয়বিদারক চিৎকার। সঙ্গে ওদের স্বজন-পরিজনের হাহাকার। আর এদের নেতৃত্ব স্বয়ং আব্বা। চিৎকার করে বলছেন— বিচার চাই। বিচার চাই। 

জজ সাহেব, খুব ভয় হয়। এখান থেকে বের হলে ওরা আমাকে জ্যান্ত মেরে ফেলবে। তাছাড়া এত মানুষের দাবি আপনার আদালত উপেক্ষা করতে পারলেও আমার আদালত উপেক্ষা করতে পারবে না। মানুষ কাজের প্রতিদান পৃথিবীতেই পেয়ে যায়।