শিল্প ও সাহিত্য

‘কাউকে জিজ্ঞেস করিনি- আমার কবিতা কেমন হচ্ছে?’

নির্মলেন্দু গুণ সমকালীন বাংলা কবিতায় সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম। তাঁর কথায়- কবিতা হচ্ছে কাব্যলক্ষ্মী, গদ্য ছত্রবৎ। দুই ধারাতেই নির্মলেন্দু গুণ অনন্য, অসামান্য। বাংলাদেশের জন্ম এবং মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার যে রক্তসিঁড়ি তার সঙ্গেও নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাৎ শারীরিক এবং আত্মিক। তিনি বেড়ে উঠেছেন বাংলা ভাষা, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবাদ, সমাজ, মানুষ, প্রেম, প্রকৃতির সাহচর্যে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার দুটি ধারা- একটি প্রেম এবং একটি রাজনীতি। দুই ধারাতেই তিনি সমান সার্থক। এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কবির ব্যক্তি পরিচয়, রাজনৈতিক দর্শন, কবিতায় এর প্রতিফলন এবং অবশ্যই বঙ্গবন্ধু। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি শিহাব শাহরিয়ার

শিহাব শাহরিয়ার: আপনার পুরো নাম নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী। আপনার বাবার নাম সুখেন্দু প্রকাশ গুণ। নামের সঙ্গে ‘চৌধুরী’ কীভাবে যুক্ত হলো?

নির্মলেন্দু গুণ: ব্রিটিশ পিরিয়ডে যখন জমিদারি প্রথা ছিল, জমিদারদের কাছ থেকে বিভিন্ন পরগণা, বিভিন্ন গ্রাম পত্তন নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূস্বামী শ্রেণী তৈরি হয়েছিল। জমিদারদের পরবর্তী স্তরের তালুকদার এবং চৌধুরী এই টাইটেলধারীরা ভূস্বামী যারা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার অধিকার সনদপ্রাপ্ত হতেন। সেদিক থেকে আমার ঠাকুরদাদা রামসুন্দর গুণ আমাদের গ্রামসহ আরো প্রতিবেশী দুটো গ্রামের মোট তিনটি গ্রামের পত্তন নিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষানুরাগী ছিলেন। আজ থেকে ১২০ বছর আগে ১৯০০ সালে তিনি ওই গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলটি নেত্রকোণা জেলার দ্বিতীয় স্কুল। তিনি জমিদারির অতি সামান্য অংশ ক্রয় করেছিলেন। সেজন্য ‘চৌধুরী’ উপাধি যুক্ত হয়েছিল।

আমাদের মূল পদবীর উৎস সন্ধান করতে গিয়ে আমি নানা রকম তথ্য পেয়েছি। অনেকে দাবি করেন যে, মধ্যযুগের কবি মালাধর বসুর বংশধর আমরা। এ সম্পর্কে কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য রয়েছে। আমাদের গুণ বংশের অধিকাংশ কিন্তু পরবর্তীকালে বর্ধমানে ফিরে গেছেন। তখনকার বর্ধমান একটা ডিভিশন ছিল। ওই ডিভিশনটা একজন মুসলিম প্রশাসক শাসন করতেন। তাঁর রাজসভা অনেকটা কৃষ্ণচন্দ্রের যে রাজসভা আমরা নবদ্বীপে দেখতে পাই, সেই রকম। মালাধর বসু ওই রাজসভার কবি ছিলেন। মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত কাব্যশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে ওই মুসলিম শাসক তাঁকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধি দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বর্গীদের হামলার সময় যখন মারাঠী বর্গীরা ওই বর্ধমান অঞ্চলে এসে হামলা করতে শুরু করল, তখন বাংলাদেশের বিশেষ করে বাংলার ধনসম্পদের প্রতি তাদের লোভ ছিল। বাংলা সম্পদশালী ছিল তখন। ফলে ওই সময়ে যখন বর্গীরা হামলা করল তখন যাদের হাতে টাকা-পয়সা ছিল তারা বর্ধমান ত্যাগ করে পূর্ব দিকে আসতে শুরু করে। ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে তারা ময়মনসিংহ এবং সিরাজগঞ্জ এলাকায় স্যাটেল হয়েছে। ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ- এসব নদী পথে যারা এসেছিলেন তারা বিভিন্ন জায়গায় আবাসস্থল গড়ে তুলেছিলেন। আমার জানা মতে চারটা এলাকায় গুণ উপাধিযুক্ত মানুষ রয়েছে- সিরাজগঞ্জে, নারায়ণগঞ্জে, ময়মনসিংহে এবং ফরিদপুরে। মনে হয়, তারা নদী পথে পালিয়ে চলে এসেছিলেন বর্গীদের হামলা থেকে নিজেদের সম্পদ, সম্ভ্রম রক্ষার জন্য। এটা কতদূর সত্য আমি জানি না। ‘খাঁ’ পরবর্তীকালে মুসলমানদের উপাধিতে পরিণত হয়। আগে কিন্তু এটা শুধুই মুসলমানদের উপাধি ছিল না। এটা হিন্দুদের উপাধিও ছিল। সেই ‘গুণরাজ খাঁ’র ‘রাজ খাঁ’ বাদ দিয়ে পরবর্তীতে ‘গুণ’ রেখে দেওয়া হয়েছে। এরকম হতে পারে বলে আমরা অনুমান করি।

শিহাব শাহরিয়ার: আপনি যখন লেখালেখি শুরু করলেন, নাম থেকে প্রকাশ এবং চৌধুরী বাদ দিলেন কেন?

নির্মলেন্দু গুণ: প্রথমে আমি চৌধুরী বাদ দিলাম। আনন্দমোহন কলেজে যখন আমি ভর্তি হলাম মেট্রিক পাস করার পর ১৯৬২ সালে, তখনও আমার সার্টিফিকেটে নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী ছিল। আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সময় কলেজ ম্যাগাজিন বের হয়েছিল ১৯৬২ সালে, সেখানে বাংলা বিভাগে আমি কবি হওয়ার জন্য কবিতা জমা দিয়েছিলাম সম্পাদকের কাছে। তিনি আমাকে বললেন, বাংলা বিভাগের কবিতা অনেক বেশি হয়ে গেছে। এই বিভাগে আর কবিতা নেব না। আপনি পারলে ইংরেজিতে একটা কবিতা দিতে পারেন। ইংরেজি বিভাগে কবিতা কম। তখন আমি মাইকেল মাধুসূদন দত্তের কথা স্মরণ করলাম। তিনি ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন। আমি ওই চিন্তাটাকে প্রশ্রয় দিয়ে বললাম- আমি তাহলে ইংরেজি বিভাগেই কবিতা দেব। সেখানে আমার নামের মধ্যে ‘চৌধুরী’ ছিল না। সেখানে প্রকাশ হয়েছিল- নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ, আইএসসি ফার্স্ট ইয়ার। অর্থাৎ আমি চৌধুরী বাদ দিয়েছিলাম। কিছুদিন যাওয়ার পর আমার মনে হলো- প্রকাশটা বাদ দিলে নামটা আরো সংক্ষিপ্ত হবে। এতে মানুষের পক্ষে স্মরণ রাখতে সুবিধা। আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেউ আমাকে সাহায্য করেনি। আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবি। আমি কাউকে জিজ্ঞেস করিনি- আমার কবিতা কেমন হচ্ছে?

শিহাব শাহরিয়ার: আপনি যখন ঢাকা এলেন; আমরা জানি, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় আপনি কাজ করেছেন। সেই সময় সম্পর্কে একটু বলবেন?

নির্মলেন্দু গুণ: ঢাকা সম্পর্কে আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল যখন ঢাকায় আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে; একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘জনতা’য়। সম্পাদক ছিলেন ব্যারিস্টার শওকত আলী। এরপর আমি কবি হতে আগ্রহী হয়ে উঠি। আমার ভেতর একটা ধারণা তৈরি হয়- আমি কবিতা লিখতে পারব। তখন থেকে আমি ছয় দফার পক্ষে কবিতা লিখতে শুরু করি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ভালোবাসা, প্রীতি ও স্নেহের সম্পর্ক ছিল। তিনি খুনিদের সঙ্গে আপস করেননি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর এবং তাজউদ্দিন এই চারজন যারা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন বলা যায়, তারা কিন্তু মোশতাকের সঙ্গে যোগদান করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ভিন্ন হতো। ২১ বছর পর স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে এলো। এর পেছনে এই জাতীয় চার নেতা যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁদের অবদান রয়েছে। এই চারজন নেতাকে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর হত্যা করা হয়েছিল জেলখানায়। তাঁদের এই আত্মত্যাগের ঘটনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তাঁরা যদি তাঁদের জীবন দান করতে পারেন দেশের জন্য, বঙ্গবন্ধুর জন্য, তাহলে একটু ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমিও কবিতা লিখব এবং প্রকাশ্য জনসমাবেশে পাঠ করব। সুতরাং আমার মধ্যে ঐ সাহস বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এই চার জাতীয় নেতা সৃষ্টি করেছিলেন।

যে প্রসঙ্গে এই কথা, সেই সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাসা ছিল ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের সামনে। তিনি অধ্যাপনা করতেন। তাঁর আপন ভাগনে আনোয়ার হোসেন ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন। আমার বন্ধু ও সহপাঠী। আনোয়ার ছাত্র জনসভায় আমার কবিতা পাঠ করতেন- ‘চেয়ে দেখো প্রেয়সী গো কোনোদিন চাইনি কিছুই, আজ কিছু রক্ত চাই। চেয়ে দেখো বাঙালির চোখগুলো রক্তহীন ভীষণ হলুদ’। আরেকটা কবিতা তার খুব প্রিয় ছিল- ‘শীতের রোগীর মতো জুবুথুবু নয়, গঞ্জের জনতার মতো নির্ভীক হতে হবে রক্তের রঙ দেখে ভয় নেই, স্বাধীন দেশের মুক্ত জনতা উল্লাস কর সবে।’ ছয় দফা ঘোষণার পরে আমাদের চেতনার মধ্যে একটা স্বতন্ত্র স্বাধীন ভূখণ্ডের ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল।

শিহাব শাহরিয়ার: মূলত বঙ্গবন্ধুর যে ছয় দফা দিলেন, সেটিকে আমরা স্বাধীকার আন্দোলন বলি। কিন্তু ছয় দফাকে আসলে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা বলেই আমরা মনে করি।

নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, এখন তো প্রমাণিতই হচ্ছে। ১৯৬৬ সালে আমি এটাকে যতটা অন্তরে ধারণ করে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলাম সেটা অনেকেই করেনি; আওয়ামী লীগের কর্মীরা ছাড়া। কবি, সাহিত্যিকদের মধ্যে কেউ করেনি, ফলে সেই দিক থেকে ইতিহাসে আমার একটা আলাদা অবস্থান তৈরি হয়েছে। সেটা কেউ কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে না। স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার যে গৌরব, এ গৌরব তো পরবর্তীকালের কবিরা অর্জন করতে পারবে না। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার গৌরব আমাকে একটি আলাদা অবস্থানে নিয়ে যাবে। ইতিহাসে সেটা নির্ধারিত।

১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন সপরিবারে, আর লেখকরা কোনো নির্যাতনের মুখোমুখি হলেন না- তাহলে কি সেই জাতির মধ্যে, কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রেম ভালোবাসা ছিল না- একটা প্রশ্ন কিন্তু আসতে পারে। যেখানে জেলখানায় চার নেতা নিহত হচ্ছেন, যেখানে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হচ্ছেন, তাদের লাশ দেখার জন্য আমি যখন হাসপাতালে গেলাম, আমি তো পরিচিত সাংবাদিক, লেখক কাউকে দেখিনি এবং পরবর্তীকালে কেউ দাবিও করেনি তারা ১৫ আগস্টের সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত না করেই হূমায়ুন আহমেদ একটা উপন্যাস লিখে বসল ‘দেয়াল’। সে উপন্যাসে সে দাবি করে বসল- বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি লুট হয়ে গিয়েছিল। এত বড় মিথ্যাচার তিনি করলেন! পরে আমি যখন বললাম- এই মিথ্যা ইতিহাস পরিবশেন করার জন্য হূমায়ুন আহমেদের বিচার হওয়া উচিত এবং এই মিথ্যা ইতিহাস প্রকাশ করার জন্য ‘প্রথম আলো’র বিচার হওয়া উচিত। তখন আনিসুল হক আমাকে জানালেন, হূমায়ুন আহমেদ এই তথ্যটি অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বই থেকে উদ্ধৃত করেছেন।

আমি বললাম, তোমার উপন্যাস লেখার যদি এত ইচ্ছা হয়, তুমি অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বিদেশি লেখক, ভাড়াটে লেখক, এরশাদের ভাড়াটে লেখক ছিলেন তিনি; তার লেখা বই থেকে উদ্ধৃতি করবে? টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারলে না? আমি তাঁকে ক্ষমা করতে পারি না এই ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ থেকে। সেই সময় আমাদের লেখকদের মধ্যে আমি নির্যাতিত হয়েছি। আর্মি আমাকে ধরে নিয়ে গেছে। পুলিশ ইন্টারোগেট করেছে। ভাগ্য ভালো যে আমাকে খুব একটা শারিরীকভাবে নির্যাতন করা হয় নি। যা করা হয়েছে তা অনেকটাই মানসিক নির্যাতন।

আর্মি আমাকে ধরেছিল ১৯৭৫ সালের ১১ নভেম্বর পিজি হাসপাতাল থেকে। আমি আমার বন্ধু আবুল হাসানকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তখন সামরিক একটা গ্রুপ সেখানে অপেক্ষা করছিল আমাকে ধরার জন্য। আমি যে আবুল হাসানকে দেখতে যাব এই তথ্য তাদের পরিবেশন করা হয়েছিল এবং তারা ভেবেছিলেন আমাকে আর্মি গুম করে দেবে। কিন্তু যে আর্মি অফিসার আমাকে অ্যারেস্ট করেছিলেন, তিনি আমাকে এখন যেখানে শিশুপার্ক রয়েছে, সেখানে একটা অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি ছিল; এসপির অফিস। ফেনীর আব্দুস সালাম সাহেব ছিলেন সিটি এসপি। তাঁর কাছে আমাকে গচ্ছিত রেখে যান এবং একটা স্পেশাল ইন্সট্রাকশন দিয়ে যান- আমার সঙ্গে যাতে খারাপ ব্যবহার করা না হয়। আমাকে অ্যারেস্ট করেছিলেন কর্নেল নওয়াজেশ আহমেদ। এটা আমার কাছে এখনো রহস্যময়। তিনি আমাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নাকি আমার উপর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য? কারণ পরবর্তীকালে এই কর্নেল নওয়াজেশের ফাঁসি হয়েছিল। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর এরশাদ দ্রুত বিচার করে যে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি দিয়েছিল তাদের মধ্যে কর্নেল নওয়াজেশ আহমদ একজন। আমি সেই সময়টায় অত্যাচারিত হয়েছি, নিপীড়ন ভোগ করেছি, মানসিক নির্যাতন ভোগ করেছি।

শিহাব শাহরিয়ার: ষাটের দশক নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। যে দশকটি বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল দশক। এ সময়ে আপনারা এক ঝাঁক তরুণ; আমি আবুল হাসানসহ সুরাইয়াখানমের কথাও শুনতে চাই। আপনার বন্ধু, সতীর্থরা বাংলা কবিতাকে পাশাপাশি নিয়ে যাচ্ছেন এবং এটি একটি সময় ধারণ করে।

নির্মলেন্দু গুণ: ষাটের দশককে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ষাটের শুরু থেকে, আবার মধ্যভাগ থেকে। ১৯৬৫ থেকে অনওয়ার্ড আরেকটি হলো ৬০ থেকে ৬৫ পর্যন্ত। আমাদের যে কাব্য আন্দোলন এখানে শুরু হয়েছিল, সেটা কিন্তু অনেকটাই পশ্চিমা বিট বংশের যে কাব্য আন্দোলন যেটা আমেরিকার বিট বংশের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, গ্রেগরি কর্সো, জ্যাক ক্যারোয়াক, বব ডিলান; বব ডিলান ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। গিন্সবার্গকে তিনি ‘ড্যাডি’ ডাকতেন। ১৯৯১ সালে, যখন প্রথম আমেরিকা গিয়েছিলাম আমি  গিন্সবার্গের সঙ্গে পরিচিত হই। যেহেতু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ সেজন্য আমি তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। ষাটের দশকে আমরা যখন বোহেমিয়ান জীবনযাপন করছিলাম তখন কিন্তু বিট জেনারেশনের একটা প্রভাব আমাদের মধ্যে পড়েছিল। এখানে স্যাড জেনারেশনের রফিক আজাদ, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ- এরা একটা স্বতন্ত্র সাহিত্য আন্দোলন সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময়ে আমরা মধ্য ষাটে এসে যুক্ত হয়েছিলাম সেই আন্দোলনের সঙ্গে। আসাদ চৌধুরীও যুক্ত ছিলেন ষাট দশকের শুরু থেকে। ওই সময়টায় আমরা যখন ঢাকায় আসি আমরা সবাই গ্রাম থেকে এসেছিলাম। আমি যেমন নেত্রকোণা থেকে, আবুল হাসান বরিশাল থেকে, মহাদেব পাবনা থেকে, সাজ্জাদ কাদির, আবু কায়সার টাঙ্গাইল থেকে, অরুণাভ সরকার- এরকম বিভিন্ন গ্রাম থেকে উঠে আসা কবিরা।

বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে এসেছিলেন। আমাদের রুট ছিল গ্রামে। ফলে আমাদের মধ্যে চরিত্রগত এবং শ্রেণীগত একটা মিল ছিল। আমি আবুল হাসানের কাব্য প্রতিভা শনাক্ত করেছি তার কবিতা পড়ে। আমার কবিতা আবুল হাসান পড়ার আগেই তাঁর কবিতা আমি পড়ার সুযোগ পেয়েছি। কারণ ‘কণ্ঠস্বর’-এ আবুল হাসানের কবিতা ছাপা হতো। ফলে আবুল হাসানের কবিতাকে আমি আধুনিক কবিতার রোল মডেল হিসেবে মনে করতাম। আবুল হাসানের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর দেখলাম, তার মধ্যেও কবিতাই হচ্ছে বড় প্রেরণার শক্তি।

একসময় আমি কবি না-হওয়ারও চেষ্টা করেছি। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। মেট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েট দুটোতেই ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেছি। তখন আজকের মতো এতো ফার্স্ট ডিভিশনের ছড়াছড়ি ছিল না। আমার সময় ঢাকা বোর্ড থেকে ১১৯ জন ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল। আমাদের কলেজ থেকে আমিই একা ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম। আমাদের কলেজে খুব আনন্দ হয়েছিল এবং আমাকে নিয়ে মিছিল পর্যন্ত হয়েছে। ভালো ছাত্রদের লক্ষ্য ছিল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির মধ্যে বিভিন্ন সাবজেক্ট, আর্টস ফ্যাকাল্টির মধ্যে শুধু ইকোনমিক্স, বড় জোর ইংলিশ আর অন্য কোনো সাবজেক্টের প্রতি ভালো ছাত্রদের নজর ছিল না। ফলে আমার পরিবার থেকে আশা করেছিল আমি ডাক্তারি পড়ব বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব ইত্যাদি। যাই হোক আমি তাদের সে স্বপ্নপূরণ করতে পারিনি।

পরবর্তীকালে আমার নামে দুটো হুলিয়া জারি হয়েছিল। আমি একটি কাব্য সংকলন প্রকাশ করেছিলাম নেত্রকোণা থেকে ‘সূর্যফসল’ নামে। সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছিল। ‘সূর্যফসল’ ছাপা হয়েছিল নেত্রকোনার নুর আর্ট প্রেস থেকে। ঐ প্রেসের মালিক জনাব নুর মোহাম্মদ সাহেবের ছয় মাস জেল হয়েছিল। আমাকে ধরতে পারে নি। আমি পালিয়ে বেঁচেছিলাম। আমি তখন বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকতাম। ময়মনসিংহের গৌরীপুরে, শ্যামগঞ্জে এবং শেষ পর্যন্ত ঢাকায় চলে আসি। তখন আমার নামে আরেকটা হুলিয়া জারি হয়। থানার দারোগা একটি ট্রেন ডাকাতি মামলায় আমাকে যুক্ত করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনে কত মামলা হয়েছিল; একটা মামলা থেকে বেরুতে আরেকটা মামলা। ঐ পদ্ধতি কিছুটা আমার উপর দিয়েও গেছে। আমি পালিয়ে থেকেছি দীর্ঘদিন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই পরবর্তীতে আমি ‘হুলিয়া’ কবিতাটি লিখেছিলাম।

যারা এদেশের মুক্তির কথা বলেছেন, চিন্তা করেছেন, যারা ভাষা আন্দোলনের উত্তরসূরি ছিলেন, যারা সেকুলার, ধর্ম নিরপেক্ষ, শোষণমুক্ত একটা দেশের স্বপ্ন দেখতেন তাদের উপর নিপীড়ন নেমে এসেছে নানা ভাবে। আমি সেই নিপড়ীতদের দলে ছিলাম এবং আমার সময়ের রাজনৈতিক সচেতন কবিদের আগে ছিলাম আমি। আবুল হাসানের সঙ্গে আমার পার্থক্য ছিল। আবুল হাসান নান্দনিকতাকে কবিতার জন্য বড় করে দেখতেন। তিনি রাজনীতির বাহক হিসেবে কাব্যকে ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তার একটি কবিতা আছে- অসম্ভব দর্শন। সে কবিতাটি তিনি আমাকে উৎসর্গ করে লিখেছেন ‘দালান উঠছে তাও রাজনীতি, ফুল ফুটছে তাও রাজনীতি।’ মানে আমি যে সবকিছুর মধ্যে রাজনীতিকে প্রত্যক্ষ করছি এটা আবুল হাসানের পছন্দ ছিল না। আমি তাঁকে বঙ্গবন্ধুর ওপর কবিতা লেখার জন্য অনুরোধ করেও লেখাতে পারি নি। তবে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল।

আমি যখন ঢাকা চলে এলাম আমার পরিবার জানতো আমি ইন্ডিয়া চলে গেছি। আমি ইন্ডিয়ায় চলে যাব বলে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকা চলে এসেছিলাম কবি হওয়ার জন্য। আমি মনে করি আমার ওই সিদ্ধান্তটি যথার্থ ছিল এবং আমি সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি।

শিহাব শাহরিয়ার: আপনার সতীর্থ যারা আছেন ষাটের দশকের কার কবিতা আপনাকে বেশি টানে?

নির্মলেন্দু গুণ: আমি ভালো পাঠক নই। টানতে হলে তো পঠন-পাঠন দরকার হয়। একটা ছোট চুম্বক তো একটা বড় শক্তির লৌহখণ্ডকে টানতে পারে না। চুম্বক খণ্ডের ক্ষমতা থাকে- সে কতটুকু জিনিস টানতে পারবে এটা চুম্বকের উপর নির্ভর করে।

শিহাব শাহরিয়ার: কবি হতে চাওয়া এবং আমরা মনে করি যে, এই চাওয়াতে আপনি সাথর্ক। আপনি এক দিক দিয়ে প্রেম, অন্য দিক দিয়ে রাজনীতি অর্থাৎ দ্রোহ পাশাপাশি রেখে এতটা সময় পার করে দিয়েছেন বাংলা কবিতায়- এ বিষয়টি একটু বলবেন কি?

নির্মলেন্দু গুণ: আমার অনেস্ট ফিলিংসের ভেতরে যে জগৎ আমাকে আহ্বান করেছে আমি মনে করি, কবির জন্য একটা মানসিক ধ্যানের দরকার। তার স্থিতি দরকার। একাত্ম হয়ে বসে জীবন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ তৈরি করা দরকার। করোনাকে এই দিক থেকে বলব- করোনা নতুন করে চিন্তা করার একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা যারা ক্রিয়েটিভ লোক তারা এবং যারা মানব সভ্যতার শিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চান তারা নতুন করে ভাববার অবকাশ পাবেন এই সময়ের মধ্যে। করোনাকাল চলে গেলে আমরা হয়ত একটি অপেক্ষাকৃত সুন্দর পৃথিবী পাব- এরকম প্রত্যাশা আমাদের মধ্যে আছে। কারণ এই করোনার করাল গ্রাসে ইতোমধ্যে দশ লাখের অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ফলে করোনার যে ছোবল আমাদের জীবনে এলো সেই ছোবলটা দেখে নতুন করে আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। হয়ত আগামী দিনের মানুষ বোধ করবে- এরকম প্রত্যাশা রাখি।

আমার স্থিতিস্থাপকতা রয়েছে। আমি বসে থাকতে পারি। জানি কোনো কিছু পেতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করেছি বলেই আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন অনন্য নেতাকে পেয়েছি। যিনি জাতিকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, যে স্বাধীনতার স্বপ্ন আমাদের কবিরা দেখেছিলেন। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন পদ্মিনী উপাখ্যানে- স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃঙ্খল বলো কে পরিবে পায়? পরবর্তী কবিরাও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল তাঁরা এই শৃঙ্খল মুক্তির গান গেয়েছেন কবিতায়, গানে- কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট। নজরুল তো কারাগারেও গিয়েছেন। ব্রিটিশরা তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে কিন্তু দেশ তো স্বাধীন হয় নাই। কবির স্বপ্নেই কিন্তু দেশ স্বাধীন হয় না।