শিল্প ও সাহিত্য

প্রসঙ্গ: ‘আইলা রে নয়া দামান’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘লোকসাহিত্য’ (১৯০৭) বইয়ে ছেলেভুলানো ছড়া প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত এক অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। ‘আগডুম বাগডুম’ শীর্ষক এক ছড়ার তিনটি পাঠ উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন: ‘ছড়াগুলির মধ্যে মূল পাঠ কোন্টি তাহা নির্ণয় করা অসম্ভব, এবং মূল পাঠটি রক্ষা করিয়া অন্য পাঠগুলি ত্যাগ করাও উচিত হয় না। ইহাদের পরিবর্তনগুলিও কৌতুকাবহ এবং বিশেষ আলোচনার যোগ্য।’

লেখার শুরুতেই এ তথ্য উপস্থাপনের উদ্দেশ্য রয়েছে। সেটা হয়তো ক্রমশ প্রকাশিতও হবে। তবে প্রাসঙ্গিক কারণে একই রচনা থেকে রবীন্দ্রনাথের আরও একটি পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দেওয়া প্রয়োজন- ‘ভাষার যে ক্রমশ কিরূপ রূপান্তর হইতে থাকে এই সকল ছড়া হইতে তাহার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।’ এ ছড়াটি নিয়ে প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে দেখা গেছে লোকসংস্কৃতি গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্যকেও। তিনি ‘আগডুম-বাগডুম’-এর আটটি পাঠ সংগ্রহ করেছিলেন। যার উল্লেখ আছে তাঁর ‘বাংলার লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে।

সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত বিয়ের গীত ‘আইলা রে নয়া দামান’ গান প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আশুতোষ ভট্টাচার্যের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করার মূল কারণও প্রায় একই। যে ‘নয়া দামান’ গানের গীতিকার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্তি, সেটি দিব্যময়ী দাশের রচনা নাকি প্রচলিত লোকগান- তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আরেকটু উসকে দিতে পারে হয়তো এ তথ্য- গানটির ভিন্ন ভিন্ন আটটি পাঠ বর্তমান লেখকের সংগ্রহে আছে। তাহলে এ গানটি কি প্রচলিত লোকগান আর সামষ্টিক সৃষ্টি? যেটি প্রবহমান পরম্পরাগত চর্চার মধ্য দিয়ে আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছে। যদিও তা বিচারসাপেক্ষ, এরপরও ভাষাতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও বৈশিষ্ট্যগত দিক বিবেচনায় কিছুটা অনুমান তো করে নেওয়া যেতেই পারে।

অবশ্য এর আগে লোকসাহিত্যের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর কিছু দিক বলে নেওয়া প্রয়োজন। সেটা বলা যেতে পারে লোকসংগীত-বিশেষজ্ঞ ও চিত্রশিল্পী খালেদ চৌধুরীর বয়ানে। তিনি ‘লোকসংগীতের প্রাসঙ্গিকতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (২০০৪) বইয়ে লিখেছেন: ‘লোকসংগীতের কোনো প্রামাণ্যতা হয় না। লেখ্য ভাষার থেকে কথ্য ভাষাই লোকসংগীতের যে কোনো আখ্যান, গাথা বা কাহিনি প্রচারের একমাত্র মাধ্যম। যেহেতু লেখ্য রূপের থেকে কথ্যরূপে স্বাধীনতা অনেক বেশি তাই চেনাজানা লোক কাহিনির উপস্থাপনায় বিকৃতিটাও অনেক বেশি। গ্রাম্য গাথা লোকসংগীতের মাধ্যমে যখন প্রসারিত হয়েছে তখন স্বাধীনভাবে তার গল্পাংশ তার মতো করে কথকের ইচ্ছানুসারে বড় হয়েছে বা ছোট হয়েছে। তাই এখানে প্রামাণ্যতা খুঁজতে চাওয়া অর্থহীন। প্রামাণ্যতা, প্রকরণগত কলাকৌশলের যান্ত্রিকতা, ব্যাকরণসম্মত উপস্থাপনা এসব শুধু লোকসংগীতে নয় লোকসংস্কৃতির যে কোনো শাখার চর্চার ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।’

দুই একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী রামকানাই দাশ ২০০৫ সালে তাঁর ‘অসময়ে ধরলাম পাড়ি’ সিডি-অ্যালবামে ‘আইলো রে নুয়া জামাই’ গানটি গেয়েছিলেন। সেখানে তিনি এ গানটি তাঁর মা দিব্যময়ী দাশের রচিত বলে উল্লেখ করেছিলেন। এ গানটি এমন-

আইলো রে নুয়া জামাই আসমানেরও তারা বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা। জামাই বও জামাই বও, ও জামাই বও জামাই বও ॥ আইলো রে নুয়া জামাই আসমানেরও তারা বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা। জামাই বও জামাই বও, ও জামাই বও জামাই বও।

আইলো রে জামাইয়ের ভাইবউ দেখতে বটের গাইল আইলো রে জামাইয়ের ভাইবউ দেখতে বটের গাইল উঠতে বইতে ছয়মাস লাগে, করইন আইন-চাইন জামাই বও জামাই বও, ও এগো উঠতে-বইতে ছয়মাস লাগে, করইন আইন-চাইন। জামাই বও জামাই বও। আইলো রে নুয়া জামাই আসমানেরও তারা বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা। জামাই বও জামাই বও, ও জামাই বও জামাই বও।

আইলো রে জামাইয়ের বইন হিজলেরও মুড়া আইলো রে জামাইয়ের বইন হিজলেরও মুড়া ঠুনকি দিলে ফেদা পড়ে ষাইট-সত্তুর উরা জামাই বও জামাই বও, এগো ঠুনকি দিলে ফেদা পড়ে ষাইট-সত্তুর উরা জামাই বও জামাই বও আইলো রে নুয়া জামাই আসমানেরও তারা বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা। জামাই বও, জামাই বও জামাই বও, ও জামাই বও জামাই বও।

আইলো রে জামাইয়ের ভাই আসমানেরও চান আইলো রে জামাইয়ের ভাই আসমানেরও চান যাইবার লাগি কও রে যদি কাইট্টা রাখমু কান   জামাই বও জামাই বও ও এগো যাইবার লাগি কও রে যদি কাইট্টা রাখমু কান জামাই বও জামাই বও আইলো রে নুয়া জামাই আসমানেরও তারা বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা। জামাই বও জামাই বও, ও জামাই বও জামাই বও।

কুঞ্জেরও ভিতরে জামাই বইছে গো সাজিয়া কুঞ্জেরও ভিতরে জামাই বইছে গো সাজিয়া পাড়ার লোকে দেখত আইছে দিব্যময়ীর বিয়া জামাই বও জামাই বও, ও এগো পাড়ার লোকে দেখত আইছে দিব্যময়ীর বিয়া জামাই বও জামাই বও। আইলো রে নুয়া জামাই আসমানেরও তারা বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা। জামাই বও জামাই বও, ও এগো বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা। জামাই বও জামাই বও ও এগো বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা। জামাই বও জামাই বও জামাই বও জামাই বও ও জামাই বও জামাই বও ও জামাই বও জামাই বও।

এরপর ২০১৪ সালে ‘রামকানাই দাশের নন্দনভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ’ নামে আমার একটা বই প্রকাশিত হয়। সেখানে আমাকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে সংগীতগুণী রামকানাই দাশ জানিয়েছেন, ‘আইলো রে নুয়া জামাই’ গানটা তাঁর মায়ের রচনা। এরও দুই বছর আগে আরও একাধিক সাক্ষাৎকারে একই তথ্য তিনি জানিয়েছেন। তবে আমার বইটা প্রকাশিত হওয়ার পর সিলেটের প্রবীণ কয়েকজন লোকসংগীত শিল্পী বলেছেন, এ গানের কোনও গীতিকারের নাম জানা যায় না। এটা সিলেটে অন্তত ষাটের দশকেরও আগে থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ে প্রচলিত একটি বিয়ের গীত। এর রচয়িতা কোনোভাবেই দিব্যময়ী দাশ হতে পারেন না।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী তরুণ সুরকার মুজাহিদ আবদুল্লাহ ওরফে মুজা এবং সিলেটের সংগীতশিল্পী তসিবা বেগম পরিবেশিত এ গানটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পায়। এর অডিও-ভার্সন ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি দেওয়া হয় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। তিনদিনের ব্যবধানে এক মিলিয়নেরও বেশি শ্রোতা গানটি শোনেন। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই গানটি দেশ-বিদেশে ভাইরাল হয়ে পড়ে। ফেসবুক-টিকটক-লাইকি প্ল্যাটফর্মেও এ গানটি আলোড়ন তোলে। সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনজন চিকিৎসকের নাচের একটি ভিডিও দৃশ্য ভাইরাল হয়। এতে অপারেশন থিয়েটারে অ্যাপ্রোন পরে তাঁদের ‘নয়া দামান’ গানের সঙ্গে নাচতে দেখা যায়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত চিকিৎসকদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্যই শাশ্বত চন্দন, কৃপা বিশ্বাস ও আনিকা ইবনাত শামা এ পরিবেশনায় অংশ নিয়েছিলেন। এরপর চিকিৎসকেরা অনেকের অভিনন্দনে সিক্ত হন। সেই সঙ্গে গানটিও পেতে থাকে আরও জনপ্রিয়তা। এরপরই অনেকে গানের গীতিকারের নাম জানতে আগ্রহী হন। 

সবাই যখন নতুনভাবে ‘নয়া দামান’ গানের গীতিকারের সন্ধান চালাচ্ছেন, তখনই লেখক ও স্থপতি শাকুর মজিদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে সংগীতগুণী রামকানাই দাশের মেয়ে ও বিশিষ্ট শিল্পী কাবেরী দাশের বয়ানে জানান, আলোচিত গানটির রচয়িতা দিব্যময়ী দাশ। তখন সিলেটের অনেক প্রবীণ ব্যক্তি ও শিল্পীরা জানান, এ গানটি প্রচলিত লোকগান। এটি দিব্যময়ী দাশ রচনা করেননি। এরপরই শুরু হয় পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক। প্রকৃত গীতিকার তাহলে কে? এ প্রশ্নে সরব হন নেটিজেনরা (ইন্টারনেটের নাগরিক)। সিলেটের বাসিন্দারা তো বটেই, দেশ-বিদেশের অগণিত বাঙালিও প্রকৃত গীতিকারের নাম জানতে উৎসুক হয়ে পড়েন।

তিন সংগীতগুণী রামকানাই দাশের ছেলে পিনুসেন দাশ ফেসবুকে গত ৪ মে এক ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, সুমনকুমার দাশ রচিত ‘রামকানাই দাশের নন্দন ভুবন : একটি অন্তরঙ্গ আলাপ’ বইয়ের পাশাপাশি ‘বিবিসি বাংলা’ এবং ‘ভয়েস অফ আমেরিকা’য় তাঁর বাবা গানটি দিব্যময়ীর রচনা বলেছেন। কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। এতদিন পর উদ্দেশ্যমূলকভাবে কেউ কেউ গানটি ‘দিব্যময়ীর রচনা নয়’ বলে অযৌক্তিক দাবি করছেন। সঠিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো উচিত নয়। মূলত তাঁর ঠাকুরমার গানটিই পরিবর্তিত হয়ে ভিন্ন রূপ পেয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন। অন্যদিকে কাবেরী দাশ জানিয়েছিলেন, ১৯৬৫ সালের দিকে গানটি তাঁর ঠাকুরমা দিব্যময়ী দাশ রচনা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে এ গানটি দিব্যময়ী দাশের কাছ থেকে সংগ্রহ করে শিল্পী ইয়ারুন্নেসা খানম (২০২০ সালে প্রয়াত) সিলেট বেতারে রেকর্ড করেছিলেন বেশকিছু শব্দ বদল করে। দিব্যময়ী বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার না-থাকায় গানটি তখন ‘সংগৃহীত’ হিসেবে রেকর্ড হয়েছিল এবং সংগত কারণে গানের ভণিতাও বাদ দেওয়া হয়েছিল। তখন গানে ‘জামাই’ শব্দের বদলে ‘দামান’ শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

তবে কাবেরী দাশ এবং পিনু দাশের বক্তব্য কিংবা প্রখ্যাত শিল্পী রামকানাই দাশের সঙ্গে একমত হতে পারেননি সিলেটের অনেক সংগীতব্যক্তিত্ব। তাঁদের দাবি, এ গানটা তাঁরা সিলেটে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিয়ের আসরে বিয়ের গীত হিসেবে বহুকাল ধরে শুনে আসছেন। গানের রচয়িতার নাম কেউ জানেন না। ফলে দিব্যময়ী দাশকে গানের রচয়িতা বলায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সংগীতজ্ঞ রামকানাই দাশ স্বাধীনতার পরপর ‘বিদিত লাল দাস ও তাঁর দল’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেখানে যুক্ত ছিলেন সংগীতশিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস, হিমাংশু গোস্বামী, আকরামুল ইসলাম এবং দুলাল ভৌমিক। তাঁরা এ গানটি দিব্যময়ী দাশের রচনা নয় বলে জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য, এ গানটি ছয় থেকে সাত দশক ধরে সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত একটি বিয়ের গীত হিসেবেই পরিচিত। রামকানাই দাশের উপস্থিতিতে এ গানটিকে ‘সংগৃহীত’ হিসেবে নারী শিল্পীরা গাইলেও কখনও তিনি গানটিকে তাঁর মায়ের রচনা বলে দাবি করেননি। অথচ কী কারণে এখন এটি দিব্যময়ী দাশের রচনা বলে দাবি করা হচ্ছে, সেটি তাঁদের বোধগম্য হচ্ছে না। কেউ কেউ আবার কোনও ধরনের প্রমাণ ছাড়াই ‘নয়া দামান’ গানটিকে মরমিকবি হাছন রাজা ও তাঁর বোন ছহিফা বানু, মরমিকবি গিয়াসউদ্দিন আহমদ, সিদ্দিকুর রহমান ও এ কে আনামের রচনা বলেও দাবি করছেন। এ দাবিও অবশ্য সঠিক নয়।

সিলেটের লোকগানের জনপ্রিয় শিল্পী লাভলী দেব জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই এ গানটি গেয়ে আসছেন। এটি প্রচলিত মুসলিম বিয়ের গান। এর গীতিকারের সন্ধান পাওয়া যায় না। যাঁর কণ্ঠে গানটি সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরাল হয়েছে, সেই শিল্পী তসিবা বেগম বলেন, ‘এ গানের গীতিকারের নাম আমার জানা নেই। আমি প্রচলিত এ গানটি সংগ্রহ করে গেয়েছি।’ তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন- তসিবা যে গানটি গেয়েছেন, সেই পাঠের সঙ্গে দিব্যময়ী দাশের রচনা বলে যে পাঠটিকে বলা হচ্ছে, এর মধ্যে বিন্যাস ও শব্দগত বিস্তর তফাত রয়েছে।

এদিকে গত ৪ মে কাবেরী দাশ তাঁর ফেইসবুক আইডিতে ‘আইলো রে নুয়া জামাই প্রসঙ্গে’ শীর্ষক একটি ভিডিও আপলোড করেছেন। সেখানে রামকানাই দাশের বড়বোন ও লোকসংগীতে একুশে পদকপ্রাপ্ত সুষমা দাশের একটি বক্তব্য রয়েছে। এতে সুষমা জানান, তাঁর মা ভালো শিল্পী ছিলেন। ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সে সুষমার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তিনি শ্বশুরালয়ে চলে আসেন। তাই তাঁর মা গান লিখেছেন কি না, এ বিষয়ে সঠিক বলতে পারবেন তাঁর ছোট ভাই রামকানাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও ছেলে।

বাংলাদেশ গীতিকবি সংসদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ বেতার সিলেটের গীতিকার শামসুল আলম সেলিম বলেন, ‘কয়েক শ বছরের প্রাচীন গান সুষমা দাশের মুখস্থ। নব্বই বছর বয়েসে এখনো তিনি সাবলীলভাবে কয়েক শতাধিক গান মুখস্থ গেয়ে যেতে পারেন। এ অবস্থায় তাঁর মা যদি গান লিখতেন, সেটা অবশ্যই তাঁর জানার কথা। মায়ের লেখা গান তিনি জানেন না, এটা অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য।’

‘বিদিত লাল দাস ও তাঁর দল’ সংগঠনে একসময় সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁরা। হিমাংশু বিশ্বাস, দুলাল ভৌমিক, বিদিতলাল দাস, হিমাংশু গোস্বামী, রামকানাই দাশ ও আকরামুল ইসলাম। (বাম থেকে)। ছবিটি ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে ঢাকায় তোলা। ছবি : সংগৃহীত

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা গীতিকার বুলবুল আনাম জানিয়েছেন, ১৯৭৭ সালে বিটিভিতে সিলেটের আঞ্চলিক গান নিয়ে ‘বর্ণালী’ নামে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়েছিল। গীতিআলেখ্য হিসেবে ‘নয়া-দামান’ গানটিও প্রচার হয়েছিল। প্রখ্যাত সুরকার বিদিত লাল দাসের নেতৃত্বে সিলেট থেকে অনেক শিল্পী-বাদকদের সঙ্গে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে রামকানাই দাশও ছিলেন। সে সময় গানটি সংগৃহীত হিসেবে প্রচারিত হয়।

চার ‘আইলা রে নয়া দামান’ গানটির আট ধরনের পাঠ বর্তমান লেখকের সংগ্রহে রয়েছে। সবকটি গানে ‘আইলা রে নয়া দামান আসমানেরও তেরা/বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা/দামান বও দামান বও, দামান বও দামান বও’ পঙ্ক্তিগুলো স্থায়ী হিসেবে আছে। তবে দিব্যময়ী দাশের পাঠে ‘নয়া দামান’ শব্দের বদলে ‘নুয়া জামাই’ এবং ‘তেরা’ শব্দের বদলে ‘তারা’ শব্দ রয়েছে। সবকটি গানেই স্থায়ী বাদে ৪টি অন্তরা রয়েছে। কোনো পাঠে ভণিতা না-থাকলেও দিব্যময়ী দাশের পাঠে ভণিতা আছে। এর বাইরে প্রতিটি অন্তরাতেই কোথাও না-কোথাও শব্দ এবং পঙ্ক্তির ভিন্নতা আছে।

বর্তমান লেখকের সংগ্রহে যে ৮টি পাঠ আছে, এর মধ্যে একটি পাঠ মুদ্রিত হয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জফির সেতু সম্পাদিত ‘সিলেটি বিয়ের গীত’ বইয়ে। ২০১৩ সালে ঢাকার প্রকাশনাসংস্থা শুদ্ধস্বর এ বইটি প্রকাশ করেছিল। সেখানে সংকলিত গানটি এমন-

আইলা রে নয়া দামান আসমানের তেরা। বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেড়া ॥ দামান বও দামান বও।

বও দামান কওরে কথা খাওরে বাটার পান। যাইবার লাগি চাওরে যদি কাটিয়া রাখমু কান ॥ দামান বও দামান বও।

আইলা রে দামান্দের ভাই হিজলের মুড়া। টুনকি দিলে মাটি পড়ে ষাইট-সত্তইর উড়া ॥ (টুনকি দিলে মাটিত পড়ন ষাইট বছরের বুড়া।) দামান বও দামান বও।

আইলা রে দামান্দের বইন কইবা একখান কথা। কইন্যার ভাইর চেরা দেইখা হইয়া গেলা বুবা ॥ দামান বও দামান বও।

আইলা রে দামান্দের ভাইবৌ মোটা বটর গাইল। উঠতে বইতে সময় লাগে করইন আইল তাইল। দামান বও দামান বও।

এ ছাড়া হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ জাহান আরা খাতুনের ‘সিলেটের বিয়ের গীত’ বইয়েও আরেকটি পাঠ সংকলিত হয়েছে। প্রকাশনাসংস্থা চৈতন্য প্রকাশন এ বইটি প্রকাশ করেছিল ২০১৭ সালে। সেখানে সংকলিত পাঠটি এমন-

আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা। বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা। দামান বও দামান বও ॥

বও দামান কওরে কতা খাওরে বাটার পান। যাইবার কথা কওরে যদি কাইট্যা রাখমু কান। দামান বও দামান বও ॥

আইলারে দামান্দের ভাই হিজলের মুড়া। টুনকি দিলে মাটিত পড়ে গতরের গুঁড়া। দামান বও দামান বও ॥

আইলারে দামান্দের বইন কইবা একখান কথা কইন্যার বাড়ির চেরা দেইখ্যা হইয়া গেলা বোবা। দামান বও দামান বও ॥

আইলারে দামান্দের ভাই বউ দেখতে গতরখান। উঠতে বইতে সময় লাগে পড়ন আইন-টাইন। দামান বও দামান বও ॥

একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, উপর্যুক্ত দুটি মুদ্রিত পাঠের মধ্যে নানা বৈশাদৃশ্য আছে। বিষয়বস্তু এক হলেও আঙ্গিকগত এবং শব্দগত অনেক তফাত রয়েছে। আরেকটি পাঠ পাওয়া যায় স্থপতি ও লেখক শাকুর মজিদ নির্মিত ‘বৈরাতী’ টেলিফিল্মেও। ২০০৩ সালে এ টেলিফিল্মটি নির্মিত হয়েছিল। এ তিনটি পাঠের সঙ্গে দিব্যময়ী দাশের দাবি করা পাঠে নানা শব্দের পরিবর্তন দেখা যায়। এ চারটি পাঠ ছাড়াও আরও যে চারটি পাঠ বর্তমান লেখকের সংগ্রহে আছে, সেসবের সঙ্গেও দিব্যময়ীর পাঠে তফাত আছে। তবে অবাক বিষয় হলো, দিব্যময়ীর পাঠ ছাড়া অপর সাতটি পাঠের মধ্যে বৈশাদৃশ্য অনেকটাই কম। যদিও কিছু কিছু পরিবর্তন ঠিকই আছে। দিব্যময়ীর পাঠে যেমন হাওরাঞ্চলের বেশকিছু শব্দ আছে, তেমনই অন্যান্য পাঠে সিলেট ও মৌলভীবাজারের উজান অঞ্চলের অনেক শব্দ রয়েছে। ফলে অনেকেই গানটির প্রকৃত রচয়িতা সিলেট কিংবা মৌলভীবাজারের বলেও অনুমান করছেন।

বর্তমান লেখকের সংগ্রহে থাকা আটটি পাঠের বাইরে প্রায় একই বিষয়বস্তুর আলোকে একটি পাঠ পাওয়া যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। সেখানে মুসলিম বিয়েতে গীত হয় এ গানটি। এ গানের স্থায়ী এ-রকম- ‘আইলেন গো নয়া দামাদ আশমানের তারা/বর-বরেতের আসন পাতো আমুন ধানের ন্যাড়া’। এ গানটি সংকলিত হয়েছে ২০০৪ সালে প্রকাশিত মনোয়ারা খাতুনের ‘মুসলিম বিয়ের গানে বাঙ্গালি মুসলিম সমাজ’ বইয়ে। প্রবীণ অনেকের দাবি, ‘নয়া দামান’ গানের একাধিক পাঠ পাওয়ার বিষয়টিই এ গানটিকে লোকগানের মর্যাদা দেয়। নানাভাবে নানা শিল্পী ও গীতিকার গানটির পঙ্ক্তি ও শব্দের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত হওয়ায় এ গানের প্রকৃত রচয়িতার সন্ধান পাওয়া যায় না। একেক গীতিকার তাই নিজের মতো করে প্রচলিত গানের পঙ্ক্তি ও শব্দে খানিকটা অদলবদল করে গানটিকে প্রবহমান রেখেছেন। দিব্যময়ী দাশও হয়তো এ গানের একটি পাঠের পরিমার্জিত রূপ দিয়েছেন, তাই এককভাবে তাঁকে গীতিকারের কৃতিত্ব দেওয়া অনুচিতই বটে। তবে প্রসঙ্গক্রমে বলা রাখা দরকার, বর্তমানে গানটি যে সুরে গাওয়া হচ্ছে, সেটি কিন্তু আদি সুর নয়। গানের পঙ্ক্তিতে যেমন পরিবর্তন ঘটেছে, তেমনই সুরেরও পরিবর্তন হয়েছে।

লেখার শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা আশুতোষ ভট্টাচার্যের অভিজ্ঞতা অথবা খালেদ চৌধুরীর যে বয়ান জানা গেল, সেটাও কিন্তু ‘নয়া দামান’ গানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একজনের মুখ থেকে আরেকজনের মুখে ছড়িয়ে পড়াই লোকগানের একটি বৈশিষ্ট্য। ‘নয়া দামান’ গানটিও লোকগানের চরিত্রকে ধারণ করে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে এসেছে। ফলে গানটির দু’একজন পরিমার্জনকারীর নাম জানা গেলেও কোনও গীতিকারের নাম জানা যায় না।