শিল্প ও সাহিত্য

ফলবিক্রেতা ইউসুফ থেকে ‘ট্র্যাজেডি কিং’ দিলীপ কুমার

ইংরেজিতে ‘ইপোক মেকার’ বলে একটি কথা আছে। বাংলায় ‘যুগস্রষ্টা’ শব্দটি তার আশপাশ দিয়ে যায়। যদি তাই হয়, তবে ‘দিলীপ কুমার এর জীবনাবসান হলো’ না-বলে ‘দিলীপ কুমার যুগের অবসান হলো’, এভাবে বললে কথার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। ব্যক্তি প্রতিভা প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়

ফল ব্যবসায়ী বাবা। তাঁর ছেলে অভিনেতা হবেন, এ কথা অন্তত অঙ্কে মেলে না! কিন্তু জীবন তো আর অঙ্কের ধারাপাত নয়। তাই ব্যবসা উঠি উঠি করেও এলিয়ে-কেলিয়ে গেলো। ব্যবসায়ীর মোড়ক খুলে বেরিয়ে এলেন দিলীপ কুমার।

মুম্বাইয়ের ‘প্রথম খান’ ও ‘ট্র্যাজেডি কিং’ তকমা পাওয়ার কথা নয় তাঁর। ডেভিড লিন-এর কাছ থেকে ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ ছবিতে ডাক পাওয়ার কথাও ছিলো না। অভিনেতা হবেন, এমন আগ্রহের ছিটেফোঁটাও ছিলো না দিলীপ কুমারের মনে। অথচ তাই হলো। বাবার সঙ্গে মতবিরোধের জেরে বাড়ি ছাড়লেন। ব্যবসায় হাতেখড়ি হয়েও ব্যবসায়ী হওয়াটা আর হলো না। ব্যবসায় প্রচেষ্টার প্রথম অধ্যায় অনেকটা এরকমই। পরিচিত এবং সতীর্থরা বুঝলেন, ব্যবসা আর দিলীপ কুমার ঠিক তালে মেলে না। তাঁর জন্য অন্যকিছু অপেক্ষা করছে। ও-পর্বের সেখানেই ইতি।

দিলীপ কুমারের ব্যবসার পাঠ চুকলো। পা পড়লো মুম্বাইয়ে। উর্দু ভালো জানতেন। ভালো ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারতেন। কাহিনী-চিত্রনাট্য লেখার কাজ দিয়েই হলো শুরু। তারপর অভিনয়ের ডাক এলো। অভিনয়ে উৎসাহ জোগান দিয়ে নাম বদলে দিলেন দেবিকা রানী। ইউসুফ খান হয়ে গেলেন দিলীপ কুমার। এই সময়ের খান-পরিবেষ্টিত মুম্বাইয়ের প্রথম খান তিনি।

এই উপমহাদেশে কাহিনীর বিয়োগান্ত পরিণতি সিরিয়াস বলে ধরে নেয়ার মানসিকতা প্রাচীন এবং প্রবল। এই বিয়োগব্যথা মনে রোমাঞ্চ, প্রেমের সুখানুভূতি, ভাবালুতা উসকে দিতে পুষ্টিকর ও সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ‘দেবদাস’-এর পরিণতি খুবই করুণ কিন্তু তা প্রেমসুখকর আবেগ-আবিলতায় ভরা। ট্র্যাজেডি  কিং হয়েও তাই দিলীপ কুমার উত্থান-পতনের মধ্যেও চিরবসন্তের জন্ম দিতে পেরেছিলেন মুম্বাইয়ের আনপ্রেডিক্টেবল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে, যেখানে ফুল ফোটা ও ঝরে যাওয়ার কাহিনী প্রায় একই সমান্তরালে চলে। এই অনিশ্চিত আসরে নিজের জন্য শক্তপোক্ত পরিসর নির্মাণ করে নিয়েছিলেন দিলীপ কুমার।

ইংরেজিতে ‘ইপোক মেকার’ বলে একটি কথা আছে। বাংলায় ‘যুগস্রষ্টা’ শব্দটি তার আশপাশ দিয়ে যায়। যদি তাই হয়, তবে ‘দিলীপ কুমার এর জীবনাবসান হলো’ না-বলে ‘দিলীপ কুমার যুগের অবসান হলো’, এভাবে বললে কথার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। ব্যক্তি প্রতিভা প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়; একটি কাল্ট। মতাদর্শ, পারঙ্গমতা, পরিপক্কতা, নৈপুণ্য ও প্রায়োগিক কৌশলের উৎকর্ষে নির্মিত হয় একটি ব্যাপ্তিকাল। ওই ব্যাপ্তিকালের তিনি প্রতিভা। তিনিই প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তি-মেধা প্রতিষ্ঠানকে অতিক্রম করে, তৈরি হয় পরম্পরা। সময়ের সঙ্গে তা নিয়ত প্রবহমান। পরবর্তী প্রজন্মে ওই পরম্পরার রূপ-ছায়া ধরা পড়ে।

মুম্বাইয়ের ম্যারিন প্যারেড ধরে কয়েক মুহূর্ত হাঁটার সুযোগ হয়েছিল। কিছুটা পেশাগত, কিছুটা বেড়ানোর উসিলায়। কলকাতায় বাস করে আমার এক আত্মীয়। অনেকটা নিমগ্ন হয়ে বললেন, ‘ওই যে সারি সারি বিল্ডিং, ওই যে দেখুন- ওখানে মুম্বাইয়ের তারকারা থাকে।’ আরেকটু তলিয়ে গিয়ে বললেন, ‘দিলীপ কুমারও থাকে।’ আরব সাগরের নোনা জল থেকে উঠে আসা হাওয়ার শব্দে তার শেষ কথাটি কানে পৌঁছানোর কথা নয়। তবু ঠিক কানে এলো। দিলীপ কুমার– তাঁকে অব্যয় আর বিশেষণ দিয়ে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা বাহুল্যমাত্র। তাই শুধু তাকিয়েছিলাম। কতক্ষণ জানি না। ‘চলুন এবার ফেরা যাক’- ঘোর কাটল, মনে জেগে থাকলো ওই একটি শব্দের অনুরণন- দিলীপ কুমার।

দিলীপ কুমার (১৯২২-২০২১)

অভিনয় থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন অনেক আগে। অথচ মুম্বাইয়ের অভিনয় জগতে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রলম্বিত ছায়া পড়ে আছে। মঞ্চের বাইরে থেকে তাঁর ফেলে আসা জগত শাসন করেছেন একজন আপাত অদৃশ্য শাসক। সব শাসনের আঙুল চোখে পড়ে না, তার রেখাপাত থাকে, চাইলে চোখে পড়ে। এখনও তিনি সজীব ও জেগে আছেন অসংখ্য ফ্যান বা  ভক্তকুলের মনে।

মুম্বাইয়ে বসন্তকাল নিরবধি নয়। এই আসে এই ফিরে যায়। ভাঙাগড়া, চাপানউতোর স্পষ্টত দৃশ্যমান। ‘ট্র্যাজেডি কিং’ দিলীপ কুমার বসন্তকে প্রবহমান রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও ট্র্যাজিডি আছে। অন্য কথা-কল্প বাদ দিলেও মধুবালার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালের প্রণয়ের কেচ্ছা সবার জানা। নতুন কথা নয়। হবে-হচ্ছে করেও সম্পর্ক পরিণতি পেলো না। মধুবালা জীবনে ডেকে নিলেন অন্য পুরুষ। কিন্তু দিলীপ কুমারকে ভুলতে পারেননি। ‍দিলীপ কুমারের বিয়ের সংবাদ শুনে মধুবালা ভেঙে পড়েছিলেন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মধুবালার মৃত্যু হয়। দিলীপ কুমার বিয়ে করেছিলেন অনেক পরে, ৪৪ বছর বয়সে তাঁর অর্ধেক বয়সী সায়রা বানুকে। ফ্রক-পরা কিশোরী সায়রা বানু আগে থেকেই দিলীপ কুমারের অন্ধ ভক্ত ছিলেন। শেষ শয্যায় সায়রা বানুই দিলীপ কুমারের পাশে ছিলেন। 

১৯৬২ সালে পরিচালক ডেভিড লিন ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ ছবিতে শেরিফ আলি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দিলীপ কুমারকে ডাকেন। সাড়া দেননি দিলীপ। ওই চরিত্রে পরে অভিনয় করেন মিশরের স্বনামখ্যাত অভিনেতা ওমর শরীফ। পরবর্তীকালে দিলীপ কুমার জানিয়েছেন, ওই চরিত্রের জন্য ওমর শরীফ তার চেয়ে যোগ্য অভিনেতা। এলিজাবেথ টেলর-এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দিলীপ কুমারকে নির্বাচিত করেছিলেন ব্রিটেনের পরিচালক ডেভিড লিন। ছবির নাম ‘তাজমহল’। কিন্তু কাজটি বাতিল হয়ে যায়। খ্যাতি এবং পারদর্শিতার পাশাপাশি পরিমিতি বোধও ছিল ‘ট্র্যাজেডি কিং’-এর। শুধু উচ্চাকাঙ্খা নয়, নিজের দক্ষতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্যামিতিক জরিপও জরুরি। 

৪০-এর দশকে ‘জোয়ার ভাটা’ ছবিতে প্রথম মুখ দেখান দিলীপ কুমার। ‘জোয়ার ভাটা’ (১৯৪৪) অভিনয়ের প্রশ্নে তাঁর ডেব্যু ফিল্ম। কিন্তু তাঁর অভিনয়ের মূল দশক ৫০। বলা যায় ৫০-এর দশকই তাঁর ফসলী সন। ‘হালচাল’, ‘দিদার’, ‘দাগ’, ‘পয়গাম’-এর মতো আরও সফল চলচিত্রে অভিনয় করে তিনি ‘ট্র্যাজেডি কিং’ হিসেবে পরিচিত হয়ে যান। এই ঘরানার সব ছবিগুলোই ছিল বিয়োগান্ত পরিণতির। ক্রমাগত ট্র্যাজিক চরিত্রে অভিনয় করে দিলীপ কুমার নিজেও ক্লান্ত ও বিষণ্ন হয়ে পড়েন। ডিপ্রেশনে ভোগেন, মনোবিদের দ্বারস্থ হন। মনোবিদ তাকে ট্র্যাজিক চরিত্র থেকে সরে এসে হালকা চালের ছবি বা কমিডি নির্ভর কাহিনী বেছে নিতে বলেন। এই গোত্রের ছবির মধ্যে পড়ে ‘আজাদ’, মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে। আরও একটি রোমান্টিক কাহিনী বেছে নেন তিনি– ‘কোহিনূর’; মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। রিল লাইফে ‘ট্র্যাজেডি কিং’ রিয়েল লাইফে যুদ্ধ করে বিষণ্নতা কাটিয়ে ওঠেন।

৬০-এর দশকে এসে আরেকটি মাইলফলক দেখা যায়। ঐতিহাসিক কাহিনীর বৃত্তবন্দি ছবি ‘মুঘল-ই-আজম। ভারতীয় চলচ্চিত্রে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। একটানা এগারো বছর ‘মুঘল-ই-আজম’ দর্শকেরর মনে রাজত্ব করেছে। আজও তার আবেগ ও আবেদন অপ্রতিরোধ্য। ১৯৭৫ সালে ‘শোলে’ আলোড়ন তুললেও ‘মুঘল-ই-আজম’র আবেদন একচুল নড়চড়  হয়নি। এর আবেদন স্বতন্ত্র এবং ক্লাসিক। এর কাহিনী আবতর্তিত হয় রাজসভার নর্তকী ও রাজপুত্র সেলিমের প্রণয় নিয়ে। সেলিমের ভূমিকায় অভিনয় করেন দিলীপ কুমার, রাজ-নর্তকীর ভূমিকায় মধুবালা এবং সম্রাট আকবরের ভূমিকায় পৃথ্বীরাজ কাপুর। 

অভিনয়ে তাঁর সাফল্য এবং প্রাপ্তি বিস্ময়কর। পুরস্কারপ্রাপ্তির বিচারে গিনেজ বুকে নাম ওঠে তাঁর। অসংখ্য পুরস্কারের মধ্যে তিনি আটবার ফিল্মফেয়ার বেস্ট অ্যাক্টর অ্যাওয়ার্ড পান। তিনিই প্রথম অভিনেতা যিনি ‘দাগ’ ছবির জন্য প্রথম ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। প্রচলিত ধারার পদ্ধতিগত অভিনয় বা মেথড অ্যাক্টিং-এর সম্পূর্ণ বাইরে পড়েন দিলীপ কুমার। কিছু সমালোচকের মতে অনেক সময় দিলীপ কুমারের অভিনয়কে তাঁর ব্যক্তিগত স্বভাব ও আচরণ থেকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়তো। এখানেই দিলীপ কুমার স্বকীয়, এখানেই দিলীপ কুমার অনন্য।

দিলীপ কুমারের জীবনাবসান তাই একটি ‘কাল্ট’ অথবা যুগের অবসান। আসলেই কি অবসান? যে পরম্পরা রচিত হয় একবার, তা কালের ধারায় বেঁচেবর্তে থাকে। যেমন ইতিহাস, তাতে সাদা রঙ কালো রঙ দুটোই থাকে– সময়ের পরিবর্তনে সময়ের মানুষ তার মূল্যায়ন করে। অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে তার নিজস্ব পথ নির্মাণ করে। চলার পথ নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘কাল্ট’ বা পরম্পরা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা ও সম্ভবনা দুটোই থেকে যায়।