শিল্প ও সাহিত্য

কান নিয়ে কানাকানি: অতঃপর মুখোমুখি

এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে। কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে, আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।

শামসুর রাহমান ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় এভাবে একটি প্রবচনের বিষদ বর্ণনা দিয়েছেন নতুন করে। যিনি প্রবাদটি প্রথম উচ্চারণ করেছেন তিনিও নেই, শামসুর রাহমানও নেই। কিন্তু পণ্ডশ্রমের শ্রমিকরা এখনো রয়ে গেছেন। তারা অনবরত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন, হয়তো যাবেনও।

সম্প্রতি বাঙালি নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ তাঁর চলচ্চিত্র ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব কানে। এ নিয়ে আমাদের ঢালিউডের বাজারে নানা রকম কানাকানিও চলছে। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। শুধু তাই-বা কেন, প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও একই ধরনের কানাকানি! কেউ বলছেন, সাদের চলচ্চিত্র মূল কানের অংশ না। কেউ বলছেন, সাদের এটা প্রতিযোগিতাতে নেই। অনেকে আবার বলছেন, প্রতিযোগিতাতে আছে তবে মূল প্রতিযোগিতাতে নেই! ছবির প্রদর্শন শেষ হওয়ার পরও একই ধরনের কানকথা চলছে। সেই কানকথার আলোকে অনেকে একটা জাজমেন্ট করে ফেলছেন।

আমি মনে করি, আপনাদের সামনে সামান্য কিছু তথ্য পরিবেশন করলেই বিষয়টি জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। পরিবেশিত তথ্যগুলো আপনারাও কানের ওয়েবসাইট এবং উইকিপিডিয়া থেকে মিলিয়ে নিতে পারেন।

পৃথিবীর অন্য দশটা চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে কান উৎসবের পার্থক্য হলো- এখানে একই সময়ে মূল উৎসবের পাশাপাশি বেশ কিছু ভেন্যুতে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। যেগুলো সরাসরি ফেস্টিভ্যাল দো কান বা কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল আয়োজন নয়। এই উৎসব চলাকালে কান শহরে আরও কয়েকটি সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ভেন্যুতে উৎসবের আয়োজন করে। আপনার কাছে টাকা থাকলে কয়েকটি দেশের পরিচালক, প্রযোজক, সমালোচকদের নিয়ে উৎসব চলাকালীন কান শহরে একটি হল ভাড়া নিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে পারেন। সেটা কি কান উৎসব হবে নাকি নাক উৎসব হবে সে অঙ্ক আপনিই করুন। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রটি সে ধরনের ভাড়া নেয়া ভেন্যুতে যায়নি।

মূল কান চলচ্চিত্র উৎসবকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। সবগুলো বিভাগই অফিসিয়াল সিলেকশনের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম বিভাগটির নাম হলো ইন কম্পিটিশান। এই বিভাগের দিকে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি দেয় দর্শক। কারণ, এ বিভাগেই আছে কানের সবচেয়ে বড় পুরস্কার পাম দ’র তথা স্বর্ণপাম। এই বিভাগের চলচ্চিত্রগুলোর প্রদর্শনী হয় গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে।

দ্বিতীয় বিভাগটি হলো ‘অ্যা সারটেইন রিগার্ড। এই বিভাগে থাকে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে বানানো বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি নিয়ে চলচ্চিত্রগুলো। এই বিভাগের চলচ্চিত্রগুলোর প্রদর্শনী হয় প্যালে দে ফেস্তিভাল ভবনের সাল দুবুসি থিয়েটারে। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ নির্মিত চলচ্চিত্র ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এই বিভাগেই স্থান পেয়েছে।

তৃতীয় বিভাগটি হলো ‘আউট অব কম্পিটিশান’। এই বিভাগের চলচ্চিত্রগুলোরও প্রদর্শনী হয় গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে। এই বিভাগের চলচ্চিত্রগুলো কোনো ধরনের পুরস্কার না পেলেও অফিসিয়াল সিলেকশনের কারণে বিভাগটি যে সম্মানজনক তাতে সন্দেহ নেই। এগুলো ছাড়াও কানের আরও বেশ কয়েকটি বিভাগ আছে। যেমন স্পেশাল স্ক্রিনিং, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ফিল্ম স্কুলের শিক্ষার্থীদের চলচ্চিত্র প্রভৃতি। 

উৎসব চলাকালীন আয়োজক কমিটির বাইরেও কিছু চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হয়। এগুলোতেও আছে মূল কানের মতো বেশ কিছু বিভাগ। এগুলোও কোনো অংশে মূল কানের চেয়ে কম নয়। মূল কানের বাইরে উল্লেখযোগ্য উৎসবের মধ্যে রয়েছে সিমেন দ্যু লা ক্রিতিক, ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট, তু লেস নিমাস দু মন্ড, ক্যামারা দ’র প্রভৃতি।

আজমেরী হক বাঁধন, কান চলচ্চিত্র উৎসবে

প্রয়াত তারেক মাসুদ নির্মিত ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রটি ডিরেক্টর ফোর্টনাইটে ফিপরেস্কি পুরস্কার অর্জন করে। এই উৎসবটি ১৯৬৯ সাল থেকে চালু করে অ্যাসোসিয়েশন ফর ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা অ্যান্ড ইটস ডিস্ট্রিবিউশন। কান উৎসবে অফিসিয়াল সিলেকশনের বাইরে আছে বাণিজ্যিক একটি শাখা। এ শাখায় যে কোনো দেশের পরিচালক-প্রযোজক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে তাদের চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন করতে পারবেন। আবার অনেকে কান শহরে হল ভাড়া নিয়েও চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশের কয়েকজন পরিচালক এই কাজটি করে মিডিয়াতে প্রচার করেছেন ‘কানে প্রদর্শিত হয়েছে’ বলে।

তথ্যের অভাবে আমরা এতদিন এদের মাধ্যমে ধোকা খেয়েছি। ধোকা খেতে খেতেও অনেকের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে- সাদের ছবিটি মূল উৎসবে স্থান পায়নি। অথচ চলচ্চিত্রটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা স্থান পেয়েছে, শুধু বোঝার ভুলেই আমরা অনেকে কানাকানি করছি!

একটি বিষয়ে আলোকপাত না করলেই নয়। কান উৎসবে যাওয়া মানেই সেরা চলচ্চিত্র, বিশুদ্ধ চলচ্চিত্র- এমন ভাবার কারণ নেই। কান উৎসব নিয়েও বিতর্ক হয়েছে, হচ্ছে, হবে। ১৯৬৮ সালে কান উৎসব চলাকালে ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ফরাসি চলচ্চিত্রকার জ্যঁ লুক গদার এবং ফ্রাঁসোয়া ক্রফোর নেতৃত্বে একদল তরুণ নির্মাতা মঞ্চের পর্দা ধরে ঝুলে পড়েন এবং উৎসবটি মাঝপথেই বন্ধ করে দেন। কান উৎসবে প্রতি বছর খরচ হয় ২০০ কোটি টাকা। ১০০ কোটি টাকা দেয় ফরাসি সরকার। বাকি ১০০ কোটি টাকা দেয় অফিসিয়াল পার্টনার এবং বহুজাতিক কোম্পানি। এখন যে চলচ্চিত্রকার বহুজাতিক কোম্পানির প্রপাগান্ডা নিয়ে চলচ্চিত্র বানান তিনি হয়ত কানে নাও যেতে পারেন। এমনকি অস্কারকেও বুড়ো আঙুল দেখাতে পারেন তারা। আমরা হাংরি আন্দোলনের মলয় রায় চৌধুরীকে দেখেছি কীভাবে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। জ্যঁ পল সার্ত্রেকে দেখেছি কীভাবে নোবেল প্রত্যাখ্যান করেছেন। কান, বার্লিন, অস্কার মানেই যে বিশুদ্ধ ছবি এটা বলা যাচ্ছে না। আবার এগুলো সব অশুদ্ধ- এটাও বলা যাচ্ছে না। কারণ এখানে তো কোরিয়ার মহান নির্মাতা কিম কি দুকও অংশ নিয়েছেন, আব্বাস কিয়ারোস্তামির মতো মহাত্মার চলচ্চিত্রও প্রদর্শিত হয়েছে।

কানাকানি না করে বরং আমরা নিজের মুখোমুখি হই। যাতে আমরা আরো বেশি করে আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোতে অংশ নিতে পারি কিংবা বিশ্বের পুঁজিবাদী উৎসবগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখাই অথবা সাহস সঞ্চার করি যাতে এরকম একটা উৎসব আমরাও করতে পারি। 

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সমালোচক