শিল্প ও সাহিত্য

ছোটগল্প || অনিলার হাসি

সবারই থাকে কিছু গোপন কথা। একান্ত গোপন। কখনো কাউকে বলা যায় না। থাকে গোপন দুঃখও। অনিলারও আছে। জীবনের এক গভীর ক্ষত। সায়ীদকে বলেছিল সেকথা। সায়ীদ হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। অনিলাকে সে ভালোবাসে। অনিলার জীবনে যত গভীর ক্ষতই থাকুক, ভালোবাসার কাছে তা তুচ্ছ। কী এমন ক্ষত? অনিলা আগে প্রেম করেছিল? প্রেমিকা তাকে চুমু খেয়েছিল? সেক্স করেছিল? কিংবা অনিলার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল? এসবে সায়ীদের কিচ্ছু যায়-আসে না। সব কিছুকে মেনে নিতে তার এতটুকু আপত্তি নেই। অনিলা বলেছিল, বাস্তবতা বড় রূঢ় সায়ীদ। ফ্যান্টাসি থেকে মানুষ যখন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় তখন বাস্তবতার রূঢ়তাকে মেনে নেওয়াটা অত সহজ হয় না। সায়ীদ বলেছিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি এটাই শেষ কথা। মাঝখানে আর কোনো কথা নেই, প্রশ্ন নেই।

অনিলার সঙ্গে সায়ীদের পরিচয় ফেইসবুকে। সায়ীদ তখন এস.আর গ্রুপ অব কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করেছে। একদিন অনিলার ফ্রেন্ড রিক্যুয়েস্ট পেল। প্রোফাইল লক করা। রিক্যুয়েস্ট একসেপ্ট করে অনিলার কন্টাক্ট অ্যান্ড বেসিক ইনফো চেক করল। দেখল প্রোফাইলের ছবিগুলো। ফটো অপশনে গিয়ে ছবিগুলো দেখতে দেখতে একটি ছবি দেখে সে থমকে গেল। তাকিয়ে রইল। মানুষের নাক এত সুন্দর হতে পারে! নাক নয়, যেন মোহনবাঁশি। এই বাঁশিতে মন-প্রাণ উতলা করা সুর তোলা যাবে। সে ম্যাসেঞ্জারে নক করল, হাই। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অনিলার উত্তর, হ্যালো।

ব্যস, এটুকুই। তারপর ভুলে গেল অনিলার কথা। প্রায় এক মাস পর, ডিপিএল বারের তিনতলায় বসে যখন ড্রিংক করছিল, হঠাৎ মনে পড়ে গেল অনিলাকে। ঠিক অনিলাকে নয়, তার নাকটিকে। নাকটি সে দেখতে পায় গ্লাসের রঙিন জলে। আর তখন ম্যাসেঞ্জারে অনিলাকে নক করল, হাই। প্রায় আধা ঘণ্টা পর অনিলার উত্তর, কেমন আছেন? সায়ীদ লেখে, ভালো। আপনি? আপনার নাকটি ভালো? অনিলা একটা বিস্ময়চিহ্ন পাঠাল। সায়ীদ লিখল, মানুষের নাক এমন সুন্দর হতে পারে! এমন মনভোলানো নাক কখনো দেখিনি। 

অনিলা এবার হাসির ইমো দেয়। স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে সায়ীদ। যাক, অনিলা মাইন্ড করেনি। অনিলা লেখে, আমার নাক সুন্দর এমন কথা আমি প্রথম শুনলাম। কেউ কখনো বলেনি। মুখ চোখ কপাল চুল ঠোঁট... এত কিছু থাকতে আপনার চোখ গেল কিনা আমার নাকের দিকে! হা হা হা।

সেদিনের পর থেকে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং চলতে থাকে। প্রতিদিন। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। ডিনারের পর প্রতিদিন সায়ীদই প্রথম নক করে। একদিন সে অনিলার মোবাইল নম্বর চাইল। আপত্তি করল না অনিলা, দিলো। পরদিন ছিল সায়ীদের ছুটি। ঘুম থেকে উঠেছে দেরি করে। ঘুমিয়েছেও শেষরাতে। আড়াইটা পর্যন্ত পর্নোগ্রাফি দেখেছে। দেখতে দেখতে দু-বার মাস্টারবেট করেছে। তারপর একটা তামিল সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুম। সকাল দশটার দিকে উঠে চা-বিস্কিট খেয়ে জয়দেব চ্যাটার্জির চিত্রকলার ওপর লেখা বইটি পড়ছিল। জলরঙে আঁকা পাহাড়ি তরুণীর ফিগার ড্রয়িং দেখে মনে পড়ে গেল অনিলার কথা। ফোন দিলো। কেটে দিলো অনিলা। ব্যাক করল প্রায় পনেরো মিনিট পর। হ্যালো। হ্যালো, আমি সায়ীদ। আমি অনিলা তাবাসসুম।

অনিলার ‘হ্যালো’ শব্দটি সায়ীদের এতই মধুর লাগল যে, মনে হলো যেন জোৎস্নারাতে কোনো সরোবর থেকে উঠে আসা ডাহুকের ডাক। এত মিষ্টি, এত আকর্ষণীয় কণ্ঠস্বর। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না সে। বলার মতো কথা খুঁজে না পেয়ে হুট করে জিজ্ঞেস করে বসে, আপনার বাসা কোথায়? অনিলা বলে, আমার বাসা? আমার বাসা তো মোহাম্মদপুর।  সায়ীদ জিবে কামড় দেয়। বুঝতে পারে, কথাবার্তা ছাড়া এভাবে বাসার ঠিকানা জানতে চাওয়াটা স্রেফ অভদ্রতা। বলে, স্যরি। আমি আসলে কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না, তাই এভাবে হুট করে বাসার কথা জিজ্ঞেস করে ফেলেছি। অনিলা হাসে। বলে, ইটস্ ওকে। সায়ীদ বলে, আসলে আপনাকে খুব মনে পড়ছিল। তাই! অবাক হলাম। কেন? আমাকে কারো মনে পড়ে এই কথা জেনে।  কেন, মনে কি পড়তে পারে না? পারে। কিন্তু আপনার সাথে তো আমার সেভাবে আলাপ-পরিচয় হয়নি, দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, শুধুই ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং। তাতে কি, চ্যাটিং তো হয়েছে। এখন ভার্চুয়ালের দুনিয়া। ভার্চুয়াল দেখাও তো দেখা। আমি তো আপনার টাইমলাইন আর প্রোফাইলের সব ছবি দেখেছি। সেই কভার ফটোটি, সম্ভবত সেন্টমার্টিনে, সমুদ্রের দিকে মুখ করে একটি পাথরের ওপর বসে আছেন। আপনার খোলা চুলগুলো বালি ছুঁয়েছে। আমার মনে হচ্ছিল কোনো সমুদ্রকন্যা বসে আছে। কী যে সুন্দর ছবিটা! বাব্বাহ! রীতিমতো কবির কল্পনা। কবিতা লেখেন নাকি? স্টুডেন্ট লাইফে ট্রাই করেছিলাম। লিখেছিলাম কয়েকটা। মাস্টার্সে উঠে পঞ্চকবির কবিতা পড়ে বুঝলাম, আর যাই হোক, এই জিনিস আমাকে দিয়ে হবে না। তাই বাদ দিলাম। আপার প্রিয় কবি? শঙ্খ। শঙ্খ ঘোষ। আমার কিন্তু জীবনানন্দ। জীবনান্দের কবিতায় বিষাদ বেশি। শঙ্খ বহুমাত্রিক। তার একটি কবিতা শুনবেন? হুম, শোনাতে পারেন।

সেদিনও তোমার সঙ্গে দেখা হলো গলির বাঁ-পাশে/ভালোই তো আছো মনে হলো। চোখের কোণের দাগ/চোখেও পড়েনি। তুমিও কি ক্লান্ত হও? ভাবিনি তা/তার পরে বহুদিন খুঁজেছি বাজারে পথে ঘাসে/খুঁজেছি যখন ওরা টেনে ছিঁড়ে....। ভুলে গেছি। অনেক আগের পড়া তো। অনিলা বলে, পরের লাইনগুলো হচ্ছে, যখন ওরা টেনে ছিঁড়ে আমার পালক/কপালে উলকির টানে পাড়ার তা-বে ছোঁড়ে হোম/আল্গা করে নিতে চায় ঊরু বুক মূর্ধা চোখ/ছড়ানো কবন্ধ থেকে তুবড়ি জ্বলে ওঠে অন্ধ ব্যূহে/তখনও সে-ঘূর্ণি থেকে খুঁজেছি তোমার চলাচল/আজ সব ছেড়ে এসে দেখি তুমি বাঁকানো খিলানে/কাচে ঢাকা মমি হয়ে শুয়ে আছো ছায়াজাদুঘরে- /এবারের মতো আর ছুঁয়ে দেখা হলো না তোমাকে।  বাহ! পুরোটা বলব? পুরো কবিতা মুখস্থ! হুম। গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ। আপনি তো মাঝখান থেকে পড়েলেন, আমার কিন্তু পুরো কবিতা মুখস্থ। বলেন কী! আপনি বাংলার? না, পরিসংখ্যান। কিন্তু সাহিত্য বরাবরই প্রিয়। কোন ইউনিভার্সিটি? ঢাবি? কেন, এবাউটে দেখেননি? সেখানে তো দেওয়া আছে। ওহ, মনে পড়েছে, জগন্নাথ।

অনিলার সাহিত্যরুচিবোধ দেখে সায়ীদ আরো মুগ্ধ হয়, অনিলাকে আরো ভালো লেগে যায়। সাহিত্যের প্রতি এখন তার বিশেষ আগ্রহ নেই। পড়ারও সময় পায় না। এক কালে ছিল বলেই হয়ত সাহিত্যরুচিবোধ সম্পন্ন মেয়েদের তার ভালো লাগে। যেমন লাগত সীমন্তিনীকে। কলকাতার মেয়ে সীমন্তিনী। ফেইসবুকেই পরিচয়। বিশ্বসাহিত্যের হেন লেখক নেই যার লেখা সে পড়েনি। গত বছর কলকাতায় গিয়ে গ্রীন ওয়ার্ল্ড হোটেলে তার সাথে দু-রাত কাটিয়েছে। ফিরে যোগাযোগ শিথিল করে দিয়েছে। কারণ বিছানায় সীমন্তিনী একেবারেই আনাড়ি। সাড়া দিতে জানে না। জাগাতেও না। অনিলার ছবি দেখে আর কথা বলে মনে হচ্ছে সীমন্তিনীর মতো সে আনাড়ি হবে না। একদিন ম্যাসেঞ্জারে অনিলাকে ভিডিও কল করল সায়ীদ। তখন মধ্যরাত। অনিলা রিসিভ করল। তবে ভিডিও অফ রেখে। হয়ত নাইট ড্রেস পরে আছে বলে অন করছে না, ভাবল সায়ীদ। তারা কথা বলছিল নারীবাদ নিয়ে। হালের নারীবাদ অনিলার অপছন্দ। এই নারীবাদ নারীদের মনে পুরুষবিদ্বেষ তৈরি করে। তার কাছে প্রকৃত নারীবাদী হচ্ছেন বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামাল, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ।

অনিলার কথায় সায়ীদ পুরোপুরি একমত না হলেও বিতর্কে যায় না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে সে বলে, আচ্ছা, আমাদের তো একদিন দেখা হতে পারে। তা পারে। কবে হবে? যে কোনোদিনই হতে পারে। আমি তো ফ্রি। কিন্তু আপনি যে আমার রূপের এত প্রশংসা করলেন, দেখা হওয়ার পর নিরাশ হবেন কিনা ভাবছি। আমার ধারণা আপনি ছবির চেয়ে বাস্তবে আরো বেশি সুন্দর। কিন্তু সুন্দরকে দূর থেকে দেখতে হয়, কাছে যেতে নেই। কাছে গেলে আকর্ষণ হারায়। আমি হারাবো না, বরং আরো বাড়বে। নিশ্চিত? হ্যাঁ। কীভাবে নিশ্চিত হলেন? মন বলছে। মনের কথা সবসময় সত্যি নাও হতে পারে। আমার মনের কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্যি হয়। ওকে, আমার কোনো আপত্তি নাই। আপনার কবে সময় হবে বলেন। নেক্সট সানডে হতে পারে। ওকে। সেদিন সম্ভবত আমিও ফ্রি থাকব। কোথায় আসব বলেন। আপনি কোথায় আসতে চান? আমি চলে আসব। না, আপনি বলেন। আমার বাসা তো আজিমপুরে, আপনার মোহাম্মদপুরে। মাঝামাঝি কোনো রেস্টুরেন্টে বসতে পারি। রেস্টেুরেন্টে আমার কেমন হাসফাঁস লাগে। খোলামেলা কোথাও হলে ভালো হয় না? যেমন ধরুন ধানমণ্ডি পার্ক। আমি প্রায়ই ওদিকে যাই। মন্দ না, হতে পারে।

দুজনের দেখা হলো ধানমণ্ডি পার্কে। না, সায়ীদের আকর্ষণ কমল না, বরং আরো বেড়ে গেল। সাধারণত ভার্চুয়াল ও একচুয়ালে বিস্তর ফারাক থাকে। ফেইসবুকে তো সবাই ভালো ছবিগুলোই দেয়। অনিলা ছবির চেয়ে বাস্তবে বেশি সুন্দর। সালোয়ার-কামিজ পরা, বুকে গোলাপি চাদর। লেকের ধারে নারিকেল গাছের তলার বেঞ্চটায় বসল। অনিলার গায়ের গন্ধ লাগে সায়ীদের নাকে। প্রেমের ডাক শুনতে পায় সে। মনে হয়, কেবল দৈহিক নয়, অনিলার সঙ্গে আত্মিক রিলেশনও করা যায়। অনিলার প্রতি সে টান অনুভব করে। গভীর নয়, হালকা। দুজনে পার্কের ফুড কোর্টে বসে ফুচকা খেল। খেতে খেতে সায়ীদ বলে, সত্যি আমি মুগ্ধ! আমাদের রিলেশনটা আশা করি দীর্ঘস্থায়ী হবে। অনিলা হাসে। সায়ীদ বলে, হাসছেন কেন? আপনি কি ভেঙে দিতে চান? অনিলা বলে, মানুষের মন চিরচঞ্চল, চির অস্থির। মন কেবলই বদলায়। আপনার চোখে আমি আজ সুন্দর, কাল তা নাও থাকতে পারি। সৌন্দর্য কোথায় যাবে? আপনি কি কাল বুড়ো হয়ে যাবেন? হয়ে গেলেও আপত্তি নাই, আমি বুড়িকেই ভালোবাসব। হা হা হা। সত্যি। বিশ্বাস করতে পারছি না। কেন? প্রেম কাম দুই সহোদর। দেহ ছাড়া কাম হয় না, কাম ছাড়া প্রেম হয় না। অন্তত বাস্তবে হয় না। গল্প-উপন্যাসে হতে পারে। একমত হতে পারলাম না। হবেন হবেন। আজ না হোন, কাল হবেন। কখনোই না।

আরো দুবার দেখা হলো তাদের। তৃতীয়বার দেখা হওয়ার পর সায়ীদ অনুভব করল অনিলা তাকে রাঙিয়ে দিয়েছে। বহু বছর পর, স্বপ্নার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর এই প্রথম সে রঙিন হয়ে উঠেছে। সব কিছু রঙিন মনে হচ্ছে। একেই বলে প্রেম, সে বুঝতে পারে। সে অনীলাকে কাছে পেতে অস্থির হয়ে ওঠে। দুদিন পরপরই দেখা করতে থাকে। তাতেও অস্থিরতা কাটে না। এভাবে নয়, অনিলাকে সে একান্তে পেতে চায়। শুধু হাতে হাত নয়, ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে চায়। বুকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসা আরো গভীর করতে চায়। অনিলাকে একদিন জানায় সেকথা। অনিলা হাসে। হাসির অর্থ ধরতে পারে না সায়ীদ। সেদিন অনিলাকে বলল, একদিন আমার বাসায় আসুন না। অনিলা বলে, বাসায়! পাগল! অন্যরা কী ভাববে? অন্য কেউ তো আমার বাসায় নাই। আপনি একা থাকেন? হ্যাঁ, দুই বেডরুমের বাসা নিয়ে থাকি। কাম ড্রইং-ডাইনিং। গোটা বাসা মরুভূমি। কিন্তু বাসায় গেলে তো অন্য কিছু হতে যেতে পারে। হা হা, কিছুই হবে না। আপনি পুরুষ না? পুরুষ জাতটাকে মেয়েরা বেশ ভালো করেই চেনে। পুরুষ, তবে আমি সব পুরুষের মতো না। সব পুরুষই তাই বলে। তা অবশ্য ঠিক। আসলে আপনাকে বোঝাতে পারব না, আমি শুধু আপনার দৈহিক সৌন্দর্যের পূজারি নই, মনেরও পূজারি। আপনি আমার সমস্ত সত্তাজুড়ে থাকেন। রোজ রাতে ঘুমাতে গেলেই আপনাকে মনে পড়ে। মনে হয় আপনি পাশে শুয়ে আছেন। সত্যি অনিলা, আপনাকে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসা। হা হা হা। ভালোবাসার কথা বললেই আপনি হাসেন। অবিশ^াসের হাসি। আপনার কি বিশ^াস হয় না আমি যে আপনাকে ভালোবাসি? কেন হবে না? হা হা হা। আমার বাসায় কবে যাবেন বলেন।

যাওয়ার সম্মতি দিলো অনিলা পরদিন, যখন তারা স্কাই ভিউ রেস্টুরেন্টে বসে স্যুপ খাচ্ছিল। তার হাতটি ধরে চুমু খেয়ে সায়ীদ বলল, আমার প্রাণচাঁদ আমার বাসায় যাবে, এ আমার জন্য বড় আনন্দ। সত্যি আজ আমার আনন্দের দিন। খুব ভালো ঘুম হবে আজ। আপনি যেদিন যাবেন সেদিন আমার বাসায় জ্যোৎস্না নামবে। আর আমি ভাসতে থাকব জ্যোৎস্না সরোবরে। অনিলা বলে, কবিস্বভাব কিন্তু আপনার এখনো রয়ে গেছে। সায়ীদ বলে, প্রেমে পড়লে মানুষ যে কবি হয়ে ওঠে জানেন না? সারা ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সায়ীদ। বহুদিনের অধোয়া সোফার গদির কাভার, বেডসিট, বালিশের কভারগুলো ধোয়। জানালার গ্রিলগুলো মোছে। গোটা ঘরের মেঝেটা মোছে। দেয়ালের এলোমেলো ছবিগুলো ঠিকঠাক করে রাখে। ডিপিএল বার থেকে এক বোতল স্যার পিটারসন আনে। শোকেস থেকে হুইস্কির দুটি গ্লাস নামিয়ে রাখে। অনিলা খায় না তাতে কি, খেতেও তো পারে। 

শনিবার ছিল সেদিন। দুপুরে হালকা বৃষ্টি হলো। রাস্তার ধুলোবুলি পরিষ্কার হলো। বিকেলে নিউ মার্কেট থেকে অনিলাকে নিয়ে বাসায় গেল সায়ীদ। অনিলা ঘুরে ঘুরে গোটা বাসা দেখে বলল, নারীহীন সংসার কতটা বেহাল হতে পারে এই বাসা তার দৃষ্টান্ত।  সায়ীদ বলে, আর বেশিদিন হয়ত নারীহীন থাকতে হবে না। মনের মানুষের দেখা হয়ত পেয়ে গেছি। সেই মানুষ এসে এই বেহাল সংসারের হাল ধরবে, তার হাতের ছোঁয়ায় সব কিছু সুন্দর হয়ে উঠবে।

অনিলা হাসে। ড্রইংরুমের সোফায় গিয়ে বসে। পাশের সোফায় বসল সায়ীদ। অনিলা বলল, বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, তবু বিয়ে করছেন না যে? সায়দী বলে, ওই যে বললাম মনের মানুষের দেখা পাইনি। মনের মতো মানুষ না হলে কি সংসার পাতা যায়? আত্মীয়-স্বজনের বাইরে এই প্রথম কোনো মেয়ে আমার বাসায় এলো। সত্যি? কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? কখনো প্রেম করেননি? কখনোই না। প্রেম কী জিনিস জানতামই না। আপনিই আমার জীবনের প্রথম নারী, যে আমাকে রাঙিয়ে দিয়েছে, আমার প্রেম জাগিয়ে দিয়েছে। সায়ীদ উঠে অনিলার পাশে বসল। বড় সোফা। দুজন বসার পরও মাঝখানে ফাঁকা। কিন্তু বেশিক্ষণ সেই ফাঁকা স্থানটি ফাঁকা রইল না। সায়ীদ আরো কাছে ঘেঁষল। অনিলার চুলে হাত রাখল। চুল থেকে হাত চলে গেল কপালে। কপাল থেকে গালে। গাল থেকে নাকে। নাক থেকে থুতনিতে। থুতনি থেকে হাত নামতে থাকে গলায়।  এবার সে অনিলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। কপালে আর ঠোঁটে চুমু খায়। বুকে আরো জোরে চেপে ধরে বলে, আই লাভ ইউ অনিলা, আই লাভ ইউ। তারপর অনিলাকে কোলে তুলে শুইয়ে দেয় খাটে। আর তখন অনিলা বলে, ওয়াশরুমটা কোনদিকে? একটু ফ্রেশ হবো।

ওয়াশরুম দেখিয়ে দেয় সায়ীদ। সুইচটাও অন করে দেয়। অনিলা ভেতরে ঢোকে। সায়ীদ ড্রইংরুমে এসে গ্লাসে দুই পেগ হুইস্কি ঢেলে তিন ঢোকে খেয়ে নেয়। সিগারেট ধরায়। সিগারেট অর্ধেকটা শেষ হতেই দরজার ভারী পর্দা ঠেলে অনিলা এসে দাঁড়ায়। নগ্ন অনিলাকে দেখে সায়ীদ চমকে ওঠে। না, চমকে ওঠে অনিলার নগ্নতার জন্য নয়, অনিলার ঝলসানো শরীর দেখে। বুক থেকে ঊরু পর্যন্ত ঝলসানো। এসিডে ঝলসে যাওয়া। কোনো মানবশরীর নয়, যেন কোনো চষা জমিন। ও মাই গড! সায়ীদ আর্তনাদ করে ওঠে। চট করে উঠে দাঁড়ায়। হাতের সঙ্গে লেগে টি-টেবিলের গ্লাসটি পড়ে যায়। টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। অনিলাকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে সে চলে যায় দরজার সামনে। ঝটপট হুকটা খুলে বেরিয়ে পড়ে। ধপাধপ পা ফেলে নামতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে। অনিলা হাসে। হাসে আর বলে, এবারের মতো আর ছুঁয়ে দেখা হলো না তোমাকে। হা হা হা। অনিলা হাসতে থাকে।

০২.০৩.২০২১