শিল্প ও সাহিত্য

করোনাকালে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড ও নিহা

অফিসে ঢুকেই নিহার মনে পড়লো মেলোডিকে। চলে গেছে সে এই অফিস ছেড়ে। ডাউন টাউনে নতুন একটা চাকরি পেয়েছে। ফেয়ারওয়েল দেওয়া হলো গতকাল। সে খুব সুন্দর করে সেজে এসে বসে ছিল পুরোটা সময় ফেয়ারওয়েল রুমে। অফিস ই-মেইলে উল্লেখ ছিল, যে যখন পারবে কাজের ফাঁকে যাবে ওই রুমে, তাকে পাবে উপস্থিত সেখানে।

নিহা গিয়েছিল সকালের দিকে, খুকখুক করে কাশতে কাশতে। দরজা দিয়ে উঁকি মেরে হাত নেড়ে বিদায় নিয়েছে। বিদায়ী হাগ দেয়নি। এমন কাশিওয়ালীর কাছে যাবে কে! হাসিমুখে এক টেবিল খাবারসহ মেলোডি বসে ছিল, সঙ্গে কিছু আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে সেমিনার রুমে। অফিসের যার যখন সময় হচ্ছে সে যাচ্ছে, বসছে তার সাথে, খাচ্ছে তারপরে বিদায় নিচ্ছে। কেউ কেউ গিফটও দিচ্ছে। কোন মঞ্চ নেই। ভাষণও নেই। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি নেই। সিও থেকে ডিরেক্টর, সিকিটরিটি বয় সবাই যে যার মতো আসা-যাওয়া করেছে। মেলোডিও চোখ নাক মুখ কুচকে বা হেসে বা অভিমানী ভঙ্গিমা করে একেকজনকে হাগ দিতে থাকলো। নিহা দরজা থেকেই কয়েকটা ছবি তুললো। মেলোডি দূর থেকেই তার সাথের আত্মীয়দের সাথে পরিচয় করালো। একজন তার খালা, আরেকজন তার গড মাদারের স্বামী, দুইজন ছিল প্রতিবেশী। তাদের একজনকে দেখিয়ে জানালো উনি হচ্ছেন তার ডগ এর প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গী ডগটির মালিক।

ভদ্রমহিলা হাসি খুশী। ভাবখানা করলো এই অনুষ্ঠানে আসতে পেরে বর্তে গেছে। নিহাকে দুইবার বলল, ব্রাউন গার্লস আর সো বিউটিফুল, ঐশ্বরীয়া রাই আর প্রিয়াংকা চোপড়া অবিশ্বাস্য সুন্দরী। নিহা হাসলো। ভারত প্রতিবেশী হওয়ায় ওদের সুন্দরীদের সুনামগুলো বাই ডিফল্ট তার কাছে চলে আসে। ব্রাউন বলেও আসে হয়তোবা। অফিসে এখন ভাগ্যিস কোন ভারতীয় মেয়ে নেই, তাহলে ঐ দিকে চলে যেত। জানতেও চায় না কেউ সে আদৌ ভারতীয় কিনা। ধরেই নেয় ঐ বিশাল আয়তনের ভারতের কোন অঞ্চল থেকে সে উঠে এসেছে। তবে এটা ঠিক যে ,অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। অনেকেই জানে চেনে বাংলাদেশকে। ২০ বছর আগে সমস্যা ছিল চেনাতেই, এখন চেনে জানে। মেলোডি বলামাত্র সে চিনেছে। মলে গেলে আজকাল শাড়ি পরিহিতা রমণীদের দেখা যায়। বলা উচিত আন্টিদের দেখা যায়। তবে সব সময়ই দেখেছে ভারতীয় মাসীদের। সুনিশ্চিতভাবে জানে আজ অব্দি শাড়ি পরা কোন বাংলাদেশী আন্টিকে দেখেনি। ওনারা এদেশে নেমেই হয় সালোয়ার কামিজ নতুবা শার্টপ্যান্ট পরে ঘুরেন। শুনেছে বাংলাদেশেও এখন এই চল চলছে। এই যুগের আন্টিরা অনেক স্মার্ট এবং ইয়াং। তবে এই মেলোডির আন্টি অনেক বুড়ো। ৬০ এর মতন হবে বয়স। বা আরেকটু বেশি। মেলোডির কত হবে বয়স, এই ৩৫ বা ৩৬ বা বেশি হলে ৪০ কিন্তু মেলোডি যেন কেমন ভাবে থাকে। সাজে না। ছেলে ছেলে ভাব। গা ছাড়া ভাবহাব। চুপচাপ নিজের কিউবে বসে কাজ করে যেতো এতদিন এক মনে। ছিল মাত্র দুই বছর এই অফিসে, কারও সাথে খুব একটা বন্ধুত্ব করেনি। তবে তাকে দেখলে খুব আগ্রহ করে কথা বলতো। প্রায়ই বলতো, তুমি কি পারফিউম দিয়েছো? সুন্দর গন্ধ! আরো বলতো তোমরা বাংলাদেশী মেয়েরা খুব নরম স্বভাবের হও, তাই না।

নিহাও মাথা দুলিয়ে সাথে সাথে বলতো, মোটেও না। আমরা অনেক শক্ত। আমাদের প্রধানমন্ত্রী মহিলা। অনেক বছর ধরেই আমাদের দেশ নারী শাসিত। তাই আমরা দুর্বল নই মোটেও, খুবই শক্তিশালী। বলে কয়েকবার হাতও মুঠি করে উপরের দিকে তুলেছে। মেলোডিও চোখ উপরে করেছে। তারপর বলেছে, তাই বুঝি তুমি বিয়ে করোনি? মেলোডির এমন অবান্তর কথা নিহা খুবই অবাক হয়েছিল।  বলল, এটার সাথে বিয়ের কোন সম্পর্ক নেই। পছন্দ হয়নি তাই বিয়ে করিনি, হলে করবো।  ছেলে কি তুমি পছন্দ করো! আমি কোন ছেলেকে পছন্দ করি না। আমি জানতাম। নিহা হেসে বলে, কীভাবে। মেলোডি হেসে বলে, আমি বুঝেছি তুমি ছেলে পছন্দ কর না। আমি খুশি যে তুমি ছেলে পছন্দ কর না। নিহা হেসে হেসেই বলল, ইয়েস বয়েস আর ভেরি নটি। বলেও হাসলো। আশেপাশে চেয়েও দেখলো কোন ছেলে না আবার শুনে ফেলে। কিন্তু মেলোডি বলল, ইয়েস, গার্লস শুড নট মেরী আ বয়। ওকে, হা হা নিহা হাসলো তখনো। কিন্তু তোমরা তো মুসলমান, তোমরা তো ছেলেকেই বিয়ে করবে।  হ্যা তাইতো করবো। আর কি করবো! কিন্তু তুমি তো ছেলেকে বিয়ে করতে চাও না ।

হোয়াট আর ইউ সেয়িং? নিহা এবার একটু নড়েচড়ে ওঠে, এ যাচ্ছে কোনদিকে। কয় কি হিতি, তার এক নোয়াখালির বান্ধবীর বলা কথাটা ধুস করে মুখ থেকে বের হয়ে এসেছিল প্রায়। নিশ্চিত জানে সাথে আজ নন্দিনী থাকলে নিশ্চয়ই বলতো, হিথিরে হাগলা কুত্তায় কামরায়ছে নি কনও! আই কিচ্চিরে মনা স্টাইলে চেয়ে থেকে মেলোডি বলল, তোমাদের দেশীয় কালচারেও তো মনে হয় মানে না অন্য রকম কিছু। কিন্তু তুমি তো এখন আর রক্ষণশীল কোন সমাজে নেই। তুমি এখন আমেরিকাতে, তোমার কোন কিছুতে ভয় করার দরকার নেই। তুমি যেমন, তেমন ভাবেই চলবে, ভাববে। নিজেকে প্রকাশ করবার শতভাগ অধিকার তোমার রয়েছে। ভয়ের কিছু নেই।

নিহা হতবাক ভঙ্গীতেই আবারও বলল, হোয়াট আর ইউ সেয়িং? মনে মনে বললো, ডাম-ডাম হোয়াটস রং উইথ ইউ লেডি? মেলোডি বেশ রসিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, আই হেভ নোটিশড দেট ইউ ডু নট হ্যাভ এনি বয় ফ্রেন্ড। উই আর সেম এইজ, বা কাছাকাছি হব, উই ক্যান টক। ইউ কেন টক উইথ মি এবাউট এনিডথং ডিয়ার। লেটস গো ফর এ ডিনার টু নাইট। বলতে গেলে নিহা ঘাবড়েই গিয়েছিল এইসব কথাবার্তায়। তাড়াতাড়ি বলেছে, আমার গাড়িতে কিছু সমস্যা আছে, আজ হবে না। আমি তোমাকে পিক করে নেব বাসা থেকে, চাইলে তোমার ঠিকানা দিতে পার। নিহা তাড়াতাড়ি বলল, নো নো নো, আমার আসলে আরো কিছু ব্যস্ততা আছে। অন্য কোনদিন যাব। হোয়াই নট দেন নেক্সট সেটারডে। আসছে শনিবার, কী বলো? 

নিহা বলে ফেলেই বুঝতে পেরেছিল সে ভুল করেছে। আরো শক্ত এবং গ্রহণযোগ্য কোন কারণ দেখানো উচিত ছিল। মুখের উপর এমন চাছাছোলা মিথ্যা সে বলতে পারে না। তাড়াতাড়ি বলল, আচ্ছা তোমাকে জানাবো পরে। পরে জানিয়েও দিয়েছিল যেতে পারবে না। মেলোডি তার কাছে তখনও প্রায় অচেনা। নতুন মাত্র জয়েন করেছিল। যাবার কালেও অচেনাই, কারণ মেলোডি মেশেনি কারও সাথে বা কিউ তার সাথে মেশেনি। কেন, কে জানে। সেদিনের পর থেকেই দূরত্ব বজায়ে চলেছে। চেনে না, জানে না এক কলিগ। এটা কি বাংলাদেশ নাকি যে সবাই সবার সঙ্গে লতায় পাতায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যোগাযোগ সূত্রে আবদ্ধ, কেউ না কেউ চেনে সবাইকেই। এখানে তো সব দেশের সব গোত্রের খিচুড়ী আবাস। কেউ কারও নয়। মেলোডি মনে হয় রাগ করেছিল, আর আসেনি বন্ধু হতে। দূরে দূরে সেও থেকেছে। নিহা অবশ্য অনেকবার ভেবেছিল কাউকে জিজ্ঞেস করবে মেলোডির ইতিহাস, কিন্তু কাকে কী জিজ্ঞেস করে কী বিপদে পরে কে জানে, এরকম ভাবনা থেকে আর জিজ্ঞেস করতে যায়নি। অন্য একজন এমপ্লইর পারসোনাল জীবনের বিষয়ে তার উৎসাহ হয়তো কেও ভাল চোখেও দেখবে না। জানে শুধু মেলোডি আনমেরেড বা সিংগেল। আগে কখনো বিয়ে-শাদি হয়েছিল কিনা জানে না। অন্য কেও জানলেও জানতে পারে। কিন্তু সে জানে না কে কি জানে মেলোডী সম্পর্কে। সে দূরত্বে থেকেছে। হঠাৎ মনে হলো, সে একা সিংগেল দেখে কি তাকেও নিয়ে মেলোডি অনেক কিছু ভেবেছে। হয়তোবা ভেবেছে অন্য মহাদেশ থেকে আসা নিরব মেয়েটি কেমন, একটু জানি তাকে, তার জীবনটাকে কিছুটা জানি।

হয়তোবা মেলোডি একজন লেখক, লিখবে কিছু তাকে নিয়েও। গভীর রাতে বসে ভেবেছে কি ছেলেদের সাথে দহরম মহরম রকমের মেলামেশা নেই, নাইট ক্লাবে যায় না, ড্রিঙ্ক করে না, তাহলে এই মেয়ে করেটা কি, যায় কিভাবে জীবন, কাটে কিভাবে সময়, দেখি একটু খতিয়ে, এরকম কিছু ভেবেই কি আসতে চেয়েছিল কাছে। আজ মেলোডির যাওয়ার কালে মনে হলো এতটা রুড না হলেও হতো, অত ভয় পাওয়ারও তো কিছু নেই। বাঘ তো না ঐ মেয়ে। খেয়ে তো আর ফেলতো না। সরে না এসে দেখা যেত কি সে, কেমন সে, কি চায়। সে যেমন ভাবছে মেলোডিকে কেমন কেমন যেন, তেমনই কি? নাকি সে সবটুকুই ভুল ভেবে বসে আছে। আজ বিদায়ের দিনেও তার মা আসেননি। এসেছে গড মাদারের হাসবেন্ড, খালা, নিস, কোন এক কুকুরের কারণে সঙ্গী হওয়া জনতা। কেমন যেন সব কিছু হাবিজাবি জুবু থুবু। সব কিছুই কেন যেন তার অদ্ভুত লাগছে। কেন যে লাগছে তাই বুঝতে পারছে না। মেলোডির কিউবের পাশ দিয়ে যেতেই চোখে পড়লো টেবিলে উপর এখনও পরে আছে কিছু বাক্স, গিফট বক্স, ফুল। মনে হয় গতকালকে সব নিয়ে যায়নি বা পরে এসে কেও রেখে গেছে। তাহলে কি আবারও আসবে মেলোডি ওগুলো নিয়ে যেতে। অফিসের ব্যাচ তো গতকালকেই সারেন্ডার করে রেখে যাওয়ার কথা। তাহলে তো অফিসে ঢোকার জন্য অফিস সিকিউরিটির কাছে যেতে হবে। তারপরে ওরা হয়তো ফোন করবে এই ডিপার্টমেন্টের কিউকে। কেউ গিয়ে মেলোডিকে সত্যায়িত করলে তারপর ঢুকতে পারব। আহা, গতকালকেও অবাধ ছিল এই প্রবেশ, আর আজ প্রতিহত, আহত বোধ করলো নিহা। এমনই হয়, চলে গেলে নিজের জায়গা ছেড়ে সেটা পর হয়ে যায়। চলে যায় পরের দখলে। ভাবতে ভাবতে ফিরতেই চমকে উঠলো।

ঠিক পিছনেই দাঁড়ানো মেলোডি। গলা দিয়ে উহহ্ আহহ্ জাতীয় ভয় পাওয়ার কোন শব্দও বুঝি উঠে এসেছিল। থমকে গেল। এমন ভূতের মতন দাঁড়িয়ে থাকলে কার না ভয় করে। মুখে বলল, ওহ্ তুমি, ঢুকলে কিভাবে? যেন অসাধ্য কোন কাজ করে ফেলেছে মেলোডি। মেলোডিও হেসে জবাব দিলো, হাওয়া হয়ে, ভয় পেয়েছো? নিহা বলল, না না হঠাৎ তোমাকে দেখবো ভাবিনি। তুমি কি আমাকে মিস করছিলে নিহা? না হলে আমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছো কেন?  বলেই অদ্ভুতভাবে চোখ নাচালো মেলোডি, সেই অদ্ভুত একটা অনুভব আবারও হঠাৎ এসে ছুলো তাকে। তাড়াতাড়ি বলল, না না, হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তাই। মেলোডি হাসতে হাসতে বললো, সব ডবল ডবল বলছো। তুমি দারুণ মেয়ে তো! যাবে আমার সাথে আজকে লাঞ্চ করতে। আমি ঐ জিনিসগুলো নিয়ে কিছু পরেই চলে যাব। তোমার সময় হলে যেতে পার আমাদের সাথে লাঞ্চ করতে। আজ পালাবে কীভাবে। বলবে কি কাজ আছে? কাজ সামলে যেতে পারবে না। কাশিও কমেছে কিছুটা। ঐ যে সাইদ এসেছিল সে-ই  ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।  তার মনের কথা পড়তে পেরেই যেন মেলোডি বলল, তোমার ডিরেক্টর শারলেটও তো যাচ্ছে। সক্রেটিসও যাবে বলছিল। আরো কয়েকজন যাবে বলছিল। ওরা আমাকে লাঞ্চ করাবে, ওদেরটা ওরা কিনবে। হুজ হুজ হিজ হিজ। প্লিজ প্লিজ চলো। আমারটা সবাই মিলে দেবে। তুমিও গেলে আমার জন্য ওদের ভাগে পয়সা কম পড়বে, যাবে কি ? বলে সে হাসছে।

আচ্ছা ফাঁদে পড়েছে সে। তাড়াতাড়ি বলল, না না আমার কোন অসুবিধা নেই, যাব, তোমরা যাবার সময় ডাক দিও। বলে নিহা নিজের কিউবটায় গিয়ে ঢুকলো। ধুপ করে দম ফেলল। সবাই যখন যাবে তখন আর কি। খুবই ভাল তার ডিরেক্টর শারলট, হৃদয়বতী, মায়াবতী। সে যখন যাবে তখন আর কি।  এই দেশে একা থাকবে আর কিছু ঘটে ওঠার আগেই বা বুঝে ওঠার আগেই ‘ওহ মাগো মরে গেলাম গো’ এ ধরনের এটিচিউড থাকলে তো সেই অজপাড়া গায়েই ফিরে যাওয়া উচিত। সেই বহু আগে ফেলে আসা পুরাতন স্যাঁতস্যাঁতে গ্রামীণ আঁধারে গিয়ে ঢুকে পড়লেই হয়। তারপরই হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা, আছে কি এখনও সব সেরকমই। তেমনই যেমন দেখে এসেছিল সেই ১০-১২ বছর আগে। কতদিন হয়ে গেল দেশ ছাড়া, গ্রাম ছাড়া, স্বজন ছাড়া, আপন হারা। স্বজন বলতে তো তার কেও তেমন ছিলও না। বাবা মা না থাকলে থাকেইবা কে আর। যে মামার বাড়িতে ছিল তারাও অনেকে উপরে চলে গেছেন। মেঘে মেঘে অনেক হয়েছে বেলা। মেঘালয়ে একা এখন সে। বয়স যেতে যেতে ঠেকেছে কোন এক অবেলায়, সেখানে যেন কোন রং-ই আর ধরে না। মন উদাসীন। ৩৫-৩৬ অনেক বয়স। ধুকে পড়ছে বার্ধক্যের দিকে। নিহা আপন মনেই চুপ করে বসে থাকে চেয়ারে। ভাবতে থাকে কত কি। নিজেকে নিয়ে, আসন্ন আগামী নিয়ে। নন্দিনী ঠিকই বলে- এমন যে একা একা সন্ন্যাসীর রূপ নিয়ে চলে যাচ্ছিস জীবনের পথ ধরে, শেষে তো তোকে ঐ পথ বনে তুলে দেবে। বনবাসী। সন্ন্যাসিনী। যার কেউ নেই। তাড়াতাড়ি বিয়ে কর। বকুলতলায় ফুল ফুটুক। বাচ্চা হোক। ঘর বাড়ি ভরে উঠুক। আমার রানীর একটা সঙ্গী হোক’।

আরো কত কি বলে নন্দিনী। প্রায়ই বলে, বলে চলে বকবকিয়ে। ডাক্তার নাকি বলেছে নন্দিনীকে সে এখন হাইরিস্ক পেশেন্ট। ৩৫ পার হলেই হাই রিস্ক! রানী আছে ৭ বছরের তারপরেও রিস্কি। আর সে তো বিয়ে করলে তারপর আরো দুএক বছর পরে মা হতে গেলে তো আকাশ বাতাস ফাটিয়ে মহাবিপদ সংকেত ১০ নম্বর ঘোষণা করা হবে। মনে হতেই নিহা আপন মনে হেসে ওঠে। এই রে অফিসে বসে সে এসব কি ভাবছে। তারপর নন্দিনীকে মেলোডির কথা বলার জন্য ফোনটা তুলে নিল। রিং বাজছে। নন্দিনী ফোন তুলছে না। মেয়েকে দিতে স্কুলে গেছে তো সেই সকালে। এতক্ষণে ফিরে আসবার কথা। বাংলাদেশের মতো স্কুলের সামনে বসে গল্প করার তো অবকাশ নেই এই দেশে। কেউ করেও না। সময় কই। দৌড় দৌড় দৌড়। দৌড়াতে থাক। কেবলই ঘরনী বলে যে নন্দিনীর হাতে অঢেল সময় তাও না। রাধো বাড়ো কত কি। বাগানও করে আজকাল। তার কোন এক গাছে মৌমাছি বাসা বেধেছে। মৌচাক বানিয়েছে। বিশাল আকার ধারণ করেছে। ঘরের ভেতর টেক্সান রানী আর বাহিরে মৌচাকের রানী, দুই রানীতে যে কোন সময় সংঘর্ষ হতে পারে। তাই এড়াতে সহসাই ওটা সরাতে হবে।

এজন্য কোন কোন ডিপার্টমেন্টে নন্দিনী ফোন করেছে, আরো কোথায় কি করতে হবে বা করবে তাই নিয়ে আজকাল প্রায়ই যে কোন ফোনের শুরুতে এক পেরা সমান কথা বলে সে। এখন সে নিজে অফিসে ওসব শোনার সময় নেই। নন্দিনী তা বুঝলে হয়। লাঠি একটা নিয়ে দেবে ভেঙ্গে তা না আমেরিকাতে আছে বলে যেন সবাইকে মাতাতে হবে তারপরে মধুসহ মৌমাছি বিদায় হবে। যা তা অবস্থা। আবার বলছে গত ক’দিন ধরেই যে, দেশে গেলেই প্রবাসীদের আজকাল ধরে ধরে কোয়ারেন্টাইন করছে, প্রবাসী বলে নাকি তার যে একটু ডাট টাট মারা ভাব ছিল দেশী বান্ধবীদের কাছে তা নাকি এখন উবে গেছে, মুখ থুবরে পড়েছে করোনার কারণে। ধুর ঐ মেয়ে যে কি বলে আর করে নিহা বুঝতে পারে না। গ্রামের কত গাছে কত মৌচাক নিজেই ভেঙ্গেছে লাঠির গুতায়। তার ঐ কথায় ছোট্ট রানীও এমনভাবে চেয়েছিল কয়েকদিন আগে যেন তার মায়ের প্রিয় বান্ধবীটি ভিন্ন গ্রহের মানুষ। নিহার তো আজকাল প্রায়ই মনে হয় ক্রমে একটা সময় আসবে যখন মানুষকে দেওয়া হবে বা দেখানো হবে এই এক জেনারেশন আগেও, কিভাবে কি করা হতো, জীবন যাপনের জন্য। তার জন্য হয়তো অনেকে ট্রেনিং সেন্টারও খুলে বসবে। বলবে শিখুন অর্গানিক জীবন যাপন। ফিরিয়ে দাও অরণ্য। যত্তসব!

আপাতত তাকে রক্ষা করতে তাদের টেক্সান রানী ফোন ধরেছে। বলছে, আম্মুর কলার আইডিতে তোমার নাম দেখে ফোন ধরেছি খালামনি। খুব ভালো কাজ করেছো মামনি, কিন্তু তুমি যে বাসায়। স্কুলে যাওনি? মা কই। রানী সাথে সাথে বললো, হাত ধুচ্ছে, মাম বলছে সারাক্ষণই হ্যান্ড ওয়াশ কর। আজকে স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসেছে। আজকেই আমাদের শহরে করোনা ধরা পড়েছে, আমাদের স্কুলে আসে এক ফ্যামেলিতেও করোনা ধরা পড়েছে। ওরা গিয়েছিল ক্যালিফেনিয়াতে বেড়াতে, সেখান থেকে নিয়ে এসেছে। ওদের ধরা পড়ায় স্কুল স্যানিটইজ করা হচ্ছে। আমরা তাই বাসায়। নিহা বললো, ভালো তো, তা হাত ধোয়া শেষ হয়েছে তোমার মায়ের? মা বলছে শেষ হবে না। নিহা হাসতে লাগলো। নন্দিনী হয়তো বা পুরা বাড়িটাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়েই ধুয়ে তুলবে। দেখলো, কফি হাতে এসে হাজির মেলোডি। জানতে চাইছে সরাসরি, কার সাথে কথা বলছো, কোন মেয়ে বান্ধবী কি?  নিহা একটু বিরুক্ত হলো। কি রকম কথা! করে কিউ কাউকে জিজ্ঞেস এত কম চেনাতে, তাও আবার অফিসে? বললো, ঠিক তাই, গার্ল ফ্রেন্ড। শুনেই মেলোডি ছুটে একরকম বেরিয়ে গেল। আরে এ কি!! ফুপায়ে উঠলো কি? নিহা তো অবাক, হা-ও কিছুটা।

তখনই ডিরেক্টর শারলট দরজায়, জানতে চাইলো, সে কেঁদে উঠেছে দেখলাম মনে হলো, ইজ দেয়ার এনিথিং রং? নিহা বললো মুখে, নো নো , কিন্তু যা তার মনে এলো তাতে তার পুরা শরীর ঝমঝমিয়ে কেঁপে উঠলো।

শুনতে পেলো, শারলট বলছে, চল চল রেস্টুরেন্টে চল। দেরী করছো কেন!

দুই

আমেরিকান এক রেস্টুরেন্টে ঢুকেই মেলোডি বলল, আজ আমরা আর অফিসে ফিরে যাব না। ঘুরবো ডালাসময়।  নিহা একটু বিরক্তই হলো। ফাজলামো নাকি। কাজ ফেলে ঘুরে মরবে পথে ঘাটে, এ আবার কি রকম কথা! তার নিজের বস শারলট অবশ্য সাথেই আছে। সে না ফিরলেও অসুবিধা নেই। তবে আরো যে কয়েকজন এসেছে অফিস থেকে তাদের কি হবে। ওদের সে চেহারায় চেনে কিন্তু তেমন পরিচয় নেই। বিশাল অফিসে কে কোথায় হারিয়ে থাকে কে জানে। খবর নেই সবার সকলের কাছে। ছয় জনের বসার মতো একটা টেবিলে বসেছে তারা। এসেছে যে যার গাড়িতে, লাইন ধরে পাশাপাশি রাখা গাড়িগুলো জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে। পাশেই হাইওয়ে ১২১। নম্বর দিয়ে রাস্তার নাম। ছুটে যাচ্ছে ৭০ মাইল স্পীডে গাড়ি। নিহার বস শারলট বলল, আমরা ভাগ্যবান, এখনও একসাথে বসতে পারছি এই রেস্টুরেন্টে, এরা ব্যবস্থা রেখেছে। ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ ইয়র্ক বা ওয়াশিংটন তো ইতিমধ্যেই সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে। সিয়াটেল শহরে তো শুনেছি একেবারে জনশূন্য। দোকানপাট খালি। কোথাও কেউ নেই। সবাই ঘরে ঢুকে গেছে। আমার এক বন্ধু আছে, সিয়াটলে থাকে। সে বলল, সহসাই ডালাস মুভ করে চলে আসবে। অনেকদিন থেকেই আসবে কি আসবেনা তাই করছিল, এবার চলে আসবে। আমার কাছেই থাকবে।

মেলোডি খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, কে জেনি, জেনির কথা বলছো। হ্যাঁ, সেই। করোনাতে আমাদের এই উপকারটুকু হয়েছে, সে আমাকে ছাড়া আর থাকতে চাইছে না। ভয় পেয়েছে, চারদিকে অবস্থা দেখে তার ভয় ধরে গেছে। এতদিন বলে কয়ে আনতে মানাতে পারিনি, এবার নিজেই আসছে হাসিমুখে। মেলোডি বলল, ওয়াও, লাকি ইউ।

নিহার মনে মায়া এসে ভিড় করলো। আহা কি ভালো এই শারলট, বান্ধবীর জন্য কত দরদ। তাকে কাছে এনে রাখবে। আসলে সে যে ভাবছিল এরা সবার জন্যই˙যার যার তার তার˙অতটা ওইরকম না আসলে। একটু আগেই তার মনে হয়েছিল একই জায়গায় খেতে আসবে, কিন্তু এসেছে পাঁচজন পাঁচ গাড়িতে একই অফিস থেকে, এক গাড়ি করে এলেই হতো। হতো কিন্তু তখন মনে হয়েছে এরা তো আবার ছাড়াছাড়া, যে যার মতো এসেছে, যখন খুশি চলে যাবে সেভাবে। অথচ এখন মনে হচ্ছে দরদী ডুড একে অপরের। মেলোডি অবশ্য তাকে বলেছিল তার সাথে আসতে। কিউ যাচ্ছে না কারও সঙ্গে, সেও তাই স্বাবলম্বী থেকেছে। এখন বলছে ঘুরতে যাবে ডালাস, কিভাবে ঘুরবে? পাঁচটা গাড়ি একে অপরকে ফলো করে ঘুরে বেড়াবে শহরময়! একই গান বাজাবে সবাই! কিছুদূর পরপর সান রুফ দিয়ে পতাকার মতন করে স্কার্ফ বা শাল উড়াবে। কে জানে কিভাবে কি। নিহা চার বছর হয় কাজ করেছে এই অফিসে কিন্তু সব সময়ই গেছে লাঞ্চ করতে অন্য একটি পরিচিত গ্রুপের সাথে। বস শারলেট কখনোই আসে না, আজ এসেছে। তার পাশের কিউবের সক্রেটিসও দুপুরে কাজের মাঝে খুব একটা লাঞ্চ করে না বাহিরে। আজ বলেছে আসবে। জায়গাও আছে তার জন্য। কিন্তু এখনও দেখা নেই। তার খুকখুক কাশিটা অনেক কমে গেছে। ভাগ্যিস আজই গিয়ে দেখা দিয়ে এসেছে ডাক্তারকে। যাওয়া মাত্রই ডাক্তার এসটিরয়েড ইনজেকশন দিয়েছে। সে অনুভব করছে আসলেই ভালো বোধ করছে। এখন একটা ইননোসেন্ট খুকখাক আওয়াজ দিলেও মানুষ চমকে তাকায়, ভাবখানা আরে এ তো যমের বন্ধু হয়ে গেছে, কাশি দিলে তো মনে হয় ছুটে পালাবে। 

রেস্টুরেন্টে ঢোকার মুখেই ছিল হ্যান্ড সেনিটাইজারের বিশাল বিশাল জারগুলো। ভালো করে হাত কচলে ধুয়ে যেন ভেতরে ঢোকালো তাদের সব কয়জনকে। সেল ফোনও ধুলো মেলোডি ঐ হ্যান্ড সেনিটাইজার দিয়ে। শারলট বলল, আমি তো হ্যান্ড সেক করা একদম বন্ধ করে দিয়েছি। তারপরও হাত জীবাণুমুক্ত করার সব সুযোগ গ্রহণ করি সানন্দে। মেলোডি সাথে সাথে জানতে চাইলো, আর কিস? নিহা একটু অবাক হলো। ৪৫/৪৬ বছরের বসকে এ কেমন প্রশ্ন। না হয় মেলোডি চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাই বলে এমন প্রশ্ন! মনে হয় এমন প্রশ্ন করতেই পারে এদের কালচারে। তার সাথে তাই যেন খাপ খায় না এরা। পড়তে এসেছিল সেই দশ বছর আগে অথচ আজও সে দূরের কেউ। শারলটও সাথে সাথে বলল, ওহ, নো, নেভার। একা থাকি। দোকা আসুক তখন জানাবো তোমাদের। ইস, এই এত বছরের বুড়ীর কিস খাওয়ার কত শখ। হঠাৎ মেলোডি বলল, নিহা তুমি কি কাউকে গত ১৫ দিনে কিস দিয়েছো। নিহা থতমত খেয়ে অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলল, আমি এই জীবনেই দেইনি। আমি অবিবাহিতা। ৩৫ বছরেও আমি তোমার মতই অবিবাহিতা। শারলট চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো, বললো তাই বলে কিউকে কিস দেবে না! আমি নিজে কোন বিবাহিতা! থ্রো আউট মাই লাইফ আই এম সিংগ্যাল। থ্রো আউট। পুরা জীবন বিয়ে করিনি। ভুল করেছি স্পাম এগ কিনে ফারটাইল করে বাচ্চা না নিয়ে। আমার তা করা উচিত ছিল। সেরোগেট মামও পাওয়া যেত। নিহা মনে মনে ভাবলো শারলটটা তো ভেতরে ভেতরে অনেক রংবাজ। মেলোডিও চোখ বড় করেছিল তার দিকে চেয়ে। এতক্ষণে মনে হয় নরমাল হয়েছে সে, স্বাভাবিক হয়েছে চোখের চাহনি। তবে সেও বলল, কীভাবে পারলে এমন সন্ন্যাস জীবন যাপন করতে।

নিহা বলল, এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই আমাদের মনোজগত গড়ে উঠেছে। মেলোডি বলল, তোমাকে আমি যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। তুমি আমার কাছে অনেক দুর্বোধ্য। নট রিডাবেল। অন্য দুজনের একজন চীনা মহিলা। সে এসেই বাথরুমে গেছে। রেষ্ট রুমের থেকে এতক্ষণে ফিরলো। অপর জন দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে যেন কার সাথে। এ মেক্সিকান, পুরুষ। নাম কারলোস। চীনা মহিলাটির নাম বললো লিয়ান, সে সিকিউরিটি ইঞ্জিনিয়ার। এসেই বলল, আমার পাশ দিয়েও এখন কেউ হাঁটে না। ছিটকে দূরে চলে যায়। যেন আমিই উহান। এক মিনিট চুপ থেকেই অট্টহাসি দিল। তারপর হাসতে হাসতেই বলল, এটা আসলে বানানো কথা। এই বানানো কথাটা বললেই তোমাদের চেহারায় আমার জন্য মায়া ফুটে ওঠে। সেটাই আমি দেখতে চাইছিলাম। ক’দিন আগে আমি চুপচাপ অফিসের বাগানের পাশে যে বেঞ্চটা আছে সেই বেঞ্চটাতে বসে সিগারেট ফুকছিলাম তখন ঐ মেলোডি এসে বলল, তুমি এমন মন খারাপ করে আছো কেন? আমি বা আমরা কেও ভাবছি না যে তুমি চাইনিজ তুমিই অপরাধী, তুমি তো বহু বছর ধরে এখন একজন আমেরিকান। একজন নীতিবান নিষ্ঠাবান আমেরিকান কখনোই ওরকম ভাববে না তোমাকে নিয়ে। 

লিয়ান হেসে বলল, আমি ভাবলাম মেলোডি আমাকে বলছে নীতিবান। কিন্তু শেষ করলো সব নিষ্ঠা নিজের দিকে নিয়ে। সেই থেকে আমি বুঝলাম, ও খুব মজার মেয়ে। তাই না নিহা। নিহা তো অবাক, তাকে বলছে কেন আবার তাকে যেন ভালই চেনে।

ওদিকে কারলোস বিরক্ত বিরক্ত ভঙ্গী করে বলল, দেখ তো আমার পার্টনারের এখনও দেখা নেই। কতবার বললাম একসাথে এক গাড়িতে আসি, সে রাজি হলো না। আচ্ছা তোমরাই বল টু ডে অথবা টুমোরো সবাই তো জানবেই আমরা কাপল। কত বড় কপাল করে যে এসেছে আমার সাথী হতে তাই বুঝলো না। ওর যে কিসের এত ভয় বুঝতে পারি না। আগে জানলে এই ভীতু বুড়ালোকের সাথে বিয়ে বসতাম না। সেই কোথায়  লাসভেগাসে পালিয়ে গিয়ে একে বিয়ে করেছি। অথচ এত বছর হয়ে গেল এখনও সংকোচ। সবার সামনে আমাকে আনতেই যেন চায় না। বলেই কার্লোস হাত পা নেড়ে অদ্ভুত একটি মেয়েলী ভঙ্গীমা করলো। তারপর বললো, সক্রেটিস আরেকটু স্মাট হতে পারতো, বলেই সে প্রচন্ড অভিমানী এক ভঙ্গীমা দিল। যেন সক্রেটিসের অদেখায় সে মরে যাচ্ছে।

কিন্তু নিহার মনে হলো সে মরে যাচ্ছে। সক্রেটিস! সে!! কবে। কখন, কিভাবে, কোথায় এর শুরু হয়েছিল। কত কি ভেবে সে প্রচন্ড এক চক্করের মধ্যে পড়লো। গোলক ধাঁধা যেন। এতদিন ধরে চেনে সে সক্রেটিসকে। তার চৌদ্দ পুরুষের গল্প শুনেছে কত। বউয়ের গল্প করেছে কত। তাহলে কি বউ চলে গেছে। নাকি বউ মানে কি এই কারলোস? কি জানি কি বলছে এরা। কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়ে না আবার বেয়াকুব বান যায়। সে হয়তো যা ভাবছে ওরা হয়তোবা তা বলছেই না। এটা কি কোন ধরনের ফান চলছে। মেলোডি তাকে বলল, দেখেছো, কি সুন্দর রোদ উঠেছে বাহিরে।

লিয়ান তাই দেখে বলল, আমার পাটনার তো গত তিনদিন ধরে গ্যারাজের বাহিরে গাড়ি রেখে, গাড়িতে রোদ পোহাচ্ছে। সান বাথ নাকি যে কোনো ভাইরাসের জন্য ভালো। তাই একটা দুপিস বিকিনি পরে রোদে শুয়ে থাকছে গেল তিনদিন ধরে। থাকে খায় তো আমার উপর, চাকুরিও করে না। আরামে আছে। বলে সে আমাদের ঠাকুরমাদের মতন আমার ঘরনী হয়ে থাকবে। শুধু সংসার করবে।

নিহা চমকে উঠে আবারও। বুঝতে পারে শিরশির করে শির দাড়ায় যেন ঠান্ডা ঠান্ডা তীর ছুটে যাচ্ছে। কেমন করে যেন মনেই হচ্ছিল একটা কিছু অন্যরকম চলছে এখানে। মেলোডির দিকে চেয়ে হঠাৎ যেন বুকটা ভয়ে ধুক ধুক করে উঠলো। মেলোডি যেন গভীর আবেগ নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। যেমন ভাবে তাকায় কোন যুগলের একজন আরেকজনের দিকে, সেরকম করে এ তার দিকে চেয়ে আছে কেন। মনে হচ্ছে এখনই উঠে এসে বলবে চল নাচি আমরা দুজনে ভালবেসে। মেলোডি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মেনুতে খাবার অর্ডার করতে ব্যস্ত হলো।

না তাকাচ্ছে মেলোডির দিকে, না লিয়ানের দিকে, না কার্লোস দিকে। হঠাৎ মনে হলো শারলটের যে বান্ধবী আসবে সিয়াটল থেকে সে আসলে কে? বান্ধবী না অন্য কোনো সম্পর্ক। আড়চোখে একবার তাকায় শারলটের দিকে। পুরাপুরি না চেয়েই চোখ সরিয়ে নেয়। মনে হলো সে যার দিকেই চাইবে সে বুঝে যাবে তার অস্বস্তি। বুঝবে যে সে এদের ভেতরকার জীবন যাত্রার পরিচয় পেয়ে চমকে উঠেছে। এই দেশে সব ধরনের স্বাধীনতা আছে। সে অন্যের দিকে এতটুকুও অশ্রদ্ধা বা বিদ্রূপ নিয়ে তাকাতে পারে না। এরা এডাল্ট। ওরা কার সাথে শুবে এটা তার ব্যাপার। সবই স্বীকৃত। লিয়ান খুব গল্পে মেতেছে মেলোডির সাথে। মেলোডি তার নিঃসঙ্গ জীবনের বয়ান দিচ্ছে। কতদিন ধরে খুঁজছে মনের মতো সঙ্গী। সাথী হারা পাখী নিহার এটেনশনের জন্য হাহাকার করা জীবন কাহিনী বলতে লাগলো। নিহার কানে কিছুই ঢুকছে না। মাথাটা বার বার ঘুরছে, চোখে ঝাপসা লাগছে। ডাক্তার তো যেতেই তাকে এসটরয়েড ইনজেকশান দিয়েছিল।

এটাই কি তার ফল। চারদিক বেশ ঘোলাটে মনে হচ্ছে। আসলে এটা কি কোন গে বা লেসবিয়ান ক্লাব। জিপিএস এ ঠিকানা দিয়ে চলে এসেছে। ঠিকানাটা আছে যেহেতু বাসায় ফিরে রাতেই দেখবে এটা কেমন ধরনের ক্লাব। আসে পাশে তো দেখছে দুটো মেয়ে বা দুটো ছেলে বা মেয়ে, অনেক রকম ভাবে অনেক জন বসে আছে। বাহির থেকে দেখে কাকে সে কি বুঝবে। ভেবেছিল, তার ডাইরেক্টর যখন আছে তখন অচেনা কিছু  মানুষের সাথে খেতে যাওয়ায় অত ভাবনার কিছু নেই। শারলটকে সে খুবই ভরসা করে এসেছে এতদিন। অনেকদিন যদিও না ,তারপরও, বেশ কিছুদিন হয় সে তার বস হয়ে এসেছে হেড অফিস থেকে। সেই নিউ ইয়র্ক থেকে ডালাস বদলী হয়েছে। নিউ ইয়র্কের গ্যানজাম নাকি তার অপছন্দ। ডালাস আসবার পর থেকে খুব খুশি। বিশাল এক বাড়িতে প্রথমে উঠেছিল। পরে এ্যাপার্টমেন্টে চলে গেছে। একা একা কি করবে অতবড় বাড়িতে। এতদিন নিহা ভেবেছে ,আহারে এত ভাল মানুষটা কি একা একজন মানুষ। আবার কোন বয়ফ্রেন্ডও নেই। নিহা নিজেও একা,  মাঝে মাঝে রুমে ডেকে নিয়ে এটা ওটা সুখ দুঃখের আলাপ করে শারলেট তার সাথে, তার সেটাও ভালো লেগেছে। 

শারলেট কার্লোসকে জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের দেশে করোনার খবর কি? কার্লোস সাথে সাথে বলল, আমি এখন আমেরিকান, মেক্সিকোর খবর জানি না। শারলট হেসে বলল, আমি তো তোমাকে মেক্সিকোর নাম বলি নি। তুমি আমাকে আমেরিকার খবরই দাও, যদি আরিজোনায় তোমার আগের আবাস হয় তবে তাই বল। কার্লোস কিছু না বলে বিরহকাল উদযাপনে যেন ব্রত হলো। বললো, আমার মন ভালো নেই। সে আমাকে কষ্টে রেখেছে। আমাকে কষ্টে রেখে সে-ও-তো কষ্টে থাকে। তারপরও সে কেন এমন করে , বলতে পার তোমরা। নিহার মনে হলো এমন বাংলা ছবির ডায়ালগ সে নিতে পারছে না। তাড়াতাড়ি বলা শুরু করলো তার নিজের দেশের কথা। বলল, আমরা ফাইটার। আমরা দুর্দান্ত একটা যুদ্ধ করবো করোনার সাথে।  শারলট খুশী হয়ে বলল, দ্যাট ইজ দি স্পিরিট। বাংলাদেশীরা আসলেই বীরের জাতি। নিহাও বলল, ইয়েস ইনডিড। 

নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে সে নিজেই নিজেকে ঠিক রাখতে ফাইট দিচ্ছে। তারপরও হেসে আরো বলল, আমাদের দেশের অনেক এলাকাতে এখন অনেক থমথমে ভাব, হাতাহাতি মারামারি দাওয়াত,বিয়ে সব বন্ধ,  সবাই ভয়ে আছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। ট্রাফিক জ্যাম কম। মিছিল মিটিং শব্দগুলো শোনা যাচ্ছে না। বলছে সবাই ঘরে থাকতে থাকতে বউয়ের সাথে প্রেম হয়ে যাচ্ছে আর গার্লফেন্ড দূরে চলে যাচ্ছে, দেখাই তো হচ্ছে না।বলে হাসলো। একটু হাসা তার বড় দরকার ছিল। হেসে আরো বললো তবে জন্মহার ড্রপ করবে না বাড়বে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বাড়ছে। এদিকে এখানে ডালাসের বাসাগুলো খাদ্য গুদামে পরিণত হচ্ছে। গেরাজগুলোতে খাদ্যের আড়ত। আর গাড়িগুলো সব বাহিরে সোজা রোদের নিচে। স্বজনেরা খবর নিচ্ছে হরদম। বলে আরো হাসলো। বেশ স্বাভাবিক থাকার ভাব করতে পেরেছে ভেবে খুশী হলো। লিয়ান বলল, আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা করোনার ভয়ে যোগাযোগ কম রাখছে আমার সাথে। যেন ফোনের ভেতর দিয়ে ওরা আমাকে বা আমি ওদের ভাইরাস দিয়ে দেব। আমার পাটনারের মা গতকাল ফোনে ওর সাথে খুব কেদেছে। বলেছে সমকামী বলেই তার করোনা হবার সম্ভাবনা আছে খুব। কার্লোস বিরহের বৃন্দাবন ছেড়ে গর্জে উঠলো, হোয়াট এ ননসেন্স!

লিয়ান হাসতে হাসতে বলল, ইয়েস, আমার যখনই কিছু খারাপ হয় তখনই আমার বোন বলে সমকামী বলেই আমার উপরে গজব পড়েছে। একটা মাত্র ভাই ছিল আমার, তুমি তাও ধ্বংস করে দিলে। নিহার মুখ ফসকে বের হয়েই গেল, তুমি ছেলে ছিলে! হ্যাঁ, তাই তো, তুমি জান না। না তো। বলেনি কেউ কখনো। অবশ্য তোমার সাথে আমার পরিচয়ই তো সেরকম ভাবে ছিল না। নিহা খুবই চেষ্টা করলো এমনভাবে কথা বলতে যেন এটা তেমন কোন ব্যাপারও না খবরও না। লিয়ান  নিজেই বলল, আমি যখন প্রথম কাজে ঢুকি তখন তো ছেলে ছিলাম। তারপর কত কি হলো। সে এক বিশাল গল্প। সার্জারি করতে হয়েছে। ডির্ভোস হয়ে গেছে। ছেলে থাকেও না আমার কাছে। হঠাৎ যদি দেখে বাবা মা হয়ে গেছে বা যাচ্ছে কার পছন্দ হবে। ওদের থেকে দূরে চলে যেতে একবার ওয়াশিংটনে চলে গিয়েছিলাম তারপর আবার নিউ ইয়র্কে তারপরে এই ডালাসে। আমি যা তাই হয়েই বাঁচতে চাই। আমার ভেতরটা মেয়ের। পোষাকটা ছিল ছেলের। আমি তাই খুলে ফেলেছি। ছেলে হয়ে জন্মেও আমার সব ভালোলাগা ছিল মেয়েদের মতন।  কার্লোস এবার হি হি করে হেসে বলল, অফিস চার্টে প্রথম প্রথম যখন হি বলে সম্বোধন করতাম তখন আমাকে এই বস শারলেট-ই আমাকে আলাদা চ্যাটে ইনভাইট করে বলেছে, ওকে সি বলবে। ও আর হি নেই। বলেই কার্লোস আবার লিয়ানের দিকে চেয়ে হি হি করে হাসতে লাগল।

নিহা জিজ্ঞেস করে বসলো, আর ইউ রিয়েলী হ্যাপী নাউ লিয়ান! অবশ্যই, অবশ্যই। যা অবধারিত আমি তাকেই হাসিমুখে গ্রহণ করেছি। ছেলে সেজে থাকলে আমার মনে হচ্ছিল আমি নিজেকে অপমান করছি। আমি যা নই তাই করে সবাইকে ফাকি দিচ্ছি। যাই হোক, দেরি করে হলেও আমি আলমীরাতে লুকানো সত্যটা হাতে নিয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছি। আমি হ্যাপী।

নিহা তার এত দিনের প্রিয় শারলেটকে কিছু জিজ্ঞেস করতে তার দিকে চাইতেই সে বললো, কথা হচ্ছে এখন তুমি কি খুশি আমার আর আমাদের পরিচয় পেয়ে। আমি সব সময় বুঝতে পারতাম তুমি আমাকে পছন্দ কর। নিহা তাড়াতাড়ি বলল, শারলট তুমি আমার পছন্দের মানুষ। আর বাকি যা কিছু বললে সেটা তোমার তোমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তোমার জীবন নিয়ে তুমি কি করবে সেটা তোমার নিজস্ব ভাবনা। শারলট বলল, এরকম কিছুই আমি তোমার থেকে শুনতে পাব ভাবছিলাম। থ্যাংকস টু ইউ। নিহা জানে সে যা বলছে শুধু সেটুকুই ভাবছে। বেশি কিছু এদিক ওদিক ভাববার অবকাশ নেই। কোন মতে কাওকে আঘাত না দিয়ে অপমানিত না করে এই পথ দিয়ে বের হয়ে যাওয়াই তার আদর্শ। মেলোডি বলছে, নিহা তুমি এত সুন্দর একটা মেয়ে। কি যে ভাল লাগে আমার তোমাকে। তোমার নিঃসঙ্গতা আমাকে পীড়া দেয়। তুমি আমাদের সাথে সব সময়  কাটাতে পার। চাইলে আমার এ্যাপাটমেন্টে মুভ করে চলে আসতে পার।

নিহা হাসফাস করে বলে উঠলো, আমি নিঃসঙ্গ নই। আমার সঙ্গী আছে। আমি তোমাদের মতন নই। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে, সাইদ। তার বলাতেই এত ভীতি ছিল যে সে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। সাইদ এর কথাই বা জান বাচাতে যেন বলে বসলো। সাইদ কি তার বয়ফ্রেন্ড? সাইদ তো নিজেই জানে না তা, সেও জানে না। হ্যাঁ, সেও জানে না শিউর। তারপরও ঐ নামটাতেই যেন সে একরকম জোর আর শক্তি ফিরে পেল। ভাবলো, আজই সাইদকে জানাবে সে তাকে বিয়ে করতে রাজী, অনেক দিন তো হয় সে ঘুরছে তার আগে পিছে। এবার বিয়ে করে ফেলবে। বলল, আমি আসলে একটু কম মিশি সবার সঙ্গে। কম আউট গোয়িং। বলল বটে, তবে মেলোডির রিঅ্যাকশন দেখতে একবারও চাইলো না মেলোডির দিকে। এ তো চলেই গেছে অফিস ছেড়ে আর পাবেও না দেখতে। যাক যাক, বিদায় হয়েছে, বেচেছে সে। শারলট তাড়াতাড়ি বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে, ওরাও ভেবেছিল তুমি বুঝি আমাদের মতন। ছেলেদের সঙ্গী হিসেবে অপছন্দ কর। মেলোডিও একা। তাই সে ভেবেছিল তোমার সাথে জুটি বাঁধবে।

খাবার দিয়ে গেছে টেবিলে। কিন্তু নিহার গলায় বুঝি খাবার আটকে যাচ্ছে। তারপরও মুখে হাসি টেনে খুব মজার কিছু শুনছে ভাব করে বলবো, ওহ, তাই ভাল ভাল, খুব ভাল। বাট আই এ্যাম সো সরি মেলোডি। শ্যারলেট বলল, তুমি ধর্মীয় কারণে আবার বাংলাদেশের রক্ষণশীল পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেয়ে বলে, তুমি  নিজে যা, তা প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছো এই ধারণা করে, আমরা তো তোমার বন্ধু তাই ভাবলাম সাহায্য করি। এখন নতুন পৃথিবী। নিহাও বলল, হ্যাঁ, সো সুইট অফ ইউ, থাংকস, এন্ড ইয়েস, আমি সব মানুষের সমানাধিকার মানি। জানি এই পৃথিবী বদলাচ্ছে। বদলাতে বদলাতে একদিন ধ্বংসও হয়ে যাবে। বলে হাসলো যেন মজা করলো।

শারলট বলল, আমারও মনে হয়েছে অনেক সময়ই এই পৃথিবী শেষ হয়ে যাক। নিজেকেও মনে হয়েছে বহুবার একজন ধসে যাওয়া মানুষ। আমার জীবনটা খুব দুঃখের। এই আমেরিকায় জন্মেছি বলে ভেব না মা বাবা মেনে নেবে তাদের ছেলেটি একটি মেয়ের মতন জীবন যাপন করবে। মেলোডিও বললো, আমার মাও আমার সাথে যোগাযোগ রাখে না, যাই হোক, হোয়াটেভার। 

শারলট বলল, আজকের দিনে জন্মালে কি হতো জানি না। কিন্তু আমি জন্মেছি আরো বহু বছর আগে। হাতের নখে যে নেইল পালিশ দিতাম তা মেরে কেটে রক্তে লাল করে দিয়েছিল আমার বাবা। তারপর একদিন সত্যিই ৯১১ এ ফোন দিলাম আমি, সেই কত আগে। তারপর ওরা ফস্টার ফ্যামেলিতে নিয়ে গেল। সেটাও কষ্টকর। বাসা মিস করতাম। বাবা মাকে মিস করতাম। ওরা তখন খুব বিরক্ত আমার উপর। আমার জন্য পুলিশ জেল কত কি সামলাতে হয়েছে। আমি না চাইলেও তারা দূরেই চলে গেল। আমিও। তবে এখনও মাঝে মাঝে ওদের বাসার চারদিকে গাড়িতে চক্কর দিয়ে আসি একা। কেউ জানে না, আমি একা একা ঘুরে আসি। আমাকে দেখলেও এই এত বছর পর ওরা আমাকে আর চিনবে না। সাজ চেহারা মেকআপ পোষাক সবই বদলে গেছে, তাদেরইবা কি দোষ! জানবে কিভাবে দরজায় দাঁড়ানো মেয়েটি তাদেরই ছেলে? শারলট হঠাৎ নিজের গল্প থামায়ে নিহাকে বলল, নিহা তোমাকে খুব নারভাস দেখাচ্ছে। তুমি কি জানতে না আমার ব্যাপারে কিছুই। আজই জানছো? নিহা তাড়াতাড়ি বলল, না না আমিও বুঝতে পারছি কিছুটা নারভাস দেখাচ্ছে। আসলে হঠাৎ সব জানলাম তো, তাই হয়তোবা হতবাক হয়ে গেছি। হঠাৎ কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না হয়তোবা তাই তোমরাও অবাক হয়েছো আমার আচরনে। 

মেলোডি হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তুমি ভটকে গেছো। চল ভদকা গিলি। ওহ তাই, হা হা কি বল, না না তা না,অতটা না। ওমন মনে হলে আই আম সরি। ভেরী সরি। মরি লাজে। শারলেট বলল, ও ঐ-ই সব গেলে না মেলোডি, এটাও না জেনে ওর পিছনে ঘুরছো। আর নিহা, সরি বলার কিছু নেই। আমাদেরই আগে আরো ভাল করে বুঝে নেওয়া দরকার ছিল। ঐ মেলোডি এমন ভন ভন করতে লাগলো যে সে একদম শিউর তোমার ব্যাপারে। তুমি কোন ছেলের সাথে ঘুরো না। তোমার সব মেয়ে বন্ধু ইত্যাদি আরো কত কি বের করেছে সে। ফেইস বুকেও ফলো করেছে। বুঝাই যাচ্ছে সে আসলে কিছু ঠিক ভাবে জানে না। নিহা অবাক হয়ে মেলোডির দিকে চাইলো, মেলোডি সাথে সাথে জিভ কাটলো। মুখে বললোও, শেইম ওন মি। বাজে ডিটেকটিভ। নিজেও সে জানে না তার অজান্তে তাকে নিয়ে কত গবেষণা চলেছে। নিহা অবাক হয়।

শারলট হেসে বলল, আমরা কিন্তু মানুষ ভাল। নিহা বললো, সে তো আমি জানিই, তোমরা ভাল মানুষ। বলে হাসলো। তোমাদের দেশের কেও আছে আমাদের মতন, থাকলে পরিচয় করিয়ে দিও।  অবশ্যই দেব। কিন্তু আমি আসলে জানি না। চিনি না কাওকে। আমাদের দেশের মানুষেরা গোপন করে এধরনের সত্যগুলোকে। কার্লোস চেঁচিয়ে কেদে উঠে বলে, সক্রেটিসের মতন? এটা কি উচিত? নিহা জবাব দেয় না।  দেখলো, কার্লোস কাদছে সক্রেটিস না আসায়। এর চোখেও আছে এক দিঘি জল।