শিল্প ও সাহিত্য

পুরুষশাসিত সমাজে তাচ্ছিল্যপূর্ণ উচ্চারণ ‘নারী লেখক’ ‘মেয়েলি লেখা’

কবির স্ত্রীলিঙ্গ ‘মহিলা কবি’ ব্যাকরণসিদ্ধ হলেও সাহিত্য আসর বা ঘরোয়া আড্ডায় ‘মেয়েলি লেখা’ বাক্যটি শোনা যায়। ‘নারী লেখক’ কথাটিও অনেকে বলেন। কখনও লৈঙ্গিক পরিচয় আলাদা করার জন্য,  কখনও লেখার দুর্বলতা বোঝানোর জন্য বক্তা এভাবে বলেন। আবার অনেক সময় লেখার শক্তিমত্তা বোঝাতে বলা হয়ে থাকে ‘আপনি নারী হলেও আপনার লেখা পড়ে বোঝার উপায় নেই যে এটা কোনো নারীর লেখা’।

কোথায় এ ধরনের বাক্যের উৎস, কেন বলা হয়, লেখকেরা বিষয়টি কীভাবে গ্রহণ করেন প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে কয়েকজন খ্যাতিমান লেখকের মুখোমুখি হওয়া যাক।  ‘কখনো নারীদের জন্য সংরক্ষিত সাহিত্য পাতায় লিখেছেন?’ প্রশ্নের জবাবে লেখক, ঔপন্যাসিক এবং সাহিত্য সম্পাদক নাসরীন জাহান বলেন, ‘আমি একেবারেই ব্যতিক্রম। তখন প্রত্যেক সাময়িকীর সাহিত্য পাতার সঙ্গে নারীদের রচিত সাহিত্য ছাপা হয় এমন পাতা থাততো। সম্পাদকেরা সেখানে লেখা দিতে বলতেন। আমি বলতাম, মরলেও সেই পাতায় লেখা দেব না। অনেক বছর পর একটা লেখা ছাপা হলেও সাময়িকীতেই লেখা দেব। ক্রমে ক্রমে সব সাময়িকীতে লেখা ছাপা হতে শুরু হলো। নারী বলে ন্যূনতম অগ্রাহ্য কেউ করেনি, তবে প্রচুর শুনতে হতো- আপনার লেখা যে কোনো নারীর লেখা, একেবারেই বোঝা যায় না (হা হা হা)।’

আরেক গল্পকার ও ঔপন্যাসিক পাপড়ি রহমান বলেন, ‘‘সবকিছুতে ‘ঊন’ ব্যাপারটা থেকেই যায়। নারী লেখক বা কবির দিকে খুব একটা ভালো নজরে কেউ তাকায় না। ওই যে একটা ব্যাপার, নারীরা আবার লিখবে কি! তবে আমার কথা বলতে পারি, আমার লেখালেখির জন্য সব সময় আলাদা মর্যাদা পেয়েছি। আমাকে কেউ গড়পড়তা লেখকদের কাতারে ফেলেনি। এটা আমার প্রথম বই প্রকাশ থেকেই ঘটেছিল। আমি দেশে ও দেশের বাইরে প্রচুর সম্মানিত হয়েছি। এখন তো বহু নারী লেখালেখিতে আসছে- এটাও ভরসার কথা।’’

ঝর্না রহমান একাধারে গল্পকার, কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক। তিনি মনে করেন নারীর জীবন ও নরের জীবন এক না। আলাদা জীবনযাপন, আলাদা অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার ছাপ লেখাতে থাকবেই। তবে সমাজে ‘মেয়েলী লেখা’ বা ‘নারীর লেখা’ বলে যে শব্দবন্ধ আছে সেটি পুরুষশাসিত সমাজের তাচ্ছিল্যপূর্ণ উচ্চারণ।

ঝর্না রহমান বলেন, ‘আমি ব্যস্ততম নারী। সংসারে নয় ভাইবোনের মধ্যে বড়, আবার শ্বশুরবাড়িতেও আট ভাইবোনের মধ্যে আমি বড় বউ। কোনো পরিবারেরই দায়িত্ব এড়াতে চেষ্টা করি না। সময়, পরিবার, চাকরি এবং লেখার মধ্যে সমন্বয় করি। বেশিরভাগ সময় রাতে লিখি। চিন্তার সমৃদ্ধির জন্য অনেক পড়তে হয়। কোনো কোনো চিন্তা নিজের ভেতর এমনভাবে বেড়ে ওঠে যে, না লেখা পর্যন্ত মুক্তি দেয় না। আমি খুব ভালোভাবে জানি কেউ সময় দেবে না, সময় বের করে লিখতে হবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে আমার কাছে লেখাটা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। জীবন থেকেই লেখার রসদ নেই। নারীর যাপিত জীবনের যে অভিজ্ঞতা তা তো একজন লেখকের লেখাতেই থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই শব্দবন্ধ নারীর যাপিত জীবনকে সম্মান দেখিয়ে উচ্চারণ করা হয় না। একজন পুরুষ দুর্বল লেখা লিখতে পারেন, আবার একজন নারীও সবল লিখতে পারেন। এই শব্দবন্ধের উৎস আমাদের বহুকাল ধরে চলে আসা চিন্তা। এ কথাও সত্য- এই সামাজিক পরিবেশে বেশিরভাগ নারী গণ্ডিবদ্ধ থাকেন। এতে যে যখন লেখে, লেখার বিষয় ছোট বা কম শক্তিশালী হতে পারে।’  

কথাশিল্পী ও নাট্যকার রুমা মোদক বলেন, ‘গল্পের প্রটাগনিস্ট আমি করে গল্প শুরু করলে পাঠক ধরেই নেন- কোনো নারী চরিত্র বলছে। অথচ পুরুষ গল্পকারের বেলায় এটা ভাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘‘অনেক অনেক কষ্ট করে লেখার সময় বের করি। অনেক কিছু ম্যানেজ করে- সংসার, চাকরি, থিয়েটার, বাচ্চাকাচ্চা সব সামলে। এ সমাজ-সংসারে কোনো কিছুই অবহেলা করার উপায় নেই। শুধু নিজের লেখাটাই অবহেলা করা যায়। কতো লেখা মাথায় রাখতে রাখতে হারিয়ে যায়। যতটুকু লিখেছি সব কিছু সামলে সময় বের করে লিখেছি। প্রতিনিয়ত শুনি ‘নারীর লেখা বুঝা যায় না’। যখন কেউ এ কথা বলেন, আমি পালটা প্রশ্ন করি- বদনাম করলেন নাকি প্রশংসা করলেন?’’ 

এই অভিধা গ্রহণে আপত্তি আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রুমা মোদক বলেন, ‘নারীর আলাদা বিশ্ব আছে, ভূগোল আছে৷ আমার লেখা পড়ে ‘নারীর লেখা’ মনে হলে আমি বরং কৃতার্থ হই। কিন্তু এ কথা যারা বলেন, তারা তো নারীর সংকট সম্ভাবনা কিংবা ইতিবাচক ভূমিকায় বলেন না, বরং পুরুষ লেখকের সঙ্গে তুলনা করে হেয় অর্থে বলেন।’

কবি ও কথাশিল্পী মেঘ অদিতি মনে করেন,‘‘নারীর লেখা’ শব্দজোটেই স্পষ্ট সেই বিভাজন রেখা যা বহু বছর ধরে লালিত ও পালিত। সেই ট্যাবু… নারী দিবসের প্রাক্কালে, এই প্রশ্নটি তাই হয়তো যথাযথ।’’

তিনি বলেন, ‘‘ভালো লেখা মানেই পুরুষের লেখা বা মিষ্টি হাসিতে কোনো লেখকের লেখা পড়ে ‘আপনার লেখা দেখে বোঝার উপায় নেই এটা নারীর লেখা’ এমন মন্তব্যের আড়ালে যা থাকে আমার শুধু বলার আছে যে- ‘ওই সেই জেন্ডার ইস্যু, তাকে এবার ঘাড় থেকে নামান তো।’’ 

গবেষক, প্রবন্ধিক রঞ্জনা বিশ্বাস এই বলা না-বলার বিষয়টির ভিত্তিভূমি হিসেবে দেখালেন দুটি প্রত্যয়। এক সম্পদে নারীর নিয়ন্ত্রণ এবং দুই শরীরে নারীর নিয়ন্ত্রণ। এর সঙ্গে নারীকে নিয়ে বলা কথা, কটুক্তি, প্রশংসার মান ওঠা-নামা করে।

আপনার প্রাপ্তি এই পুরুষশাসিত সমাজ কীভাবে অভিনন্দিত করে? রঞ্জনা বিশ্বাস বলেন, ‘সমাজের যে ধারণা আমাদের কাছে, আদৌ কি নাগরিক জীবনে সমাজের ব্যাপারটা ওরকম? গোষ্ঠীবদ্ধতা বা জোটবদ্ধতা, যুথবদ্ধতা এরকম সমাজের ধারণা এখন আর নাই! সে কারণে এটা বলা কঠিন যে একজনের অর্জন আরেকজনকে কীভাবে ভাবায়- এগুলো মানুষ সাধারণত বলতে চায় না; স্বীকার করতে চায় না। স্বীকার করতে না চাওয়ার ব্যাপারটা হচ্ছে, সমাজের মানুষেরা মনে করে আমি কেন কোনো ‘বেনিফিট’ ছাড়া একজন মানুষকে মার্কেটিংয়ের পলিসির মধ্যে নিয়ে আসবো। অন্যদিকে আবার নারীকে তো দমিয়ে রাখার একটা প্রবণতা আছেই। তারপরও আমার অর্জন বা আমাদের অর্জন পুরুষশাসিত সমাজে যেটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে তা ঊর্দ্ধমুখী- এও কম কি!’

সাহিত্যে স্বাধীন চিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান কীভাবে মূল্যায়ণ করবেন? জানতে চাইলে রঞ্জনা বিশ্বাস বলেন, ‘নারী নিজের চিন্তা অবদমন করে রাখতে অভ্যস্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুরের চোখ তুলে নিয়েছিল তার স্বামী। ঘটনাটি কিন্তু একদিনে ঘটেনি। তার আগে নিশ্চয় অসংখ্য অপ্রীতিকর ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেছে। এই যে ঘটনাগুলো ঘটেছে যা তার সঙ্গে যায় না, কিন্তু তারপরেও তিনি স্বামীর সঙ্গে থেকেছেন। আমাদের একটি প্রবণতা আছে যতোক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সহ্য করার ক্ষমতা আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মাথা নত করে থাকি। বিভিন্ন বিষয়ের দোহাই দিয়ে আমরা আমাদের অবদমন করি। সেটা যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক, অবদমন আমাদের স্বাধীন চিন্তা করতে সাহায্য করে না। শব্দের প্রয়োগ এবং এর কার্যকারিতা মূলতা নারীর স্বাধীনচেতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার রেশিওর সঙ্গে ওঠা-নামা করছে। যে যতো স্বাধীনচেতা তার সাহিত্য ততো শক্তিশালী।

এই যে বলা হলো- নর আর নারীর জীবন এক না। এও তো সত্য যে, প্রায়শ’ই প্রশ্ন করা হয়- নারীর বাড়ি কোনটা? একটা বাবার বাড়ি আর একটা শ্বশুরবাড়ি। সেই প্রশ্নের উত্তর মিলেমিশে গেছে নাগরিক জীবনে। এখানে নামকরণ হয়েছে ‘আমাদের বাসা’। সুতরাং নারীর একা এগিয়ে যাবার বিষয়ই শুধু নয়, জীবন ধারণের উপকরণ আর উপায়ও শব্দের ঠিকানা পাল্টে দিতে পারে।