শিল্প ও সাহিত্য

ছোটগল্প || আহীর আলমের বাম পা 

বাবা কী হয়েছে তোমার?  পিতা আহীর আলমকে চার হাত-পায়ে জন্তুর ছন্দে কলাপসিবল গেটের দিকে আসতে দেখে বিস্ফোরিত চোখে প্রশ্ন করে অবিরাম অভি! অবিরামের পাশে দাঁড়িয়ে মা সিলভিয়া আখতার ছোট বোন বাসনা। দুজনার চোখের দৃষ্টিতেও অবিশ্বাস্য বজ্রপাত- কী দেখছে চোখের সামনে? 

চাবি দাও তাড়াতাড়ি, কলাপসিবল গেটের মধ্যে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় অভি। দুপুরের খাওয়া খেয়ে নানার বাড়ি জুরাইন থেকে যাত্রা করেছিল। গ্যাসচালিত যন্ত্রযানে মোহাম্মদপুরের বাসায় আসতে আসতে বিকেলের আলো নেমে এসেছে ঢাকা শহরের পটে। 

আহীর আলম মুখ থেকে চাবির গোছা ডান হাতে এনে নিক্ষেপ করে, গেটের ফাঁক গলে হাত দিয়ে দ্রুত চাবি নিয়ে গেট খোলে অভি। মা ও বোনের আগে ক্ষিপ্রগতিতে রুমে ঢুকে বসে আহীর আলমের সামনে- কী হয়েছে তোমার? তুমি এভাবে কেনো আসছো? দাঁড়াতে পারো না? হাঁটতে সমস্যা? একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করে অবিরাম হাত ধরে বাবার, আমি ধরছি তোমাকে, তুমি দাঁড়াও। 

বাইরে থেকে রুমে ঢুকেছে বাসনা আর সিলভিয়া আখতার। দুজনেই পাথর। সিলভিয়া আখতারের  চোখে মুখে অপরাধবোধ- আমি মানুষটাকে বাসায় একলা রেখে কেনো গিয়েছিলাম বেড়াতে? লোকটা নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সাধুসন্তু মনে করে। রাগে ক্ষোভে দুঃখে কাঁদতে ইচ্ছে করছে সিলভিয়ার।  ওঠো, দাঁড়াও...অভি তাগড়া শরীরে দুহাতে জাপটে ধরে বাবাকে। হঠাৎ আত্মজর মমতায় আহীর আলমের ভেতরটা জলের স্রোতে ভেসে যায়। চোখের কোণে পানি জমে। নিজেকে কোনোভাবে সামলে নিয়ে অভির দুই হাতের বলিষ্ঠ মধ্যে দাঁড়ায় আহীর আলম।  মা! বিষণ্ন গলায় ডাকে বাসনা, কীসের একটা গন্ধ পাচ্ছি। তুমি পাচ্ছো? হ্যাঁ, বিদঘুটে গন্ধ- নাক টানেন সিলভিয়া আখতার। 

অবিরাম বাবাকে আগলে ধীরে ধীরে রুমের মধ্যে ঢোকে। ঢুকতে ঢুকতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় বাসনার দিকে, ঠিকইতো! কেমন একটা কটু গন্ধ আসছে নাকে! ড্রয়িংরুম পার হয়ে বেডরুমে ঢোকার পর আহীর আলমকে বিছানার উপর বসায় অভি। বসেই শুয়ে পড়েন আহীর আলম। শরীরের উপর একটুও ধকল নিতে পারেন না। বাবার মুখের দিকে তাকায় অবিরাম, ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে, আমার বাবার মুখটা কেমন ধূসর হয়ে গেছে! অথচ কি সুন্দর আর কমনীয় ছিল মুখটা! তাকালেই মায়া জেগে উঠতো। এখন সেই উজ্জ্বল মুখটা পাণ্ডুর মলিন। চামড়া কুঁচকে গেছে- মুখে খোচা খোচা দাঁড়ি। হায়, আমি কতোদিন অবহেলা করেছি... বুকের ভেতরটা ভেঙ্গেচুড়ে যাচ্ছে অভির, এই মানুষটা আমার জন্মদাতা! এতোদিন আমি কিসের ঘোরে  ছিলাম? চোখ ফেটে পানি আসে। চোখের পানি লুকানোর জন্য বাথরুমে ঢোকে অবিরাম। দাঁড়ায় আয়নার সামনে, ভাগ্যিস আজকে বাবাকে এমন অসহায় অবস্থায় দেখলাম। না দেখলে তো কাছেও আসতাম না। অথচ কতো ডাকে আমাকে...। 

গোটা বাসার মধ্যে পানি, কাচের টুকরো, খাবারের অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বুঝতে পারে সিলভিয়া, মানুষটা দাঁতে দাঁত চেপে দুটো দিন আর একটা রাত কি অসহ্য যন্ত্রণায় কাটিয়েছে। অথচ বলেছে আমি ভালো আছি! এক ধরনের বিপন্নবোধে নিজের মধ্যে নিজেই হন্তারক হয়ে ওঠে সিলভিয়া, আমি কেনো বুঝতে পারলাম না? এতেদিনের সংসার- তাহলেই সবই কী শূন্যতার কলস? সামান্য স্বার্থ উল্লাসের কাছে আমরা হেরে যাই? কাজের বুয়া গোপালের মাকে ফোন দেয় সিলভিয়া, আমরা বাসায় এসেছি। তুমি শীঘ্র আসো।  আইতেছি খালা।  

সিলভিয়া আখতার বসে আহীর আলমের পায়ের কাছে। গন্ধটা তীব্র নাকে লাগে- ঘুরে মাথার কাছে যায়। হাত রাখে কপালে, তুমি আমার সঙ্গে এমন করলে কেনো? চোখ মেলে তাকান আহীর আলম- কি করলাম আমি! তোমার এতো কষ্ট হবে জেনেও তুমি যেতে দিলে কেনো আমাকে? হাসার চেষ্টা করেন আহীর আলম, আমি অসুস্থ। দিনের পর দিন সহ্য করে যাচ্ছো আমাকে দাঁতে দাঁত চেপে। তোমাদেরও তো বাইরে যেতে ইচ্ছে করে! আমি আটকাবো কেনো? বাবা তোমার চা! বাসনা ট্রে নিয়ে ঢোকে। রাখে বিছনার উপর। ট্রেরের উপর কয়েকটা রঙ চায়ের কাপ, একটা পিরিজের উপর নোনতা বিস্কুট। চা-বিস্কুট দেখে উঠে বসেন। মুখে বিস্কুট দিয়ে  চিবুতে থাকেন। বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে অভি। বসে সামনের ছোট চেয়ারে, বাবা আমাকে বলোতো গন্ধটা কিসের? আমার পায়ের! মানে? মনে হয় পচে গেছে। গতকাল থেকে এই দুর্গন্ধটা পাচ্ছি আমি- নিরাসক্ত গলায় বলেন আহীর আলম। আমার পায়ের সামান্য অংশ থেকে এমন বাজে গন্ধ আসছে, লাশ পচলে আরও বিকট গন্ধ হয়, তাই নারে! দেখি দেখি! চেয়ার ছেড়ে বিছানার উপর পিতার বাম পায়ের কাছে বসে অভি। বাসনা উল্টো দিকের চেয়ারে বসে অবাক তাকায় পিতার মুখের দিকে, বাবার পা পচে গেছে? অবিরাম খুব যত্নে আহীর আলমের বাম পায়ের প্যান্ট উপরে তুলতে থাকে। কিছুটা তুলতেই পায়ের মাংস পচার ঝাঝালো গন্ধটা নাকে লাগে সবার। বাম পায়ের গোড়ালির উপর, পিছনের দিকটার মাংসটা কালো হয়ে গেছে। মাংসগুলো নরম আর শিথিল হয়ে শরীর থেকে ক্ষয়ে যাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। প্যান্টের কাপড় তুলবার সঙ্গে সঙ্গে মাংস পচা দুর্গন্ধটা আরও ছড়িয়ে পড়ে রুমের মধ্যে। গন্ধটা সহ্য করতে না পেরে নাকে হাত চাপা দিয়ে অবিরাম যায় দরজার কাছে, তোমার এই অবস্থা জানাওনি কেনো?

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে, মুখের ভিতরের গলে যাওয়া নোনতা বিসকুটের স্বাদ নিতে নিতে হালকা স্বরে বলেন আহীর আলম, বাম পা নিয়ে তো গত কয়েক বছর যন্ত্রণায় আছি। কি আর বলবো? অনেক তো বলেছি, অনেক সয়েছি- যা হবার হোক! আমি প্রস্তুত।  তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো?  অবিরামের গলায় উৎকণ্ঠা-শরীরের কোনো জায়গা থেকে মাংস পচা মানে কি জানো? ভয়ানক খারাপ কিছু হতে পারে। তোমার যদি হয় একটা কিছু- আমি, মানামী, বাসনা কই যাবো? এই শহরে আমাদের কে আছে তুমি ছাড়া?  ছেলের হঠাৎ দায়িত্বশীল হয়ে ওঠায় আহীর আলমে ভেতরে আনন্দের জোয়ার বইছে কিন্ত সামলে নিয়ে বলেন, আমার বাম পা পচে গেলে আমার কী করার আছে? আমি ইচ্ছে করে কি পচিয়েছি? আমি কি আমার জীবনের এমন সর্বনাশ চেয়েছি? শোয়া থেকে বসেন আহীর আলম। বসে চায়ের কাপটা হাতে নিয়েই হালকা চিৎকার দেন, উহুরে! কি হলো? অবিরাম মুখের উপর মুখ নিয়ে আসে। পায়ের দিকটা জ্বলছে, মনে হচ্ছে কেউ পোড়া মরিচের গুঁড়ো লাগিয়ে দিয়েছে। শুয়ে থাকলে ভালো লাগে? সিলভিয়া আখতারের প্রশ্নে মাথা নাড়েন আহীর আলম, তখন ব্যথাটা টেরই পাওয়া যায় না। তাহলে শুয়েই থাকো- আহীর আলমের পিঠে হাত রাখে অবিরাম। আমি ধরছি তোমাকে, তুমি শুয়ে পড়।

আরে রাখ না! এতো কষ্ট করে চা বানিয়েছে মেয়েটি, খেয়ে নিই। আর ব্যথাটা কমেছে। তিনি চায়ের কাপ হাতে আর একটু সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করছেন। বসেই মুখের কাছে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দেন। চারজন মানুষ একসঙ্গে চা খাচ্ছে। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট ভিজিয়ে বিকেলটাকে সেলিব্রেট করছে আহীর আলমের চার সদস্যর পরিবার। একটু আগে, যখন কলাপসিবল গেট খুলতে গিয়েছিলেন আহীর আলম জান্তব যন্ত্রণায় চতুস্পদী কায়দায়, তখনকার পরিস্থিতি থেকে মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে কেমন পাল্টে গেছে! আসলে মোমেন্ট বা মুহূর্ত অলীক আলেয়া, পলকে পলকে পাল্টে যায়। পাল্টায়, পাল্টে দেয়। যদিও আহীর আলম ভয়ানক অসুস্থ কিন্ত এই মুহূর্তের চারজনের চা পানের লগ্নটা মহাসুখের, তীব্র আনন্দের। সংসারের চারজন মানুষ পরম নির্ভরতায় চা খাচ্ছে, মনে হচ্ছে সংসারে কোনো দুঃখ নেই, শোক নেই। নিঃশব্দ সুখের নোঙরে ভেসে যাচ্ছে প্রত্যেকে...। অথচ এক মুহূর্তে সব পাল্টে অন্য এক যন্ত্রণার শোকেসে প্রবেশ করতে পারে যে কেউ, যে কোনো মুহূর্তে! মুহূর্তই জীবনের ক্লাশ, মুহূর্তই সর্বনাশ... আর বসে থাকা যায় না মা! চায়ের কাপের চা শেষ করে সিলভিয়া আখতারে দিকে তাকায় অভি।  কি করতে চাস? এখনই বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কোন ডাক্তারের কাছে নিবি? ইয়াকুব আংকেলের কাছে নেবো। উনিই তো বাবার চিকিৎসা করেন। কোমড়ে দুই দুই বার অপারেশন করলেন।   আমি গত মাসে ফোন দিয়েছিলাম, ইয়াকুব ভাই বিদেশে, শুয়ে শুয়ে জানান আহীর আলম। সে তো গত মাসে, গত মাস পার হয়ে এখন এই মাসের অর্ধেক। তুমি ফোন নাম্বার দাও, আমি এখনই ফোন দিচ্ছি। আমি দিচ্ছি, সিলভিয়া নিজের মোবাইল থেকে নাম্বার বের করে দেয় অবিরামকে।  মোবাইলে পেয়ে যায় ডাক্তার ইয়াকুব আলীকে, আংকেল আমি আহীর আলমের ছেলে অবিরাম অভি।  হ্যাঁ বলো। কি অবস্থা তোমার বাবার? অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। বাম পায়ের গোড়ালির থেকে মাংস পচার গন্ধ আসছে। এক মুহূর্তও সময় নিলেন না ডাক্তার ইয়াকুব আলী, এখনই নিয়ে হাসপাতালে আসো। আমি আছি। ওকে আংকেল!

অভি কারো সঙ্গে আলাপ না করেই মোবাইল এ্যাপে ঢুকে, অ্যাম্বুলেস আসার জন্য অর্ডার করে। অর্ডার করে তাকায় মায়ের দিকে, মা অ্যাম্বুলেন্স আসতেছে। বাবার জামাকাপড় চেঞ্জ করে দাও।  বাবার সঙ্গে কে যাবে? বাসনা প্রশ্ন করে। গোপালের মা এসে দাঁড়ায় বাসার মধ্যে, গোপালের মা তুমি ঘর দোর গোছাও। দুই দিন ধরে আসোনি কেনো? কেডায় কইচে আহি নাই? আইচি তো। গেট ধাক্কাইচি কতো, কেউ খোলে নাই। সিলভিয়া তাকায় আহীর আলমের মুখের দিকে, নির্বিকার মুখ। কেউ গেট ধাক্কালে আহীর আলমের করার কিছু ছিল না, চুপচাপ শুনে যাওয়া ছাড়া। সিলিভিয়া মুখ ফেরায় গোপালের মায়ের দিকে, কোনো সমস্যা নেই। দুই দিনের বাসি বাসা। পরিষ্কার করে মোছো।  বাবার সঙ্গে আমি যাবো, আর কারো যেতে হবে না। মা তুমি বিশ্রাম নাও। অনেকটা যুদ্ধের মাঠের একজন চৌকশ সেনানায়কের প্রদীপ্ত সাহসে সংসারের ভারটা নিজের কাঁধে টেনে নেয় অবিরাম অভি। অবিরামের এই ভূমিকায় সিলভিয়াও ভীষণ আনন্দিত। বুকের উপর থেকে একটা ভার নেমে যায়, ছেলেটার সুমতি ফিরছে। 

টাকা লাগবে না? মায়ের প্রতি উত্তরে অভি বলে, হ্যাঁ, টাকা দাও। আলমারি খুলে দশ হাজার টাকা দিলে প্রতিবাদ করে অভি, দশ হাজারে হবে না মা। আরও দশ হাজার দাও। সিলভিয়া আখতার ছেলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আরও দশ হাজার টাকা বের করে দেন। আর মাত্র দশ হাজার টাকা আছে। কীভাবে সংসার চলবে, বুঝে উঠতে পারছে না। চিকিৎসায় কতো খরচ হবে জানা নেই। অফিস থেকে এখনও বেতন দেয়। যে বেতন পান আহীর আলম অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়ায়। বাকী টাকায় সংসার চালিয়ে নেয়া দুঃসাধ্য। ভাগ্যিস, বাপের বাড়িতে আড়াই কাঠা জায়গা পেয়েছেন সিলভিয়া। সেই জায়গার উপর ছোট ছোট কয়েকটা টিনের ছাপড়া তুলেছে। ভাড়া আসে হাজার বিশেক- সব খরচ বাদে। নইলে কি যে হতো সংসারের- দুটি ছেলে মেয়ে এখনও পড়ছে কলেজে।  তুমি এখনও বাবাকে চেঞ্জ করে দাও নি মা! অভির অসহিষ্ণু গলা। তুই রুমের বাইরে যা, আমি এখনই দিচ্ছি সব চেঞ্জ করে।  অভি রুমের বাইরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে সিলভিয়া আখতার। দরজা বন্ধ করবার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে শোনা যায় এ্যাম্বুলেন্সের গাড়ির বিকট শব্দ। আহীর আলমকে পাজা কোলা করে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে শুইয়ে রেখে বাসার সামনে দাঁড়ায় অভি, মা যাই? বাবুই? মায়ের পাশে দাঁড়ানো বাসনা করুণ গলায় ডাকে।  কিরে? আমি আসি? তুই একলা সব করতে পারবি? শার্টের কলার ঠিক করতে করতে কড়া চোখে তাকায় বাসনার দিকে, না। তুই বাসায় মায়ের কাছে থাক। আর কোনো প্রয়োজন হলে আমি ফোন দেবো। 

অ্যাম্বুলেন্সে উঠে দরজা বন্ধ করলে বিকট আর্তনাদ ছড়িয়ে ছুটতে থাকে সামনের দিকে। সন্ধ্যার আগে আগে ঢাকা শহরের প্রধান গলি, উপগলি, ছোট গলি, তস্য গলি- সব গলিতে গুমোট জ্যামের বাজার লেগে যায়। সেই তুলনায় আজকের রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। রাস্তা ফাঁকা পেয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে আহীর আলমকে বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের সামনে এসে হাজির। ভিতরে গিয়ে ডা. ইয়াকুব আলীর সহকারী মাসুদের সঙ্গে দেখা করলে হুইল চেয়ারে নামিয়ে ইমারজেন্সি বেডে শুইয়ে দেয় আহীর আলমকে। মাসুদ আঠার মতো লেগে থাকে ইয়াকুব আলীর সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যে ডা. ইয়াকুব আলী এসে ইমারজেন্সি রুমে ঢুকেই নাকে রুমাল চাপেন, গন্ধ কীসের? আহীর আলমের মুখ ব্যথায় কুঁচকানো মুখে হাসি এনে জবাব দেন, ইয়াকুব ভাই আমার পায়ের মাংস পচা গন্ধ। 

ডাক্তার ইয়াকুব আলী অনেক ভালো চেনেন এই রোগীকে। তিনিও হাসতে হাসতে মাসুদকে বলেন, প্যান্টের কাপড়টা তোলো। প্যান্টের  কিছুটা অংশ উপরটা তুলতেই পায়ের গোড়লির উপরে থকথকে পচা মাংস বিকৃত চোখে তাকিয়ে আছে। এক পলক দেখেই তাকান ডাক্তার রোগীর মুখের দিকে। ভাবলেশহীন মুখ আহীর আলমের। মনে হচ্ছে- স্বর্গে যাবার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। অথবা স্বর্গের টিকিট ডান পকেটে রাখা আছে, দরজায় গেলেই ঢুকে যাবেন। এই মানুষটাকে যতো দেখেন তত অবাক হন ডাক্তার ইয়াকুব আলী। নিজেকে নিয়ে সব সময়ে একটা ছিদ্রহীন ঠাট্টার মধ্যে থাকেন আহীর আলম। অত্যন্ত রাজনীতি সচতেন মানুষটা সমাজটাকে দেখেন কুষ্ঠ রোগীর দৃষ্টিতে।  আংকেল? ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে অভি। 

আমার রুমে চলো- অভির হাত ধরে নিজের রুমে চলে এলেন ডাক্তার। রুমে ঢোকার পথে দুই পাশে সাজানো চেয়ারে অজস্র নানা বয়সী রোগী, রোগীর আত্মীয় অপেক্ষা করছেন অসীম ধৈর্য্য আর করুণার সঙ্গে। ডাক্তার ইয়াকুব আলী প্রতীক্ষারত রোগীদের ফেলে আহীর আলমকে দেখে রুমে ঢুকে মুখোমুখি বসেন অভির, তোমার বাবার অবস্থা বেশী ভালো নয়।  কী হয়েছে বাবার? কী হয়েছে সেটা সরাসরি বলার আগে তোমার বাবার পায়ের একটা স্ক্যান করানো দরকার। সেটা দেখার পর আমি বলতে পারবো- তোমার বাবার পায়ের সঠিক অবস্থাটা। ঠিক আছে, করান।  ওকে, ব্যবস্থা নিচ্ছি। রাত নটার মধ্যে স্ক্যানের রিপোর্ট পেলে ইয়াকুব আলী খুব মনোযোগ দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে অভিকে বলেন, তোমার বাবার চিকিৎসা আমার এখানে হবে না অভি। কারণ  আমার চিকিৎসার  স্তর অতিক্রম করে অন্যদিকে টার্ন নিয়েছে। এখন আর আমার কিছু করার নেই। কোথায় নেবো বাবাকে?

আমি লিখে দিচ্ছি, অলরেডি অনেক দেরী হয়ে গেছে। এখনই নিয়ে যাও পঙ্গু হাসপাতালে। তরুণ ডাক্তার অসীম হিমেলের কাছে পাঠালাম। তোমার বাবাকে নিয়ে ওর চেম্বারে চলে যাও। ও দেখে সিদ্ধান্ত নেবে-  সেটা ঠিকই হবে আমরা ধারণা। আমি তোমার সামনে ফোন করে দিচ্ছি এখনই।  ডাক্তার অসীমকে ফোন করে দিলে, দ্রুত এ্যাম্বুলেন্সে তুলে আবার যাত্রা  শেরে বাংলা নগরের দিকে। আহীর আলমের যতো নড়াচড়া করতে হচ্ছে, তত বাম পায়ের পচা অংশে ব্যথা বাড়ছে। নিজস্ব নিয়মে তিনি এ্যাম্বুলেন্সের বিছানায় শুয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছেন। পাশে বসে পিতার হাত ধরে আছে অভি। পিতা! জন্মের সূত্র এই মানুষটি কতো অসহয়! সব মানুষই কী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এমন করুণাধারায় চলে যায়? কি শালপ্রাংশু শক্তিশালী মানুষ, এখন বিছনার উপর একদলা মাংস মাত্র! 

অ্যাম্বুলেন্স এসে থামে হাসপাতালের সামনে। দৌড়ে নামে অভি। দ্রুত একটা হুইল চেয়ার নিয়ে আসে। পিতাকে হুইল চেয়ারে তুলে ভিতরে ঢোকে। রাত সাড়ে নটা- লিফটের সামনে লম্বা লাইন। কিন্ত হুইল চেয়ারে রোগী দেখে সবাই পথ ছেড়ে দেয়। দ্রুতই তিনতলায় এসে  ডা. অসীম হিমেলের চেম্বারের সামনে দাঁড়ায়। ডাক্তার অসীম আগেই বলে রেখেছিল, এ্যাটেনডেন্ট ভিতরের রোগী বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আহীর আলমকে ঢুকিয়ে দেয়।  বিছানায় তুলে, স্ক্যান দেখে ডাক্তার অসীমের মুখ ভার হয়ে যায়। তিনি নিজের চেয়ারে বসেন আর এ্যাটেনডেনকে ডেকে আহীর আলমকে কেবিনে ভর্তির নির্দেশ দিয়ে কাগজপত্রে সই করেন। কাগজপত্র আর রোগী বের হয়ে গেলে অভি প্রশ্ন করে, কী হয়েছে বাবার?

আপনার বাবার.... বাসা থেকে সিলভিয়ার ফোন আসে, তাকায় ডাক্তারের দিকে- মায়ের ফোন। ধরুন। ফোন রিসিভ করে বলে, মানামী আমি তোমাকে দশ মিনিট পর ফোন দিচ্ছি। তোর বাবা কোথায়?  পঙ্গু হাসপাতালে। পঙ্গু হাসপাতালে কেনো? ডা ইয়াকুব আংকেল পাঠিয়েছেন। আমি ডাক্তারের সামনে বসে আছি- বাবাকে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ শেষে তোমাকে ফোন দিচ্ছি।  আচ্ছা! উদ্বিগ্ন গলায় ফোন কাটেন সিলভিয়া আখতার। বলুন, কী হয়েছে বাবার?

ডা.অসীম কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন অবিরামের দিকে। নিজেকে প্রস্তত করেন ভেতরে ভেতরে। রোগীদের কাছে ডাক্তারদের যে কতো অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করতে হয়!  বলুন, তাড়া দেয় অবিরাম। বিকেল থেকে এখন রাত দশটা, কিছু খায়নি। অথচ বাসায় থাকলে দুই তিন বার খাওয়া হয়ে যেতো। পেটের মধ্যে খিদেটা অনেকক্ষণ ধরে হাতুড়িপেটা করছে। অথচ ডাক্তার কেমন উদাসীন। এখনই বাসায় ফেরা দরকার। শরীর মাথা ঝিমঝিম করছে। আপনার বাবার বাম পা কেটে ফেলতে হবে এবং খুব দ্রুতই। সম্ভব হলে আগামীকালের মধ্যেই। দেরী হলে আরও সর্বনাশ হবে। আগামীকাল কাটলে হয়তো হাঁটু বাঁচানো যাবে, দুই দিন দেরী হলে হাটুঁও বাঁচানো যাবে না। দ্রুত পচন ধরেছে আপনার বাবার বাম পায়ের। কেবল মাংস না, হাড়ের মধ্যেও ঢুকে গেছে গেছে পচনশীল ফ্যাঙ্গাস। আপনি সিদ্ধান্ত জানান। 

কলিং বেল টেপেন ডাক্তার। রুমের মধ্যে অন্য রোগী ঢুকেছে। বিহ্বল বিব্রত বিষণ্ন অভি ডাক্তারের রুমের বাইরে চলে আসে। এ্যাটেনডেনের কাছ থেকে পিতার রুম নাম্বার জেনে চারতলায় উঠে কেবিনের সামনে দাঁড়ায়। বাবার বেডের সামনে নার্স। আহীর আলম ঘুমিয়ে আছেন, নির্ভার। এক পলক দেখে অভি দ্রুত নিচে নেমে আসে। হাসপাতাল পার হয়ে রাস্তায় নেমে দাঁড়ায় অভি। সামনের রাস্তা দিয়ে অজস্র পথচারী যাচ্ছে- যাচ্ছে গাড়ি, ট্রাক, রিকশা। প্রতিটা মানুষ কী সুখী আর প্রাণবন্ত! নিজের বুকের উপর হাত ডান হাত রাখে অভি, শুধু আমার বুকটা খাঁখাঁ করছে তপ্ত সীসায়। আমার বাবা দুই পায়ে আর হাঁটতে পারবে না! আমার পিতার বাম পা কেটে ফেলতে হবে? 

মোবাইল বাজে, বাসনার ফোন!  কি বলবে ছোট বোনটাকে? কেমন করে বলবে...। ফোন বাজতেই থাকে, আহীর আলমের পুত্র শোক থই থই বুকে শহরের রাস্তায় কুয়াশা কাতর কান্নায় হাঁটতে থাকে দুই পায়ে। বুঝতে পারছে না, পায়ের উপর শরীর রেখে হাঁটছে না ইটের উপর শরীর রেখে হাঁটছে! হাঁটছে কিন্তু কোথায় যাচ্ছে জানে না।