শিল্প ও সাহিত্য

ছোটগল্প || গজারি কাঠের লাঠি

কালো মেঘে আকাশটা যেন ছেয়ে গেল। সোহানের মনে হলো মেঘ আকাশে নয়; মেঘ জমেছে বাব-চাচা-ফুফুদের মনের গহিনে; যে মেঘের ছায়ায় আকাশটাও মেঘলা হয়ে গেল। দাদার মৃত্যুর আগে এই পরিবারের মানুষগুলোকে এমন রূঢ় ও স্বার্থপর কখনই তার মনে হয়নি। ছোটোবেলা থেকে মনের গহিনে লালন করা পারিবারিক সৌন্দর্য এবং গুণগুলো এমনভাবে বিবর্ণ হতে পারে ভেবে সোহান বিমূঢ় হয়ে পড়ে।   

ছন্নছাড়া বাতাসের খাপছাড়া দাপাদাপি; ফাল্গুন মাসের জরাজীর্ণ বৃক্ষপল্লবগুলো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে। বাড়ির আঙিনায় পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলোও নিরুদ্দেশ। বিহ্বল দৃষ্টিতে ঝরাপাতার উড়নি-ঘুরনি দেখে সোহান। 

পুবমুখী বাড়িটার পশ্চিমে ও দক্ষিণ দিকে থাকার ঘর তিনটি; পুব পাশে বৈঠক ঘর। বেশ বড়ো উঠোনে চেয়ার মোড়া পেতে বসেছে কবিরের বাবা, তিন চাচা, দুই ফুফু ও বাবার ফুফাত ভাই। গ্রামের দু’একজন মুরুব্বি অনাহুত, অযাচিতভাবেই নিতান্ত কৌতূহলের বশে এসে আতাউর রহমানের ছেলেদের ভাগবাঁটোয়ারা দেখছে। দু’একজন কলহপ্রিয় মানুষ যারা বিবাদ-বিরোধের আভাস-গন্ধ পেলেই গ্রীষ্মের মাছির মতো উড়ে গিয়ে হাজির। ওরা তামিশগির, তামশা দেখে, তারপর উৎসস্থলের কাজিয়ার খবর পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে দেয় খেয়ালে-বেখেয়ালে। বাড়িতে এমন মানুষ এলেও তাদের জন্য বসার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি একজন ছাড়া। হাঁটুপর্যন্ত বাম পা কাটা জমির উদ্দিনকে একটি চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়েছে বাড়ির পুব পাশের বৈঠকঘরের পাশে ডালিমগাছের নিচে, পাতলা ছায়ায়— পূর্বাহ্নে তাপহীন রোদ হলেও এই পাতলা বাইনের ছায়া বেশ আরামপ্রদ। 

কবিরের বাবা সবার বড়ো— ঢাকায় একটি সরকারি অফিসের কেরানির চাকরি করেন। তার এক ভাই গ্রামেই কৃষি কাজ করেন, আর এক ভাই সিলেটে একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ফুফুদের আশেপাশের গ্রামেই বিয়ে হয়েছে। 

জমির উদ্দিনের পাশে একটি মোড়া পেতে বসে কবির। তাকে উৎকণ্ঠিত ও মলিন দেখাচ্ছে। বাড়িতে যে চাচা থাকে সেই চাচা আতাউর রহমানের ঘরের জিনিসপত্র আগে নাকি সরিয়ে ফেলেছে; এখন তেমন কিছুই নেই। এই খবর অন্য ভাইয়েরা জানার পর ভেতরে ভেতরে বারুদ হয়ে আছে। ক্রোধের ফুলকি পড়লেই ফোঁস করে জ্বলে উঠতে পারে। কবিরের চাচিরা ঘরের কোনাকানায় পিঁড়িতে বসে ভাইদের দরবার দেখছে; তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেজাজ পর্যবেক্ষণ করছে। সবাই মুখিয়ে আছে, কিছু একটা যে-কোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে। পারিবারিক দ্বন্দ্বকলহ ভালো লাগে না বলে কবিরের মা বাড়িতে আসেনি।

কবিরের বাবাই প্রথম কথা বলতে শুরু করল। বাড়িতে থাকে জুলহাস চাচা। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তার পরিবার। গ্রামের বাড়িতে স্বচ্ছলভাবে সংসার চলে। কবিরের বাবা চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে বলল, জমিজমা তো ভাগাভাগি হইল। অহন বাড়ি, বাড়ির জিনিসপত্রও ভাগ করে দে। জুলহাস নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাগ করেন। আমি কি না করছি?   বাড়ির কোন সাই তুই নিবি? চাপা ক্রোধ মনে থাকলেও প্রকাশ না করে আস্তে আস্তে জুলহাস বলল, কোন সাইড আবার কী? আমি যে সাইডে আছি হেই সাইডই তো। সাইডের কথা উঠল ক্যান? এই সাইডে বাজান আছিল। গাছগাছালি, ঘর, বাঁশঝাড়, পুকুর সবই তো এই সাইডে। তা’লি আমরার ভাগে জঙ্গল ঝোপঝাড় ছাড়া আর কি থাকবো?

জুলহাস আগে থেকেই অনুমান করছিল আজকের দরবারে বাড়ি ভাগাভাগি নিয়ে একটা ঝামেলা হতে পারে। পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার সবারই সমান থাকলেও সে বাড়িতে বাবার সঙ্গে থাকায়, বাবার অসুখ-বিসুখে সেবা শুশ্রুষা করা, শহর থেকে ভাইরা বাড়িতে বেড়াতে এলে খাওয়া-দাওয়াসহ যত্নআত্তি সেই করেছে। সে হিসেবে সে উত্তর সাইড নেওয়ার অধিকার আইনগতভাবে না পেলেও নৈতিক ও ন্যায়সঙ্গত কারণে পেতে পারে। এই দাবি করা অযৌক্তিক নয় যা অন্য ভাইয়েরা অগ্রাহ্য করতে পারে। কিন্তু এই জগতে সম্পদ কে ছাড়তে চায়? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জুলহাস বলল, গাছগাছালি, ঘর, বাঁশঝাড় এই সবও ভাগ করেন। কিন্তু আমি উত্তরের সাইড ছাড়তাম না। 

বড়ো ভাইকে এতদিন পিরের মতো ভয় পেত, শ্রদ্ধা ও সমীহ করে কথা বলত এবং কখনো চোখ তুলে তাকিয়েছে এমন কোনো প্রমাণও নেই। কিন্তু আজকের কণ্ঠের রুক্ষতা— চোখ তুলে তাকিয়ে যেভাবে কথা বলল, তাতে সবাই স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। জুলহাসের মাথা ও কণ্ঠ উঁচুতে উঠলে কবিরের বাবার মাথা ও কণ্ঠ নিচু হয়ে পড়ে। বড়ো ভাই হিসেবে তাঁর দায়িত্বও আছে, নিজের মানসম্মানও নিজেকেই রক্ষা করতে হবে। সর্বোপরি, আতাউর রহমানের ছেলেরা মারামারি কাটাকাটি করবে আর গ্রামের মানুষ বগল বাজিয়ে ফুর্তি করবে তা চায় না কবিরের বাবা। 

জুলহাসের ঔদ্ধত্যে ভাইবোনের দরবারে অকাট্য নীরবতা নেমে এলে জমির উদ্দিন কবিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা কুন সোময় আইছোস? কবির মৃদু স্বরে উত্তর দিল, গতকাল।  তুই অহন কুন কেলাসে ফড়োস? আমি ভার্সিটিতে পড়ি।  ও, আচ্ছা। ম্যালা দিন ফরে বাড়িত আইলি। তর দাদার মিত্যুর সোময়ই আইলি না তো।  আমার পরীক্ষা ছিল তো আসতে পারি নাই।  ও, আচ্ছা।  জমির উদ্দিনের দীর্ঘশ্বাস বাতাসে চির ধরায়। 

কবিরের ছোটো ফুফু উঠোনের উপস্থিত পাড়ার লোকজনকে আপ্যায়ন করার জন্য বাটায় করে পানসুপারি নিয়ে আসে জমির উদ্দিনকে এক খিলি পান দিয়ে বলল, চাচাজি পান খান। জমির উদ্দিন পানের খিলিটা হাতে নিয়ে কী দেখলেন তা বোঝা গেল না। তিনি এক চিমটি জর্দা তুলে নিয়ে মুখগহ্বরে ছিটিয়ে দেন। চুনের কৌটাটি জমির উদ্দিনের দিকে বাড়িয়ে দিলে তর্জনীতে চুন নিয়ে তিনি বেশ আয়েশ করে পান চিবুতে শুরু করেন। কবিরের ফুফু পানের বাটাটি প্রতিবেশী কেনু মিয়ার হাতে দিয়ে বলল, ব্যাহেরেই দে।  

কবিরের বাবা ছোটো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই কোন সাইড নিবি? আমারে যে সাইড দিবি হে সাইডই নিমু। আমার কোনো আপত্তি নাই।  ছোটো ভাই বলে, আপনে তাইলে দক্ষিণ সাইডে যান। আর গাছাগাছালি, বাঁশঝাড় এইসব বিক্রি কইরা টাকা ভাগাভাগি করেন।  কবিরের বাবা জুলহাসকে জিজ্ঞেস করল, তুই কি রাজি আছোস? রাজি থাকব ক্যান? বাপের সম্পত্তির সবারই তো অধিকার আছে।  ছোটো ভাই বলল, বাজানের ঘরের জিনিস সব সরানো অইছে। এইসবের ভাগ ক্যামনে অইবো? জুলহাস ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বলেল, মুখ সামলাইয়া কথা কইবি। বাজানের ঘরের কোনো জিনিসই সরাই নাইক্যা। যেসব সরাইছি এগুলো আমার জিনিস। তোমরা শহরে থাকছ, ঘরের জিনিসপত্র কোনো দিন কিইন্যা দিছিলি? বাজানের যেসব জিনিস আছিল সবই আছে। 

ওদের বিবাদটা আরও জোরালো হতে পারত কিংবা বাড়তে পারত। কথা উঠতে পারত যে, বাড়িতে থেকে বাবার সম্পত্তি চাষবাস করে তুমি এসব কিনেছিলে। তাহলে তোমার হয় কীভাবে? কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া করার সুযোগটা কবিরের বাবাই রুদ্ধ করে দিল। কবিরের বাবা বলল, আচ্ছা ওসব বাদ দে তোরা। এখন যা আছে তাই ভাগাভাগি করে তোরা নে। আমার কিছু না অইলেও চলবো। তরার যদি মন চায় বাবার স্মৃতিস্বরূপ আমারে যেকোনো একটা জিনিস দিস। আর মন না চাইলে দিস না। 

কবিরের ছোটো ফুফু যেমন মানবিক তেমনই মুখরা। উচিত কথা বলতে কখনও পিছ পা হয় না। সে বলল, ভাগাভাগিই যদি হয় তাহলে মন চায় আর না চায় কি? ল্যায্য ভাগাভাগি করবা। আর আমরা বইনদের কথা বাদ যেন না যায়। 

পূর্বের চলমান দরবারের মেজাজের মোড় ঘুরে যায় এবং এখন বোনদের দাবি ওঠাতে সবাইকে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে কবিরের বাবার মনে থাকলেও জুলহাসের ধারণা ছিল না। জুলহাস বলল, তোরা যা নিতে চাস নিবি। আমি বেইনসাফি কোনো কাম করতাম না। 

আবার কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেলে ছোটো বোন বলল, আমরা দুই বইন্রে ছিতি হিসাবে ছোডোখাডো কিছু দিয়ো। তোমরার যা মনে লয়। আমরা ভাগাভাগি করতে চাই না।   জুলহাস এতক্ষণে নমনীয় হয়, ধীরে সুস্থে বলে, নিবা না ক্যান? সবই নিবা। আমি অন্যায্য কিছুই নিমু না।  কবিরের বাবা বলল, তা’লি ঘরে কী কী আছে বাইরে আন। সবার সামনেই ভাগ হোক। 

আতাউর রহমানের ঘরের জিনিসপত্র বাইরে এনে উঠোনে টাল দেওয়া হলো। পুরোনো গৃহস্থ বাড়িতে জিনিস তো আর কম নয়। কবিরের নির্দেশে ভাগ হলো এবং তিন ভাইয়ের ঘরে জিনিসপত্র নিয়ে উঠানো হচ্ছে। সবকিছু তিন ভাইয়ের ঘরে উঠে গেলে উঠোনে একটি গজারি কাঠের লাঠি পড়ে রইল। কেউ হাত দেয়নি এটিতে। কেউ নিতেও চায়নি।  

লাঠিটি উঠোনের পাশে পড়ে থাকতে দেখে জমির উদ্দিনের চোখ চকচক করে ওঠে এবং তিনি কবিরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই লাঠিটা আন।  কবির অনিচ্ছাসত্য লাঠিটি এনে জমির উদ্দিনের হাতে দেয়। জমির উদ্দিন বলেন, লাঠিতে কিছু লেখা আছে? কবির তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে গজারি কাঠের লাঠিতে লেখা, ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’। সে লাঠিটি ঘুরিয়ে অপর পাশে দেখে, ৭ই মার্চ, ১৯৭১। 

শিউরে ওঠে কবির। একটি হিমধারা তার শরীর বেয়ে নিচের দিকে নেমে যায়। সে জমির উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তিনি আকাশের দিকে নিস্পন্দ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।  দাদার চাচাত ভাই ও প্রতিবেশী বন্ধু হিসেবে কবির জমির উদ্দিনকেও দাদাভাই ডাকে। সে জিজ্ঞেস করল, দাদাভাই এই লাঠিতে এই লেখা কেন? জমির উদ্দিন ছলছল চোখে কবিরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ৭ই মার্চের মিটিংয়ে আমরা দুজনই গেরাম থাইক্যা গেছিলাম। তোর দাদা এই লাঠি বানাইয়া নিহালগাতির সুতার কুদ্দুসরে দিয়া এই ল্যাহাডা ল্যাহাইছিল। আমারও একটা আছে। একই লেখা। দুই ভাই মিইল্যা গেলাম... লাখ লাখ মানুষের মিটিং। শেখ সাবরে দেখলাম। ভাষণ হুনলাম। তখন থাইক্যা বুকের ভিত্রে হেই ভাষণ অনবরত বাজতে লাগল। আর আমরা হইয়া গেলাম আগুনের গোলা।  

জমির উদ্দিনের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। তিনি আর কথা বলতে পারছে না। কবির আবার জিজ্ঞেস করল, তারপর? তারপর আমরা দুজনই যুদ্ধ করতে গেলাম। আমার পায়ে গুলি লাগল। পাও হারাইলাম। তোর দাদার অবশ্যই কিছু হয় নাই।  আপনারা মুক্তিযোদ্ধা? না।  তাহলে যে বললেন যুদ্ধ করেছিলেন!   যুদ্ধ করছিলাম ঠিকই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমরা দুজনের নাম নাই। নাম আছে তখন যে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আছিল তার। আমরার ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান।  জমির উদ্দিন ক্র্যাচে ভর করে দাঁড়িয়ে বলে, লাঠিটা তুই ঢাহায় লইয়া যাইস। তর দাদার ছিতি।  

তিনি আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছেন নিজের বাড়ির দিকে। কবির তাকিয়ে রইল সেই পথের দিকে। আকাশে যেন আরও কালো মেঘ ভিড় করল। কবির অনুভব করছে তার হাতের গজারি কাঠের লাঠিটা ধীরে ধীরে ভারী হতে হতে একটি পাহাড়ের মতো হয়ে যাচ্ছে যার ভার বহন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবু কবির লাঠিটি হাতছাড়া করেনি। সে এটিকে আঁকড়ে ধরেছে যাতে কোনোভাবেই ফসকে পড়ে না যায়।