জব্বার আল নাঈম : সাহিত্যকে সুন্দর এবং গতিময় করে তোলার জন্য সুফিয়া কামালের অবদান অবিস্মরণীয়। চির আকাঙ্ক্ষা এবং প্রার্থনা তার কাব্যে প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে। সুন্দরের বন্দনা করে তিনি হেঁটেছেন সাহিত্যের রাজপথে। বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের সংস্পর্শে এসে হয়ে উঠেছেন জীবনবাদী। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই যে নামটি স্মরণযোগ্য তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবির স্নেহধন্য কবি সুফিয়া কামাল জীবন দেখেছেন জীবনের ভিতর দিয়ে। জীবন হলো বোধ এবং জ্ঞান। জ্ঞান হলো মানুষের সৃজনশীলতার উন্মেষ। এখানে তন্ময় এবং মন্ময় এর আবির্ভাব। কিছু প্রাণ আছে যারা কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেন। এবং চিরকাল বেঁচে থাকেন কর্মকারণে। সুফিয়া কামাল এখানে ব্যতিক্রমধর্মী এক মহীরুহ। যিনি সমাজ বাস্তবতার বাস্তব চিত্র কলম দিয়ে কাগজে এঁকে হয়ে উঠেছেন কাঙ্ক্ষিত মানুষ এবং অবশেষে কবি। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুফিয়া কামাল সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। এর আগে বেগম রোকেয়ার সংস্পর্শে এসে তিনি গন্তব্যের দিশা খুঁজে পান এবং নিজেকে আরো গতিশীল করে তোলার প্রয়াস পান। ১৯৩৭ সালে তার প্রথম গল্প সংকলন ‘কেয়া কাঁটা’ প্রকাশিত হয়। পরের বছরই প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’। এর মুখবন্ধ লিখেন বিদ্রোহী কবিতার প্রবক্তা কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর চারপাশ থেকে কবি প্রশংসা পেতে থাকেন। প্রশংসাকারীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন। ‘সাঁঝের মায়া’য় সুফিয়া কামালকে আমরা বিরহীনিরূপে পাই; প্রেম প্রতীক্ষারত একজন হিসেবে। তার এই প্রতীক্ষা মনের আগুন বাড়িয়ে দেয়। এই আগুন কখনও তীব্রভাবে জ্বলে ওঠে, কখনও জ্বলে ধুকে ধুকে- একেবারে নিভে যায় না। কিন্তু ফাল্গুন আসার পরও যখন মনমানুষ না আসে তখন উন্মাদনার চরম প্রকাশ আমরা দেখি ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায়। মাত্র বারো বছর বয়সে সুফিয়া কামাল স্বামী হিসেবে সৈয়দ নেহাল হোসেনকে কাছে পান। নেহাল ছিলেন আধুনিকমনস্ক। সুফিয়া কামাল স্বামীর উৎসাহে সাহিত্যপাঠে মনোনিবেশ এবং লেখালেখি শুরু করেন। আর এভাবেই একদিন তিনি হয়ে ওঠেন নারী জাগরণের মুক্তির দূত। কিন্তু ১৯৩২ সালে সৈয়দ নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যু সুফিয়া কামালের জীবনে বড় এক শোক হয়ে আসে। কিন্তু দ্রুতই তিনি সেই শোক সামলে নেন। সাহিত্য কী তাকে এই শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল? সুফিয়া কামাল সকল হীনমন্যতা এবং ডর-ভয় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন। কারণ তার ভিতরে ছিল বেগম রোকেয়ার চেতনা এবং সুদূরপ্রসারী বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে জীবনের পুঁজি ভেবে সামনের দিকে হাঁটতে থাকেন তার সময়ের অন্যতম এই কবি। ‘সাঁঝের মায়া’য় তার মানসিক চাওয়া-পাওয়া এবং আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। প্রেম ভালোবাসা এবং বিরহ ফুটে উঠেছে শৈল্পিক তুলিতে। তিনি লিখেছেন :হে কবি নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়বসন্ত বরিয়া তুমি ল’বে নাকি তব বন্দনায়?কহিল সে স্নিগ্ধ আখি তুলেদখিন দুয়ার গেছে খুলে?বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুলদখিনা সমীর তার গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল।নিয়মেই পৃথিবীতে ঋতু বদল ঘটে। আগুন ঝড়া ফাগুন আসে। কিন্তু আত্মরিবহী কবি এখানে নীরব। বিধ্বস্ত কবি হারানোর শোকে এতটাই বিহ্বল যে, চোখ তুলে সে দেখতে চায়- দখিনের দুয়ার খুলে বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? তার মনে সর্বদাই হারানো প্রিয়জনের ফিরে আসার প্রতীক্ষা। কখন আসবে প্রার্থিত সেই জন। দখিনের জানালা খুললেই তার মনে ভেসে আসে অতীত দিনের স্মৃতি। স্মৃতিকাতর কবি এখানে নিজেকে প্রকাশ করেছেন প্রবল ভালোবাসা থেকে।কবির অপেক্ষা শেষ হবার নয়, চিরকালই অপেক্ষার প্রহর গুনে আশার পাত্রে জল ঢালে। কখন সেই উন্মাদ করা বাতাস সাঁঝের মায়াকে বোধগম্য করে তুলবে? বেদনাবিধূর সুরে আগমনের সঙ্গীত শুনাবে এই ব্যতিব্যস্ততায় কবি বিভিন্ন ঋতুর কাছে হাত বাড়িয়েছেন। সে আসবে বলে শীতার্ত মলিন মুখে মাঘের কাছে গিয়েছেন। অশোক শিমুলের রক্তরাগে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে খুঁজেছেন প্রিয় মুখ; অন্তর মধুর টানে সকল শিশিরবিন্দুকে অশ্রুজল বানিয়ে শ্যামল পৃথিবীর রূপরস ও প্রকৃতির কাছে বারবার ফিরে এসেছেন দু’চোখে প্রতীক্ষা নিয়ে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের ‘আর সে আসিবে কবে’ কবিতাটি যেন সেই পরিচয় বহন করে। তিনি লিখেছেন :
‘আর সে আসিবে কবে?’ জিজ্ঞাসিল শীতার্ত মলিন মুখে মাঘ অশোক শিমুল তার ছড়াই হৃদয়ের রক্ত অনুরাগ।অন্তর মধুর বিন্দু মুকুলের বুকে সঞ্চারিয়াশিশির অশ্রুতে সব শুষ্কতারে শ্যামল করিয়ারহিল তাকায়ে-
স্বামীকে অকালে হারানোটা সুফিয়া কামাল মেনে নিতে পারেননি। জীবনের প্রথম পাওয়াকে প্রত্যেকেই পরম প্রাপ্তি ভাবে। সেই পরম প্রাপ্তির ফুল যখন সুবাস ছড়ানোর আগেই ঝড়ে যায়, সেখানে সুখ হয় অনাড়ম্বর। কবিতা সেই বেদনার প্রকাশমাত্র। চিরদুঃখের রানী ‘ তুমি আর আমি’ কবিতায় সেই ইঙ্গিত বহন করেছেন। এখানে সকল সুখস্বপ্ন আজীবন টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে লিখেছেন : তুমি বেঁচে রবে আমার ভুবনে যতদিন আমি রবযুগ যুগ ধরি প্রতিদিন আমি তোমারে ঘেরিয়া নবরচিব মোহন মধু মিলনের বিরহ ব্যথার গান… যত ব্যথাতুর প্রাণভালোবাসা হৃদয়ে নিয়ে কবি এক জায়গায় থেমে যেতে নারাজ, তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভুবন অন্তরে ধারন করে যুগযুগ ধরে পৃথিবীর পথে হাঁটতে চেয়েছেন। সকল চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দিন-রাত, ব্যথা-বিরহ, সুখ-দুঃখ, রাগ-অনুরাগ নিয়েই জীবনযাত্রা। প্রেমে সুন্দর ও পরিপূর্ণ ধরণী। প্রেমে সভ্য ও মার্জিত মানুষমন। প্রেমের বৈঠা হাতে সুফিয়া কামাল হারানো স্বজনের খোঁজে এখান থেকে সেখানে তাকেই খুঁজেছেন অবিরাম। এ জন্য কবি সুদূর মরুভূমিতে নদী হয়ে নৌকা ভাসাতে চেয়েছেন। আর সেখানে যে শুভ্র সফেদ জ্যোতি তাতে বারবার চুমো দিয়ে প্রেমাবেগে ভাসবেন। সুফিয়া কামাল যতোটা নারীবাদী লেখিকা তার চেয়ে এখানে অনেক বেশি আমরা তাকে প্রেমিক হিসেবে পাই। ‘আশান্বিতা’ কবিতাতেও আমরা কবিকে বলতে শুনি- তোমারে খুঁজিয়া ফিরি, জন্ম হতে যুগযুগ ধরিঅধীর উৎসুক চিত্তে, কর্মক্লান্ত নিদ্রাহীন দিবস শর্বরীকরিতেছি তোমার ধেয়ানহে বল্লভ! অপরূপদান।তার প্রকাশকে আরো দৃঢ় এবং গাঢ়তর পরিপূর্ণ রূপে ‘আশান্বিতা’ কবিতায় পাই। এখানে তিনি জীবন সংগ্রামী ধ্যানী ও ত্যাগী, মহিয়সী নারী। কবি জন্মযুগ ধরে ক্লান্তিহীনভাবে তাকে খুঁজে চলেছেন। নিদ্রাহীন চোখে রাতের উপর দিয়ে হেঁটে গেছেন, অথচ রাত তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। কবি তার ভালোবাসাকে ধ্যানে-অজ্ঞানে বারবার খুঁজেছেন। খুঁজেছেন ফুলকুঁড়ির ভিতরে লুকিয়ে থাকা সুবাসেও। বলা যায়, সাঁঝের মায়া হলো তার অতীত ফিরে পাওয়ার সুতীব্র ব্যাকুলতার প্রকাশ। এই ব্যাকুলতা জীবন ক্যানভাসের শৈল্পিক তুলিতে নান্দনিক দক্ষতায় মার্জিত শব্দে বয়ান করেছেন কবি সুফিয়া কামাল। সাঁঝের মায়া ঘিরে প্রেম ও ভালোবাসার আবির্ভাব। ‘ভালোলাগা ভালোবাসা নহে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-বৃন্তচ্যুত কবি পুষ্পে পরেছিলে বুকে,হে খেয়ালী! খেয়ালে কৌতুকে!ভালোবেসে নহে, ভালো লেগেছিল তার বাসক্ষণিকের লাগি। বর্ণ, রূপ, বিকাশের বেদনা বিলাসআবার ‘ভিখারিনী’তে লিখেছেন-কত দিন, কত মাস, কত বর্ষ হয়ে গেল গততোমার আসার আগে জাগিয়া সততসতর্ক শঙ্কায়ক্লান্ত আঁখি তবুও না পথ হতে ফিরিবারে চায়
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ জুলাই ২০১৪/তাপস রায়