তাপস রায়উপস্থাপনার সুনির্দিষ্ট সরল অর্থ হলো, একটি উদ্দেশ্য নিয়ে সকলের সামনে তথ্য বা অনুভূতি প্রকাশ করা। প্রকাশ মাধ্যম বিভিন্ন হতে পারে। যেমন মৌখিক বা চিত্রের মাধ্যমে। কাজটি চ্যালেঞ্জিং এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ আপনি যতই বাকপটু হোন না কেন আপনাকে যদি মঞ্চে উঠে কিছু বলতে বলা হয় তখন কিছুটা সংশয় আপনার মধ্যে কাজ করবেই। এই সংশয় কাটিয়ে ওঠাই উপস্থাপকের প্রথম চ্যালেঞ্জ। এখন প্রশ্ন হলো, এই চ্যালেঞ্জ জয় করতে হলে কী প্রয়োজন? কেউ বলবেন সামর্থ্য বা দক্ষতা, কেউ বলবেন আত্মবিশ্বাস, আবার কেউ সৌন্দর্যের কথা বলবেন। অনেকের কাছে আবার শুধু দক্ষতা নয়, সৌন্দর্যই উপস্থাপনার অন্যতম অনুষঙ্গ বলে বিবেচিত হতে পারে। এই বিতর্ক কিন্তু নতুন নয়। মেরিলিন মনরোর চলচ্চিত্রে কাহিনি, অভিনয়ের বাইরে দর্শক মনরোর সৌন্দর্য খুঁজবেন এবং সেই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। আবার এর উল্টোটাও রয়েছে। গ্ল্যামারাস নন অথচ শুধুমাত্র অভিনয়ের গুণে দর্শক মন জয় করেছেন এমন অভিনেত্রীও রয়েছেন। মানুষ শুনতে নয়, বলতে ভালোবাসে। অথচ ভালো শ্রোতা হওয়ার চেয়ে ভালো বক্তা হওয়া অনেক কঠিন। এই কঠিন কাজটিই উপস্থাপকদের করতে হয়। তারা বলেন, অন্যরা শোনেন। আমির খান যদি ‘সত্যমেভ জয়তে’ উপস্থাপনা না করতেন তাহলে কী অনুষ্ঠানটি এতটা জনপ্রিয়তা পেত? মনে হয় না। কারণ উপস্থাপকের ব্যক্তিগত সৌন্দর্য উপস্থাপনার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এ কারণে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থাপক হিসেবে সব সময় সুন্দর মুখগুলোকেই নির্বাচন করা হয়। শুধু তাই নয়, উপস্থাপনার পূর্ব প্রস্তুতির ক্ষেত্রে পোশাক এবং সাজসজ্জার দিকেও বিশেষ নজর রাখা হয়। সৌন্দর্য যদি অন্যতম অনুষঙ্গ না হতো তাহলে তো যে কেউ উপস্থাপনা করতে পারত। তাছাড়া গ্রাম্য প্রবচনেই আছে, যে তরকারি দেখতে ভালো না, সে তরকারি নাকি খেতে স্বাদ লাগে না!আবার প্রবচনে কিন্তু এও আছে, জাতের মেয়ে কালো ভালো, নদীর পানি ঘোলা ভালো। জর্জ বার্নার্ড শ’র বক্তৃতা মানুষ পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে শুনত। তিনি অসাধারণ বক্তা ছিলেন। অথচ তিনি মোটেই সুদর্শন ছিলেন না। এ নিয়ে প্রচলিত অনেক গল্পও রয়েছে। একবার অসাধারণ এক সুন্দরী মহিলা বার্নার্ড শ’কে বললেন, আমি শুধু ভাবি, আমাদের বিয়ে হলে কত ভালোই না হতো। আমাদের সন্তান আপনার মেধা এবং আমার রূপ পেত।রমণীর কথা শুনে বার্নার্ড শ খুব বেশি খুশি হতে পারলেন না। সেই সুন্দরীর স্বপ্নে জল ঢেলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এর উল্টোটাও তো হতে পারে।ঘানার বিশ্বখ্যাত উপস্থাপক ডুমো বিবিসি’র অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে, তার মৃত্যুতে ঘানার তৎকালীণ প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, আমরা এ দেশের একজন শ্রেষ্ঠ দূত হারালাম। অপরাহ গেইল উইনফ্রে এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। উপস্থাপক হিসেবে এই দুজনের জনপ্রিয়তা কী তাদের অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য নাকি অসাধারণ দক্ষতার জন্য? উইনফ্রে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন রেডিও দিয়ে। টেলিভিশনে তাকে সুযোগই দেয়া হয়নি। তার উপস্থাপনায় শিকাগোর স্থানীয় একটি রেডিও স্টেশনের তৃতীয় সারির টকশো যখন প্রথম সারিতে চলে এলো তখন তার উপস্থিত বক্তব্যে পারদর্শিতা দেখে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাকে লুফে নিল। সুতরাং উপস্থাপককে সুন্দর হতেই হবে এটা হাস্যকর যুক্তি ছাড়া আর কিছু না।অনেকেই আছেন যারা এ কথা মেনে নেবেন ঠিকই কিন্তু মনে নিতে চাইবেন না। তারা মুচকি হেসে বলবেন, ডুমো, অপরাহ উইনফ্রের কথা বললেন, এডওয়ার্ড মাইকেল বিয়ার গ্রিলসের কথা তো বললেন না। তার উপস্থাপনায় ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ তো ভীষণ জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান। বিয়ার গ্রিলস দেখতে সুদর্শন নন, এটা তার শত্রুও বলবে না। পৃথিবীর ৮৬টি দেশের মানুষ তার অনুষ্ঠান দেখেন।ইন্ডিয়ায় ‘কৌন বানেগা ক্রোড়পতি’ শুরুর আগে অনুষ্ঠান প্রযোজক এমন একজন উপস্থাপক খুঁজছিলেন, যে শুধু দক্ষই হবেন না, তাকে ড্যাম স্মার্টও হতে হবে। আর স্মার্টনেস তো সৌন্দর্যেরই অংশ। কারণ উপস্থাপকের কথা দর্শক তখনই মনোযোগ দিয়ে শুনবেন যখন সে দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে। আর মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের অন্যতম উপায় সৌন্দর্য। ওই যে শেফালী ঘোষের গান আছে না, যদি সুন্দর একটা মুখ পাইতাম... পানের খিলি তারে খাওয়াইতাম। এখানেও ওই সুন্দরেরই জয়জয়কার।আবার দেখুন, মানুষ চাঁদের সঙ্গে সুন্দর মুখের তুলনা করে। কিন্তু চাঁদ তো আসলে খানাখন্দে ভরা। এটা আসলে প্রচলিত একটি উপমা। যাই হোক, বিবিসি’র উপস্থাপক জিমি সেভিলের কথা মনে আছে? তার সময়ে তিনি ছেলেন ভীষণ জনপ্রিয় উপস্থাপক। বর্তমান সময়ের অনেক উপস্থাপকের কাছেই তিনি আদর্শ। কিন্তু তারা কেউই ব্যক্তি জিমি সেভিল হতে চাইবেন না। কারণ তার ব্যক্তি জীবন নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। মৃত্যুর পরও তার বিরুদ্ধে বহু মামলা রয়ে গেছে। ১৯৬০ থেকে টানা ৪০ বছর তার বিরুদ্ধে জনপ্রিয়তা, প্রভাব খাটিয়ে ৩০০ শিশুকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। প্রিয় পাঠক, এবার আপনিই বলুন, এমন মানসিকতার কেউ সুন্দর হবেন কী করে?কৌন বানেগা ক্রোড়পতির কথা বলা হলো, এখানে কিন্তু উপস্থাপকের ব্যক্তিগত সৌন্দর্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তার পারদর্শিতা, যোগ্যতার প্রতিও সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া উপস্থাপকের সুন্দর মুখই যে সব সময় মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে এটা ঠিক নয়। তাহলে তো এদেশের ফুটপাতের সব ক্যানভাসারকে আমির খান, অমিতাভ বচ্চন হতে হতো।উপস্থাপনার সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্যানভাসাররাও উপস্থাপক। এবং তাদের ঘিরেও কিন্তু অনেক শ্রোতা দাঁড়িয়ে থাকে এবং তারা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনে। উপস্থাপনার মূল কারিকুরি আসলে এখানেই। কেননা এটি একটি শিল্প। উপস্থিত বুদ্ধি, আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, স্মার্টনেস এবং সৌন্দর্য এই চার যার মধ্যে থাকবে এই শিল্পের তিনিই হবেন প্রকৃত শিল্পী। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুলাই ২০১৪/তাপস রায়