কেউ যখন পনিটুলার গল্প শুনতে চায়, তখন আমার মনে পড়ে আসন্ন সন্ধ্যার মুহূর্ত। আখড়ার উঁলু ধ্বনি, মন্দিরার টুং টাং বাদ্য, মসজিদের মাইকে আজানের ধ্বনি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেটি ছিল এক হল্লাময় সময়। আগরবাতি আর তুলসিতলার ধূপের গন্ধে মোহময় সন্ধ্যা!
পনিটুলায় সেই সন্ধ্যায় বন্ধুত্ব হলো রাধেশ্যামের সঙ্গে। সে ছিল সহজ স্বভাবের, মিষ্টভাষী। তখন আমার অবসর জীবনের শুরু। আমরা গল্প শোনা আর শোনানোর মধ্য দিয়ে আলাপ গড়ে তুললাম। তিনিই আমাকে জানিয়েছিল পনিটুলার উপাখ্যান― একটি ছোট্ট মহল্লা, যেখানে প্রতিটি কোণায় ছিল তাঁর স্মৃতি, বলার মধ্যে ছিল রহস্যময়তা।
সে জানায়, তারাপুরের চা-বাগান দিনে দিনে ছোট হয়ে যাচ্ছে। বাগানের পাশে নেপালি আদলের মুমুর দোকান খুলেছে এখলাস ড্রাইভার। মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে খেতে আসে, আর কলেজ হোস্টেলের সামনে বনসাই চা-বাগানটির দৈর্ঘ ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
রাস্তার অপর প্রান্তে পানি-কদুর গাছ আর উড়ির মাচা, সব মিলিয়ে জায়গাটার এক ঝোঁপের আদল তখনও বিদ্যমান। রাতে সেখানে জোনাক ভেসে বেড়ায়, আর কখনো কখনো রাতের কারবারিদের হাতের ছুরি ঝলকে ওঠে। হঠাৎ করেই নিঃস্ব হয়ে যায় রিকশা সওয়ারি। পেছনে ডেকে ফিরে বলেও―উবা ভাই আমাক্ক বাঁচাইতা!
কেউ শোনে না, কেউ ফিরে দেখে না। কেবল সকালে খবর পাওয়া যায়, নিহত বা আহত হয়েছে কোনো অজ্ঞাত জন। তেরো সালে রাধেশ্যামের মিষ্টির দোকান পুড়ে গেল! সেই থেকে আমি আর লুকিয়ে মিষ্টি খাই না। এতদিন বাদে সত্যিকার অর্থে আমি ডায়বেটিসে নুইয়ে পড়ি, আর ঘ্রাণ শক্তি কমে যায়। রাধেশ্যাম বলেছিল, একাত্তরে যখন সে নিজেদের পোড়া বাড়ি দেখতে গিয়েছিল জয়ন্তিয়া, তখন তাঁর নাকে শক লাগে। পোড়া ছাই থেকে ঠাকুরদার শরীরের পোড়া গন্ধ আসে, আর সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। নাকের মাঝের হাড় ঝিনঝিন করে। দুই বছর সে কোনো কিছুর ঘ্রাণ বা স্বাদ পায়নি। কথা বলার সময় তাঁর মুখ কষ্টে ভরে ওঠে। সেই অভিজ্ঞতা তাঁর জীবন বদলে দেয়। সেই দিনগুলো, সেই গন্ধ, আর সেই নিঃশ্বাস― সব মিলিয়ে আমাদের স্মৃতিতে ঘ্রাণের মতো অমোঘ হয়ে থেকে গেছে।
কবে আমি পনিটুলা ছেড়ে আসি, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাধেশ্যাম ও মিতালীর প্রেম টেকেনি; দারুণ গণ্ডগোলের সময় দিপালীর সঙ্গে বিয়ে হলো তাঁর, তখন তাঁর ঘ্রাণশক্তি ছিল না। দুইবোনের গায়ের রঙ ভিন্ন হলেও শরীরের গন্ধ সে আলাদা করতে পারেনি। কত কত ঘটনা ঘটে যায়। কিন্তু মিষ্টির দোকানটি পুড়ে গেলে আমার ঘ্রাণ শক্তির সমস্যা শুরু হয়। এরপর দেশ ছেড়ে আমেরিকা আসার পরও আমি কোনো খাবারের স্বাদ পাইনি, গন্ধও অনুভব করতে পারিনি। রাধেশ্যাম বলে, ‘আপনার সঙ্গে গল্প করে আরাম পাই। আমি তো এই সিলেট শহরের বাইরে কখনো যাইনি, আর আপনি কত জায়গা ঘুরেছেন!’
আমি আর পনিটুলায় ফিরে যাইনি। একবার সেখানকার একটি প্রেমের গল্প বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রাধেশ্যামকে হারানো সেই উপাখ্যানে এক আঁধার কালো শোক নিয়ে আসে। তাঁর গল্পের বিকেলগুলোই আমি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি, পৃথিবীর এই দামি শহরে।
নিউইয়র্কের শুরুর দিনগুলো বড় একাকিত্বের। দীর্ঘ শীতকাল পেড়িয়ে একদিন আশেপাশের পার্কের বেঞ্চে বসতে থাকি, আর সেখানেই দেখা মেলে নতুন নতুন মানুষ। আমারই মতো, ছেলে বা মেয়ে এ দেশে এসেছে। সেখানেই কবে যেন আবার ফিরে এলো পনিটুলার কথা। ঠিক কীভাবে গল্পগুলো ফিরে এলো তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না, তবে তারপর থেকে আমি আবার ঘ্রাণ পেতে শুরু করেছি।
হঠাৎ করেই বৌমাকে বললাম, ‘স্যামন রান্নার সময় একটু সর্ষেবাটা দিও। ইলিশের মতোই স্বাদ হবে।’ বৌমা চমকে তাকায়। ‘বাবা!’ আমি অস্বস্তিতে বলি, ‘তোমার কী মনে হয় স্যামন, ইলিশের মতো না? কেবল তেল কম এই যা, সর্ষে দিলে তা পুশিয়ে যাবে।’ বৌমা কথা বাড়ায় না। আমার নিজেরই মনে পড়ে, এ দেশে এসে খাবার নিয়ে তাকে অনেক জ্বালিয়েছি। ‘কী রাঁধো, স্বাদ নাই! তুমি তো দেশে থাকতে ভালো রান্ধতা।’ সেই সব কথা নিশ্চয়ই তাঁর মাথাতেও ঘুরছে। আর স্যামনের ফিলে দেখলে আমার যে বমি পায়, তাও বলে ফেলেছিলাম একদিন। তাই তাড়াতাড়ি তাঁর সামনে থেকে সরে পড়ি। এই সময় কোথায় যাই? বাইরে রোদ বেশ, বিকালের আগে পার্কের বেঞ্চিতে কাউকে পাব না। তবুও হাঁটতে শুরু করি।
নিউইয়র্ককে যেন পছন্দ করতে শুরু করেছি। একদিন পনিটুলাকেও ভালো লেগেছিল। যদিও রাধেশ্যাম বলেছিল, ‘এই যে পনিটুলা দেখছেন, পূর্বে জায়গাটা এমন ছিল না। এখানে বড় টিলা ছিল। তারাপুর চা-বাগানের মধ্য দিয়ে এয়ারপোর্ট রোডটা ছিল না। আর ওই যে পাঁচতলা বিল্ডিং-এ আপনি থাকেন, ওইটা ছিল একটা পুকুর।’ সহসা আমার মনে হয় গল্পগুলো একই! ওই পনিটুলায় যা থাকে না, তাই হয়। সেদিন পার্কের বেঞ্চিতে বসে সাখাওয়াত উদ্দিন বলছিলেন, ‘আরে ভাই, আপনেরা যে জ্যামাইকা দেখতাছেন, হেই জ্যামাইকা আছিল না!’
আমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে পুরোনো প্রবাসী। ত্রিশ বছর ধরে আছেন। পুত্র-কন্যার সংসারে নয়, নিজের সংসার শুরু করেছিলেন এই দেশে। সে যখন বলে, ‘এই জ্যামাইকা এভিনিউ-পারসন-শ্যাটফিনের দিকে ভয়ে কেউ কোনো দিন আসে নাই, সব কাউলাদের ভয়ে। আজ পুরো সাউথ জ্যামাইকায় বাঙালির বাড়ি আর বাড়ি!’ আমার তখনই মনে পড়ে, সে তো রাধেশ্যামও বলেছিল, পনিটুলার আখড়ার কীর্তনের সুর ছড়িয়ে যেত আখালিয়া থেকে ঝেরঝেরি পাড়া, বাগবাড়ি থেকে সুবিধ বাজার অবধি। তখন এইসব আবাদি মানুষের ভিড়-ভাট্টা শুরু হয় নাই। তখন এমন দালান-কোঠা-স্কুল-মার্কেট হয় নাই।
তাঁর কথা আমি মেনে নেই, কেননা আমার নিজের চোখের সামনেই পনিটুলায় নতুন মসজিদ হলো দুটো, মদিনা মার্কেটের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা মাদ্রাসার কেরাত প্রতিযোগিতায় হুজুর বিল্লাল হোসেন আমাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিল, সদ্য তোলা দালানের খিলান দেখেছিলাম, সে তুলনায় বড় শ্যাওলাধরা একতলা আখড়ার দালান। তবুও ওমন সরস্বতী পূজা আমি কোনো দিন দেখি নাই, যা পনিটুলায় দেখেছিলাম। বিদ্যার দেবীকে প্রকৃত অর্থেই বইয়ের পাহাড়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর হাতের কলম যেন বড় রাস্তায় ঠিকঠাক প্রবেশ করতে পারে, তাই বিশাল আকৃতির বাঁশ দিয়ে ঠেলে দেওয়া হলো মদিনা মার্কেটের ঝুলে থাকা ইলেকট্রিক তার।
রাধেশ্যামের বন্ধু এখলাস ছৈদ অনেক মিষ্টি কিনে বাড়িতে পাঠালো সেদিন। তাঁর মেজো ছেলের ছেলেটির আজ হাতেখড়ি হচ্ছে। এখলাস ছৈদ সবাইকে মিষ্টি খেতে জোরাজুরি করে, বলে, ‘একখানি খাইলা তো কিছু হইত না, আমাক্ক নাতির বিদ্যা হইছে না।’ এই রকম করে বললে আর ব্লাড-সুগারের দোহাই চলে না। আমরা সবাই বিদ্যার পথ সুগম করতে মহাআনন্দে মিষ্টি খাই। সেই ফেলে আসা স্মৃতি ভাবতে ভাবতে কখন জ্যামাইকার সার্টফিনের কালিমন্দির পেড়িয়েছি খেয়াল থাকে না, একটু সামনেই বায়তুল মামুর মসজিদ। হঠাৎ মনে হয়, এখন আমি কোথায়? কবে থেকে আমার পনিটুলার গল্প বলা শুরু হলো। সেদিন কী বার ছিল মনে নেই, তবে মতিনের চা-দোকানে বসেছিলাম। রুবেল মিয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, ‘ভাইজান, সিলট কুথায় আছিলা?’ আমি বলি, ‘পনিটুলায়।’ সে চমকে বলে, ‘পনিটুলায়ত! আমার লন্ডনি ভাই তো বাড়ি করছে বহুত দিন আগে, ছনু মিয়া।’ আমি সহসা চমকে যাই, ‘আরে! আপনি ছনু মিয়ার ভাই।’ রুবেল মিয়া কয়, ‘সেই সিলেট শহর আর নাইক্কা। তারাপুরের রাগিব আলির সেই দিন আর নাই, বয়স হইছে।’ সেই থেকেই আমার নতুন আড্ডায় ফিরে ফিরে আসে পনিটুলা।
বউমাকে এড়াতে হাঁটা শুরু করেছিলাম। রিকশাহীন এই শহরে হাঁটতে অভ্যস্ত হয়েছি, কত্তদূর এলাম! হঠাৎ নাকে মাছের কারির গন্ধ! তাকিয়ে দেখি লাউমাচায় ঢাকা একটি বাড়ি; সহসা মনে হয়, সিলেটের শুঁটকির সিরা! বেগুন, আলু আর শিমের সঙ্গে রসুন-আদা বাটা, হলুদ-মরিচে লইট্টা অনেকক্ষণ সেদ্ধ হয়ে ঘন হলেই এই ফ্লেভার হয়। কিন্তু আমি এতটা নিশ্চিত কেন― এই মাছের কারি, আমি যা ভাবছি, সেই কম্বিনেশনই! আজকাল আমি সুবাসে অনেক কিছু বুঝতে পারি। আলাদাভাবে গন্ধগুলো স্পষ্ট আমার কাছে।
এই তো সেদিন হিলসাইডের ঢালু পথে হাঁটছিলাম আমরা তিনজন। সহসা এক বাসা থেকে রান্নার তীব্র সুগন্ধে আনমনে বলে উঠেছিলাম―এই বাড়িতে কোনো ইন্ডিয়ান অধিবাসী থাকে। সাখাওয়াত সাহেব বললেন, ‘বুঝলেন কেমনে? দেখেছেন?’ ‘না ভাই, ঘ্রাণ পাচ্ছেন না? কারিপাতা আর পাঁচফোড়নের মিশেল, সম্ভবত সাম্ভার দিয়ে রান্না করছে।’ সাখাওয়াত সাহেব বলেন, ‘কী সংঘাতিক! আপনি তো ভাই ঘ্রাণ বিশারদ।’ আমার তখন বিভৎস এক গন্ধের কথা মনে পড়ে যায়, সেই তেরো সালে পনিটুলায় রাধেশ্যামের মিষ্টির দোকান পুড়ে গেল! আমি সেকথা বলতে চাই না। দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে বলি, ‘এ আর কঠিন কী! আপনি যখন প্রথম এলেন, তখন নিশ্চয় খুব খাবারের কষ্ট পেয়েছিলেন।’ সাখাওয়াত সাহেব বলেন, ‘বাঙালি গ্রোসারি ছিল নাকি? হাতে গোনা। মাছের জন্য তখন মন খুব কাঁদত। গরুর মাংস ছাড়া কোনো কিছুতেই স্বাদ পাইতাম না।’
এইসব আড্ডায় আমার নিউইর্য়কের জীবনে ফিরে ফিরে আসে গল্প। মনে পড়ে পনিটুলায় একবার রাধেশ্যাম তাঁর পরিবারের বানানো খিরসা সন্দেশ দিয়েছিল খেতে। আমি চমকে উঠেছিলাম― অবিকল আমার মায়ের হাতের খিরসার স্বাদ! সিলেটের কোনো খাবারই আমার নিজের পরিবারের খাবারের স্বাদের মতো মনে হতো না; সেই প্রথম একই স্বাদ পেয়েছিলাম, আমার মা যশোরের মানুষ ছিলেন। মায়ের রান্না করা কোরমা-পটল ভাজা আর সাদা পোলাউয়ের টেস্ট আমি আজও অনুভব করতে পারি। পটলের গাঁ অতো চিরোল করে কুঁচোতে, আর কেউ পারে বলে আমার মনে হয় না।
শুক্রবার, ভাবলাম একটু বেশি দূর হেঁটে জ্যামাইকা মসজিদে নামাজ পড়তে যাব। ফেরার পথে এক বাড়ি থেকে রান্নার সুবাস ভেসে এলো, আর সেই গন্ধে মনে হলো― এ বাড়িতে আইড় বা ক্যাটফিশ জাতীয় কোনো মাছ রান্না হচ্ছে। সে মাছের ঝোলে ফুরানি বাটা মসলা যোগ হয়েছে। যে কোনো মাছের ঝোলে সবচেয়ে শেষ অস্ত্র― এক চিমটি ফুরানি বাটা! আমার নানির কড়া শিক্ষায় মা শেষ বয়স পর্যন্ত তা করতেন।
আমি যে বাড়ি-বাড়ি রান্নার ঘ্রাণের এ সব ভাবনায় আজকাল ডুবে যাই, তা কাউকে বলি না। ছেলে-মেয়েরা জানলে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। বউমা হয়তো ভাববে, আমি তাঁর রান্নার বদনাম করছি। মেয়ে রেগে যাবে, কারণ সে যখন আমাকে দেখতে আসে সবসময় কোনো এক অভিমান সঙ্গে নিয়ে আসে, যেন বিরোধী পক্ষ। ছেলের সোজা হিসাব, সে আমাকে নিয়ে ছুটে যাবে নতুন কোনো ডাক্তারের কাছে। তার থেকে কাউকে কিছু না বলে নানা স্বাদের ঘ্রাণ বুঝে, না কি খুঁজে নেওয়া মন্দ কী! নিজের মনেই থাক― বরা আর পেঁয়াজুর গন্ধ ও স্বাদের তফাত। এ সব স্মৃতিকাতর ঘ্রাণের মাঝে বেঁচে থাকার সুখ সবাই বোঝে না।
যেবার প্রথম রাধেশ্যাম তাঁর বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল, সেই দিনটির কথা আমি ভুলি নাই। সেই যে একাত্তরে চপলা কিশোরী দিপালী, যে মুখে কালো কালি মেখে দিয়েছিল, যেন অন্ধকারে পাকসেনারা খুঁজে না পায় ফর্সা রঙের রাধেশ্যামকে। সেই যুদ্ধদিনে যার কপালে সিঁদুর এঁকে তাঁদের সংসার। সেই দিপালীর গল্প অনেক শুনেছি, দেখা হয়নি তখনও। সেদিন দুপুরে টেবিল ভর্তি খাবার সাজিয়ে বসেছিল সে। খাবার খেতে গিয়ে স্বভাব সুলভ কাকড়োল দেখে তুলে নিতে যাচ্ছিলাম, সহসা দিপালী ঘোষের বাধা আসে―আহা.. আহা.. কী করছেন? কণ্ঠ তখনও সুরেলা, রাধেশ্যাম বলেছিল, তাঁর স্ত্রীর গানের গলা ভালো। সে জানালো, সব কিছুর স্বাদ ঠিকঠাক পেতে হলে কোন আইটেমের পর কোন আইটেম নিতে হবে। স্বাভাবতই চিরকালীন অভ্যেসে ভাজি-কারি-ডাল এই পর্বান্ত মেনে খেতাম। কিন্তু সেদিন দিপালী তাঁর নিয়মে তুলে তুলে খাওয়ালেন। খুবই ভালো রান্না, তবুও খাবারের নিয়ম মেনে খেতে খেতে আমি স্বাদের তফাত পেলেও, খাওয়ার মজাটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
পনিটুলায় দেব পরিবারের সাথে সখ্য ছিল। একবার শ্যামাপূজায় দেবকুটিরে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল তারা। পনিটুলার সেই দেওয়ালিতে, দেবকুটিরের সামনের মঞ্চে শ্যামাসঙ্গীতসহ আধুনিক গানে ভরে উঠেছিল সন্ধ্যা, মহল্লাময় একই কালীমূর্তির ভিন্ন ভিন্ন অলঙ্করণে ফুটেছিল বৈচিত্রময় রূপ। এমন করে কালীপূজা দেখা সেই প্রথম। যদিও শ্রুত আছে, বাঙালির আসল পর্বই নাকি কালীপূজা! কিন্তু অশৈশব কালীমন্দিরের প্রতি আজানা ভয়, পাঁঠা বলি হয় বলে হয়ত! গুরুজনেরা কখনও ভয় দেখিয়ে থাকবে, আর কালী মূর্তি নিজেও যে রূপে এসে দাঁড়াতেন, তাতে ভয় হতো বৈকি! কিন্তু ভয়ের স্রোতে সেই ছেলেবেলায় পাঁঠাবলির কালো পাঁঠার সাথে কোরবানী ঈদের সাদা বা লাল গরু জবাইয়ের কোনো মিল খুঁজে পেতাম না। আজ এই পৌঢ় বয়সে এসে কত কথা মনে হয়!
নিজের শহর ছেড়েছি কত বছর হলো! হিসাব করলে পাওয়া যাবে জীবনের অর্ধেক বয়সেরও কম কেটেছে নিজ শহরে। রাধেশ্যাম বলেছিল, জয়ন্তিয়া ছেড়েছিল কৈশোর পেড়িয়ে। পনিটুলাতেই সে নিজের জীবনকে গড়েছিল, তবুও সহসা গল্পের ফাঁকে যখন আনমনা হয়ে যেত, তখন তাঁর চোখের তারায় ভেসে থাকা জয়ন্তিয়াকে আমিও দেখেছি! সে বলেছিল, সাতচল্লিশে তাঁর কাকা ইন্ডিয়া চলে যায়, একাত্তরে বাবা প্রাণকৃষ্ণ জয়ন্তিয়া ছাড়লে, ঠাকুরদা আর এক পিসি থেকে যায় সেখানে। কিন্তু এই কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার কেনো জানি মনে হয়, রাধেশ্যাম জয়ন্তিয়া ছাড়তে পারে নাই। লুকলুকি ফলের সাথে যত প্রেমই হোক, জালালি কৈতরের মন তাঁর; ছুটে যায় জয়ন্তিয়ায়। বাস্তুভিটার মায়া এক আদ্ভুত দাগ কেটে দেয় জীবনে।
আমার এখনও চৌরঙ্গি মোড়ের স্মৃতি জ্বলজ্বল করে। প্রকৃত উৎসব-আনন্দ বলতে সেই ঈদগাঁয়ের ঈদের জামাত। কোনো এক হারানোর বেদনায় রিনরিন করে বাজে। এই অনুভব আরও গাঢ় হলো নিউইর্য়কে এসে, প্রথমবার ঈদের নামাজে যাবার দিন। এমন ঈদ আমি কোনো দিন পাই নাই! আমার স্মৃতিতে ঈদ মানেই সারা শহর, সারা দেশ সেজে উঠবে উৎসবে। কিন্তু একি! শহরে তাকিয়ে মনে হলো আজ কোনো উৎসব নেই! নিজের নতুন পাঞ্জাবি-টুপিপড়া দেহকে বড় বেমানান লাগল; চারপাশে নিত্যদিনের ব্যস্ততা। সহসা অনুভব করলাম ঈদ জামাতের ছোট মাঠ আর যারযার ঘরের ভেতরে জমে উঠেছে ঈদ। এই প্রথম আমি অনুভব করলাম― এই শহরে আমি আগুন্তক, এক সংখ্যালঘু প্রাণ!
ক’দিন বাদে পার্কের আড্ডায় নিজের এই ঈদ অনুভব ব্যক্ত করতেই, উহু.. উহু করে বাধ সাধলেন সিদ্দীকী ভাই―‘আর বলেন কী! আমেরিকার মতো এমন স্বাধীন ধর্ম-কর্মের দেশ আপনি কোথাও পাবেন? মুসলমানদের জন্য এইটা স্বর্গরাষ্ট্র!’ আমি বিব্রতবোধ করি। তাঁর বলার ধরন যত অমায়িকই হোক না কেনো। সে ব্যাপক উৎসাহে বলতে থাকেন, ‘এবার রমজানে যে ৬৪ রোড থেকে ৬৬ রোড পর্যন্ত ব্লক দিয়ে তারাবির নামাজ হলো, তাতে কোনো সমস্যা হয়েছে? সারা রমজানে আল্লাহর রহমতে প্রচুর ইফতারের আয়োজন ছিল। এইসব ওই বাংলাদেশে কিছু মানুষের তৈরী শব্দ ‘সংখ্যালঘু’ বলেন, ওইসব রাজনীতি এইখানে চলে? পাবেন না।’ সিদ্দীকী সাহেব মসজিদ কমিটির একজন, তার কথা কেউ ফেলতে পারে না। আমার দ্বিধা কাটাতেই যেন মনে উঁকি দেয় সেই ভাবনা, আমাদের শহরে শরৎ সাহা কোনো দিন পুজোর সময় অভিযোগ তোলেনি; সাহা পরিবারে অঢেল আয়োজনে ওই পাড়াটি তো পূজায় জেগেই থাকত।
পনিটুলায় এত আয়োজনের পর কেন আমি প্রেমের গল্পটি শেষ করতে পারি না, জানি না। রাধেশ্যামের দোকান পুড়ে গেলে আমি সিঁদুরে মেঘের ভয়ে থাকি। আমার ঘ্রাণ সমস্যা নিয়ে কাউকে কিছু আজও বলিনি। রাধেশ্যাম সারাটা জীবন পনিটুলায় কাটিয়ে দিল। সে কি মিতালীকে না পাবার বেদনায়!
ব্যক্তিগত অনুভূতি কী আর সবাইকে জানানো যায়। তাই আমি ঘ্রাণ পাবার বিষয়টি চেপে যাই। আমার ঘ্রাণ শক্তি তো হারিয়েই ছিল সেই পনিটুলায়, রাধেশ্যামের মিষ্টিপোড়া গন্ধে। তবে তাও সেই কতদিন আগের কথা। আমি তখনো দেশ ছেড়ে নিউইয়র্কে আসিনি।
এই যে আনমনে এতটা পথ হেঁটে চলে আসলাম―কোন দিকে যাব? ভাবতে ভাবতে, হঠাৎ চোখ গেল সাবওয়ের কোণায়, নরসুন্দরের দোকান। আমি ঢুকে বসতে না বসতেই চমকে উঠলাম―মনিরাম! হাঁ, মনিরামই তো! রাধ্যেশ্যামের ছেলে। যে একসময় মদনমোহন কলেজে পড়ত। আজ তাঁর হাতে খুর আর কাঁচি। সে আমাকে চিনল কি না জানি না। চুল কাটতে কাটতে শুধু হাসিমুখে খাতির করে গেল। তাঁর হাতের নিপুণতা দেখে অবাক হলাম! সেই ছেলেটি, যে একসময় পনিটুলার ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকত, এখন নিউইয়র্কে দাঁড়িয়ে নতুন জীবন গড়ছে। চুল কাটার শেষে আয়নায় তাকালাম। মনে হলো, আয়নায় শুধু আমার চেহারাই নয়, পনিটুলার গল্পও ফিরে এসেছে।
জীবনের পথে পথে গল্পের নতুন পাঠ, আর আমি সেদিন বুঝলাম―পনিটুলা এখনো আমার ভেতরে বেঁচে আছে।