রিশিত খান : ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’র স্রষ্টা ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বকালের অন্যতম সেরা সংগীত পরিচালক নওশাদ আলী। বলিউডের সবচেয়ে হিট বেশ কিছু ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি। তার সুরের মধ্যে ছিল এক জাদুকরী মেজাজ। মেলোডি সুরকার হিসেবে তিনি অতুলনীয়।
নওশাদের জীবনে প্রথম সাফল্য আসে ১৯৪০ সালে। ওই বছর তার পরিচালিত একক সংগীত ‘প্রেম নগর’ ছবিটি মুক্তি পায়। তবে ‘রতন’ ছবির মাধ্যমে প্রথম তিনি জনপ্রিয়তার স্বাদ পান। ১৯৪৪ সালে ছবিটি মুক্তির পর গোটা ভারতবর্ষে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ফলে সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। শুধুই এগিয়ে যাবার পালা। একে একে কাজ করেন আনমুল ঘড়ি, (১৯৪৬), শাহজাহান (১৯৪৬), দরদ (১৯৪৭), আনোখি আদা (১৯৪৬), মেলা (১৯৪৮), আন্দাজ (১৯৪৭), চাঁদনি রাত (১৯৪৯), দিল্লাগি (১৯৪৯) প্রভৃতি সুপার হিট ফিল্মি গানে।
পঞ্চাশের দশকে সংগীত পরিচালক হিসেবে নওশাদ পৌঁছেছিলেন সাফল্যের শীর্ষে। একই সঙ্গে লতা মুঙ্গেশকরের পাশাপাশি মোহাম্মদ রফিককেও গড়ে তোলেন তিনি। তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেন বলিউডে। ফলে তার মৃত্যুতে বলিউডের সংগীতসম্রাজ্ঞী লতা মুঙ্গেশকর বলেছিলেন, ‘গান করার জন্য ১৯৪০ সালে তার কাছে যাই। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সংগীতস্রষ্টার একটি প্রজন্মের অবসান হলো। এ ছাড়া আমাদের চলচ্চিত্র জগতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের যে ধারা বহমান ছিল তারও অবসান হলো।’
নওশাদের সুরারোপিত ‘আন্দাজ’ ছবিটি সব দিক থেকে বিপ্লব ঘটিয়েছিল বলিউডে। ভাষা নির্মাণ ছাড়াও ফিল্মি সংগীতের ধারাকে পুরোপুরি বদলে দেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে তার সুরারোপিত গানের জন্য এখনো দর্শকপ্রিয় হয়ে আছে বাবুল (দোড় বাবুল কি ঘর), দাস্তান (তারা কি তারা রি), দিদার (বাপনে কি দিন, নসিব ডর পে তোর আজমানে আয়া হু), জাদু (লারা লু লারা লু), আন (আজ মেরে মন মে সখী মন মেরে আহসান, মহোব্বত চুমে জিনকে হাত), বেজুবাওয়া (তু গঙ্গা কি মউজ ও দুনিয়াকে রাখওয়ালে) অমর, (ইনসাফ কি মন্দির), উড়ান খাটোলা (ও দুরকে মুসাফির, মেরা আনাম লে জা, হামারে দিল মে না যানা, দুবা তারা উখি দোসে ছুট গায়া, চলে আজ তুম যাহা দে), বেয়াদরি (এসবির বানাত হু) প্রভৃতি ছবি।চলচ্চিত্রে হিন্দুস্তানি মার্গসংগীতের সার্থক ব্যবহারের জন্য নওশাদ বিশেষভাবে সুখ্যাত। এ ক্ষেত্রে তার দুটি অবিস্মরণীয় কীর্তি বেজুবাওয়া (১৯৫২) ও মুঘল-ই-আজম (১৯৬০), মুঘল-ই-আজম ছবির শুভ দিন আও, প্রেম যোগল কে সুন্দরী পিও চলি, মোহব্বত কি ঝুটি কাহানি পে রোয়ে, পেয়ার কি তো ডরনা কেয়া,...মোহব্বত জিন্দাবাদ এখনো এত দিন পরে সমান জনপ্রিয়। এর মধ্যে শেষোক্ত গানটি যুগ যুগ ধরে এ উপমহাদেশে প্রেমিক-প্রেমিকাকে সাহস ও অনুপ্রেরণা জুুগিয়েছে। এখনো মুখে মুখে ফেরে গানটি। পরবর্তী সময়ে মুঘল-ই-আজম বিশেষ ব্যবস্থায় রঙিন করা হয়। কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে মুক্তিও পেয়েছে পাকিস্তানে। এ উপলক্ষে নওশাদের পাকিস্তান যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য সেটা সম্ভব হয়নি।
নওশাদই প্রথম ভারতীয় উচ্চাঙ্গ ও উত্তর ভারতীয় লোকসংগীত চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করেন। এতে তিনি সফল হন। উচ্চাঙ্গ সংগীতের তার দখল ছিল। লখ্নৌর মানুষ হিসেবে ভারতের লোকজ সুরে ছিল তার দখল। এসব তার সংগীতের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। বস্তুত, তিনি সংগীতের ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ভেদরেখা মুছে ফেলেছেন। ভারতীয় সুরের সঙ্গে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রের সংমিশ্রণে এক অপূর্ব মায়াজাল তৈরি করতে পারতেন নওশাদ। তিনি জন্মেছিলেন লখ্নৌর এক গোড়া শিয়া মুসলিম পরিবারে। তবে তার সংগীতে পাওয়া যায় সর্বস্বরবাদিতার ছাপ।
মুসলমান মহররমের সুরের সঙ্গে হিন্দুদের ভজনের কথা তিনি নির্দ্বিধায় মিশিয়েছেন। আর এই দুইয়ের মিলনে তিনি সে মায়াজাল সৃষ্টি করতে পেরেছেন, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার বদলে তাতে মজে গেছে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোকই। নওশাদের জীবনসংগ্রাম অনেকটাই রূপকথার মতো। রক্ষণশীল শিয়া পরিবারে জন্ম হবার কারণে সংগীতচর্চা ছিল তার জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু সবকিছুকে অগ্রাহ্য করেছেন তিনি। সিনেমা দেখে রাত করে বাড়ি ফেলার জন্য কত যে মার খেয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। নির্বাক সিনেমার যুগে চলতে থাকা সিনেমার সঙ্গে বাজানো যন্ত্রীদলের বাদন দেখেই মূলত তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন সংগীতের প্রতি। আর তাই সংগীতজীবনের প্রথম বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়ামটি কিনেছেন স্থানীয় বাদ্যযন্ত্রের দোকানে কাজ করে। নওশাদের শুধু সংগীতের বিশাল পৃথিবীতে পথচলা শুরু হলো। বাবার অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও তিনি যোগ দিলেন লখ্নৌয়ের একটি অর্কেস্ট্রা দলে। একসময় বাড়ি থেকেই পালালেন শুধু সুরের খোঁজে। ওই সময়ে তিনি শিষ্য হয়েছেন ওস্তাদ গোরবত আলী, ওস্তাদ বাকান সাহেব, ওস্তাদ ইউসুফ আলীর মতো বিখ্যাত সুরসাধকদের। ১৯৩৭ সালে তিনি বোম্বে চলে আসেন। এখানে তাকে চরম অর্থকষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। না খেয়ে বহু রাত কেটেছে তার। ফুটপাতে ঘুমিয়েছেন। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর। ওই বয়সে তাকে রোজগারের জন্য পথে নামতে হয়। ভাগ্য অন্বেষণে নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে নওশাদের সঙ্গে পরিচয় হয় হ্যারি ডারউইটজের সঙ্গে, তিনি তখন ‘সমুন্দর’ নামে একটি ফিল্ম বানাচ্ছিলেন এবং গোয়ানিজ পিয়ানিস্টদের কাউকেই পাচ্ছিলেন না নিয়মিতভাবে। তিনি তার কলকাতার নিউ থিয়েটার্স থেকে আনা বিখ্যাত কম্পোজার মুশতাক হুসেনের অধীনে নওশাদকে ৪০ টাকা মাসোহারায় পিয়ানিস্ট নিয়োগ করলেন। এর পরও হেনরি ডারউইজ নামক জনৈক রাশান প্রডিউসার ফিল্ম সুনেহরি মাকড়ি ফিল্মের জন্য একটি গানের পিয়ানোর ওপর সুর দিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন নওশাদ। এই সময় সুপরিচিত সংগীত পরিচালক হরিশচন্দ্র বালি কোনো কারণবশত পতি পত্মী ফিল্মটি ছেড়ে চলে গেলে নওশাদ সেটির সংগীত পরিচালনার কাজটি পেলেন ৬০ টাকা মাসোহারায়। তার কাজ দেখে নওশাদকে সহকারী করে দিলেন খ্যাতিমান মুশতাক হোসেন। আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। শুধুই এগিয়ে যাবার পালা।
গীতিকার ডি এন মাঠোক পরিচালিত রণজিৎ মুভিটোনের পাঞ্জাবি ফিল্ম মির্জা সাহেবানের সংগীত পরিচালক মনোহর কাবুর নওশাদকে ৭৫ টাকা মাসোহারায় সহকারী করে নিলেন। ছবিটি সুপারহিট হবার সুবাদে রণজিৎ মুভিটোনের পার্মানেন্ট স্টাফ হয়ে গেলেন নওশাদ। এরপর ডাক পেলেন তানসেন মহলখ্যাত কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক খেমচাঁদ প্রকাশের সহকারী হবার, যাকে পরবর্তী সময়ে নওশাদ গুরু বলে মান্য করতেন। ১৯৪০ সালে নওশাদ স্বাধীন সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন প্রেম নগর ছবির মধ্য দিয়ে । এরপর একে একে অফার পেলেন দরশন (১৯৪১), মালা (১৯৪১), নয়া দুনিয়া (১৯৪২), স্টেশন মাস্টার (১৯৪২) এবং সারদা (১৯৪২) ছবির সংগীত পরিচালনার। তবে নওশাদকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায় ১৯৪৪ সালে রতন ছবির জন্য। ছবিটি ‘আসিয়া মেলাকে জিয়া ভারমাকে’, ‘সারওয়ান কে বাদলো’- এসব গান উপমহাদেশের সংগীত প্রেমিকদের মুখে মুখে ফিরত। এখনো ওই সব গানের জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমেনি। এরপর নওশাদের প্রতিটি ফিল্মই হিট কিংবা সুপার হিট হয়েছে।
১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের আমলে ভারতের যেটুকু সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল যেটুকুও ছিন্ন হয়ে যায়। ওই সময় বন্ধ হয়ে যায় ভারতের সিনেমা প্রদর্শনী। কিন্তু তত দিন দিদার, আন্দাজ, উড়াল, খাটোনা প্রভৃতি ছবির সুর প্রদেশের গ্রামে-গঞ্জে শহরের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। তারপর ভিসিডি, ভিসিআর এবং পরবর্তী সময়ে টিভি চ্যানেলগুলো আর কোনো বাধা মানেনি।
নওশাদ তার বর্ণাঢ্য জীবনে ৬৭টি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে ২৫টি রজতজয়ন্তী, ৯টি সুবর্ণজয়ন্তী এবং ২টি হীরকজয়ন্তীর গৌরব অর্জন করে। সংগীতে অবদানের জন্য নওশাদকে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাম ‘পদ্মভূষণে’ ভূষিত করা হয়। ১৯৮২ সালে তিনি দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারেও ভূষিত হন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে তার আজীবন অবদানের জন্য ওই পুরস্কার দেওয়া হয়।
বলিউডের অনন্য এই সুরস্রষ্টা ছয় দশকের বেশি সময় কাজ করে অতুলনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার শিখরে অবস্থান করেও নিজের সৃষ্টি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তার ওই অসন্তুষ্টি প্রকাশ পেয়েছে। বিবিসি হিন্দি বিভাগকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শ্রেষ্ঠ সংগীতটি তিনি এখনো দিতে পারেননি।
নওশাদ আলীর জন্ম লখ্নৌতে, ১৯১৯ নালের ২৫ ডিসেম্বর। মুম্বাইয়ের নানাবতী হাসপাতালে তার জীবনাবসান ঘটে ২০০৬ সালের ৫ মে।
বলিউডের কিংবদন্তিপ্রতিম সুরকার তিনি। কিন্তু তিনি সমান জনপ্রিয়, সমান শ্রদ্ধেয় আমাদের দেশেও। সমান জনপ্রিয় পাকিস্তানেও। শ্রদ্ধেয় এই উপমহাদেশের মানুষের কাছে।
মেলোডির স্রষ্টা নওশাদ আলীর তাই মৃত্যু নেই। তিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন সংগীতপ্রেমিকদের হৃদয়ে। লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪/রিশিত/কমল কর্মকার