শিল্প ও সাহিত্য

বিটিভি’র সুবর্ণজয়ন্তী এবং আমার কিছু স্মৃতি || নওয়াজীশ আলী খান

১৯৬৬ সাল। পাকিস্তান আমল। করাচির বিখ্যাত ‘ডন’ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে দরখাস্ত করলাম। তখন আমি করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আসলে কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শ ও কিছুটা জোর-জবরদস্তির কারণেই দরখাস্ত করেছিলাম। জবরদস্তির মূল কারণ ছিল টেলিভিশন সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা। তখন পর্যন্ত চর্ম-চক্ষু দ্বারা টেলিভিশন অবলোকন করা সম্ভব হয়নি। কখনও কখনও সিনেমার পর্দায় টেলিভিশন নামের চতুষ্কোণ বাক্সটি দেখেছি মাত্র। দরখাস্তের পর সাক্ষাৎকার দিতে হলো- একবার নয়, দুবার নয়, তিন তিনবার! এরপর চাকরিপ্রাপ্তির চিঠি পেলাম। আমাকে বলা হলো, রাওয়ালপিন্ডি ইসলামাবাদ টেলিভিশন কেন্দ্রে অবস্থিত সেন্ট্রাল টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য। কিছুদিন পর দ্বিতীয়বারের মতো পত্র পেলাম। সেটি পড়ে জানলাম এবার প্রশিক্ষণ নিতে হবে লাহোর টেলিভিশনে। সুতরাং গেলাম লাহোর। টেলিভিশন কেন্দ্র দেখলাম। স্টুডিও দেখলাম। কিন্তু থাকার ব্যবস্থা কোথায়? নিজস্ব আয়োজনে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হলো। স্থান করে নিলাম লাহোর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছাত্র জিয়াউদ্দিন তারেক আলীর হোস্টেল কক্ষে। বর্তমানে তিনি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের সম্মানিত ট্রাস্টি। তার আরেকটা পরিচয় হলো, তিনি সেই ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনবদ্য ছায়াছবি ‘মুক্তির গান’ এর একজন নেতৃস্থানীয় অংশগ্রহণকারী।তিন মাস লাহোরে প্রশিক্ষণ শেষে রাওয়ালপিন্ডির চাকলালায় অবস্থিত সেন্ট্রাল টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নেয়ার নির্দেশ পেলাম। সেখানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বেশ দূরে আবাসিক হোটেল। বেশ কিছু বাঙালি ইতিমধ্যে সেখানে থাকেন। এই মুহূর্তে যাদের নাম মনে পড়ছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সৈয়দ সিদ্দিক হোসেন, আতিকুল হক চৌধুরী, মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ, শিল্প নির্দেশক মহিউদ্দিন ফারুক, শামসুল ইসলাম এবং চিত্রগ্রাহক মাজহারুল ইসলাম ও গিয়াস উদ্দিন এবং সাখিনা সারওয়ার প্রমুখ।

 

প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৭ সালের ২৬ নভেম্বর করাচি টেলিভিশনে পোস্টিং হলো। সেখানে যোগ দিয়ে গানের অনুষ্ঠান ও শিক্ষামূলক ‘বাংলা বলুন’ অনুষ্ঠান প্রযোজনার দায়িত্ব পেলাম। ‘বাংলা বলুন’ ডাইরেক্ট মেথডে বাংলা শেখানোর অনুষ্ঠান। অর্থাৎ বাংলা ভাষার মাধ্যমেই বাংলা শেখানো। উপস্থাপনা করতেন বিখ্যাত  চলচ্চিত্র নির্মাতা ও এফডিসি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাজির আহমেদ। তার সঙ্গে সহযোগিতা করতেন আন্দালিব আলী। কিছু অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন ফেরদৌসি মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার ও শিশুশিল্পী ফারাহ খান মজলিস (বর্তমানে ফারাহ কবির)। বিখ্যাত ইংরেজি পত্রিকা ‘ডন’ এই অনুষ্ঠান নিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।এভাবেই একটি বছর কেটে গেল। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। এরপর সাধারণ নির্বাচন হলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করল। এই ৭০ সালে একবার ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রে অনুষ্ঠান পরিবেশনা শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমাকে পাঠানো হলো। সে সময় ডিআইটি ভবনে (বর্তমানে রাজউক ভবন) ছিল ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র। এই প্রথম এখানে আসা। কেউ একজন একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন খালেদা ফাহমী, আবদুল্লাহ আল মামুন, আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমা, মোহাম্মদ জাকারিয়া ও মমিনুল হক সাহেবের সঙ্গে। এদের প্রথম চারজনই আজ প্রয়াত হয়েছেন। কক্ষটি ছিল নিচতলায়। দোতলায় আরেকটি কক্ষে সাক্ষাৎ পেলাম সৈয়দ সিদ্দিক হোসেন (প্রয়াত), মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ, সাখিনা সারওয়ার, বদরুন্নেসা আব্দুল্লাহ প্রমুখের সঙ্গে।

 

স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। স্টুডিও দেখে হতবাক! একটি মাত্র কক্ষ। দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট, প্রস্থ ১৫ ফুট, উচ্চতা হবে প্রায় ১২ ফুট। এখানে পরিচিত হলাম তিনজন (সবেধন নীলমণি) চিত্রগ্রাহক রফিকুল বারী চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা এবং সৈয়দ মাহমুদ আহমেদের সঙ্গে। তখনই মনে হলো এটা অবিচার! একই সময়ে পাকিস্তানের লাহোর টেলিভিশন কেন্দ্র নিজস্ব ভবনে, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ নিজস্ব ভবনে এবং যে কেন্দ্রে বিগত প্রায় তিন বছর ধরে কাজ করছি সেই করাচি টেলিভিশন কেন্দ্রেও প্রত্যেক প্রযোজকের জন্য কক্ষ, প্রত্যেক শিল্প নির্দেশকের জন্য কক্ষ, ক্যামেরাম্যানদের জন্য কক্ষ রয়েছে। শুধু তাই নয়, মেকাপ-এর জন্য চমৎকার কক্ষসহ একাধিক মহড়া কক্ষও রয়েছে। এর পাশাপাশি বড় ধরনের সেটের জন্য স্পেস, নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, বার্তা বিভাগের জন্য অনেকগুলো কক্ষ তো রয়েছেই। অর্থাৎ আধুনিক টেলিভিশনের যা যা প্রয়োজন সবই সেখানে বিদ্যমান। আর ঢাকার ডিআইটি ভবনের ভাড়া করা একটি ছোট স্টুডিও এবং কয়েকটি মাত্র কক্ষ নিয়ে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র!সেখানে শিল্প নির্দেশকের জন্য কোনো জায়গাই নেই। সেট রাখার স্থান নেই। মহড়ার জন্য ক্ষুদ্র একটি কামড়া, সম্পাদনার জন্য ছোট্ট একটি খুপড়ি। যে ছোট তথাকথিত স্টুডিওটি বিদ্যমান, এর সঙ্গেই ছোট একটি কক্ষে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি রাখা। এ ধরনের অকল্পনীয় সীমাবদ্ধতার মধ্যে যাদের নাম বলা হলো, তারা অক্লান্ত পরিশ্রমে অসম্ভব সব সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড সম্পাদন করেছেন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বসার কোনো ব্যবস্থাই নেই। পাশের আরেকটি দালানে প্রধান কার্যালয় এবং বিজ্ঞাপন বিভাগ। জামিল চৌধুরী, মনিরুল আলম, মোস্তফা মনোয়ার, সালাউদ্দিন চৌধুরী, হুমায়ুন চৌধুরী, নওশের আলী, আবদুল ওয়াহেদ, এসডি খান প্রমুখের সুযোগ্য নেতৃত্ব এবং কিছু সংখ্যক উদ্যমী, গুণী, সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের অসামান্য তৎপরতা, দক্ষতা, সৃজনশীলতায় টেলিভিশন অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল একটি উচ্চমানের শিল্পকর্ম। শিল্পকর্মের কথায় মনে পড়ে গেল প্রয়াত এমদাদ হোসেনের কথা। আনোয়ার হোসেন, কেরামত মওলা, মহিউদ্দিন ফারুকের নামটাও উল্লেখযোগ্য। অসামান্য অবদান এসব কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গের। এই ছোট একটি স্টুডিওতে ৭০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সব অনুষ্ঠানই প্রচার হতো সরাসরি। অভাবনীয় হলেও সত্য যে, এই ক্ষুদ্র কক্ষ থেকেই সংবাদ, শিশুতোষ অনুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, সংগীতানুষ্ঠান, নাট্যানুষ্ঠানসহ সাক্ষাৎকারমূলক সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার হতো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা শুধু আশ্চর্য ব্যাপরই নয়, অকল্পনীয়ও বটে। এখান থেকেই মোস্তফা মনোয়ারের স্বর্ণস্পর্শে নির্মিত হয়েছে ‘ঋতুর রঙে আঁকা’, ‘আলী বাবা’সহ অসংখ্য প্রথম শ্রেণির টিলিভিশন অনুষ্ঠান। এই ছোট স্টুডিও এবং ডিআইটি ভবনের প্রবেশ স্থানে (বারান্দায়) নির্মিত হয়েছিল অনবদ্য নাটক ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’। অভিনয় গুণে, শিল্প নির্দেশনায়, আলোক সম্পাত, শব্দ সংযোজন এবং নিপুণ সম্পাদনায় এই অসাধারণ শিল্পকর্মটি এখনও বিস্ময়ের উদ্রেক করে।ইতিমধ্যে রামপুরায় তৈরি হচ্ছিল আধুনিক টেলিভিশন ভবন। এরই মধ্যে দেশ স্বাধীন হয় এবং ১৯৭২ সালে এ দেশের অসাধারণ জনপ্রিয় এই প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ টিলিভিশন’। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশে আসার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগদান করার সুযোগ পাই। সৌভাগ্য মানতে হয়, এই সময় তৎকালীন শ্রেষ্ঠ সব শিল্পীদের অনুষ্ঠান নির্মাণের সুযোগ হয়েছিল ডিআইটি ভবনের ছোট স্টুডিওতে। পশ্চিমবঙ্গের সুবিখ্যাত শিল্পীগণ প্রতিনিয়তই ঢাকায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাদের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড তুলে ধরতেন। এদের অধিকাংশই ছিলেন সংগীতশিল্পী। কয়েকজন অসাধারণ ও জনপ্রিয় শিল্পীর অনুষ্ঠান নির্মাণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সকলের নাম স্মরণ করা যাচ্ছে না। তবে কয়েকজনের কথা ভুলিনি- সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, সাগর সেন প্রমুখ।১৯৭৪ সালের পর অনুষ্ঠান ও বার্তা সম্প্রচারে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশলের প্রয়োগ শুরু হয়। এর ফল হয় অত্যন্ত ইতিবাচক। এখান থেকেই শুরু হয় আমাদের অগ্রযাত্রা। একের পর এক অনবদ্য অনুষ্ঠান নির্মিত হতে থাকে সুকৌশলী নির্মাতা, শিল্প নির্দেশক, চিত্রগ্রাহক, প্রকৌশলীবৃন্দের অক্লান্ত পরিশ্রম, ধৈর্য্য, নিষ্ঠা এবং উচ্চ শিল্পবোধের কারণে। টেলিভিশন অনুষ্ঠানের এমন কোনো শাখা নেই যা এই সুদক্ষ কর্মীবাহিনীর স্পর্শে সোনার ফসল হয়ে ওঠেনি। পারফর্মিং আর্টের সব শাখাগুলো যেমন নৃত্য, সংগীত, আবৃত্তি, নাট্যানুষ্ঠান, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানসহ প্রামাণ্য, খেলাধুলা এবং বিশাল বিশাল সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান শিল্পগুণে সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের কারণেই বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে এ দেশে এক ধরনের অদৃশ্য বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। টেলিভিশন শুরুর আগে নৃত্য, সংগীত, নাটক এগুলো সীমিতভাবে মঞ্চে, বৈঠকখানায়, ঘরে পরিবেশিত হতো। টেলিভিশন আসার ফলে এই শিল্প মাধ্যমগুলো পেশাদারিত্ব লাভের ক্ষেত্রে এগিয়ে যায়। গণমানুষের বাড়িতে, শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে এ সমস্ত শিল্পকর্ম। প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, ছাত্রছাত্রী অনুশীলনের সুযোগ পায়, পায় প্রশিক্ষণের সুযোগ। এক সময় টেলিভিশনের পর্দায় তাদের কাজ উঠে আসে। হাজার হাজার সংগীত সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী আর নৃত্যশিল্পীর। পারফর্মিং আর্টের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানে, গঞ্জে ও শহরে। তৈরি হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী। তাদের উচ্চমানের পরিবেশনার জন্য বিদেশে বাংলাদেশি শিল্প সংস্কৃতির প্রসার ঘটে, সুনাম অর্জিত হয়। দেশের মুখ উজ্জ্বল হয়। আজ দেশে হাজার হাজার সংগীত শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, নাট্যশিল্পী। অনেকেই আজ এসব শিল্পমাধ্যমকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং তার সংখ্যা মোটেই নগন্য নয়। নাটকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ টেলিভিশন নিশ্চিত একটা বিপ্লব ঘটিয়েছে। টেলিভিশনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলী। নাটক এখন ইন্ড্রাস্টিতে পরিণত হয়েছে। এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে টেলিভিশন নাটককে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হচ্ছে এই নাটক। আশির দশক বিটিভি’র স্বর্ণযুগ। এই যুগের প্রধান শাখা নাটক। যেগুলো এক ঘণ্টার নাটক থেকে শুরু করে মাসিক নাটক হিসেবেও দীর্ঘ ব্যাপ্তিকালে পরিচিত ছিল। সে সময় সিরিয়াল হিসেবে প্রচারিত নাটকের নাম এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। প্রথিতযশা নাট্যনির্মাতাগণ কালের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া শিল্পোত্তীর্ণ নাট্যানুষ্ঠান নির্মাণ করে লক্ষ-কোটি টেলিভিশন দর্শকদের আনন্দ দিয়েছেন, মুগ্ধ করেছেন। ‘রক্তকরবী’র মতো (মোস্তফা মনোয়ার পরিচালিত) আন্তর্জাতিক মানের নাটক এ অঞ্চলে খুব বেশি নির্মিত হয়নি। ‘সংশপ্তক’-এর মতো সামাজিক বিশ্লেষণধর্মী সিরিজ নাটক এখনও অনেকেরই স্মরণে সমুজ্জল। আধুনিক নাটকের জগতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি উজ্জ্বল অবিসংবাদিত নাম- হুমায়ূন আহমেদ। টেলিভিশন নাটকের জীবন তিনি শুরু করেছিলেন বিটিভি থেকে। ‘প্রথম প্রহর’ দিয়ে শুরু করে অসংখ্য দর্শকপ্রিয় একক নাটকের নাট্যকার তিনি। সিরিজ নাটকে তার তুলনা মেলা ভার। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’ তাঁর অমর সৃষ্টি। এসব নাটক নির্মাণের সঙ্গে জড়িত স্বনামধন্য নির্মাতাগণ শ্রদ্ধার পাত্র। এদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান, বরকতউল্লাহ অগ্রগণ্য। এমনও হয়েছে এসব নাটকের কোনো একটি চরিত্রের মৃত্যু যাতে না হয় সে জন্য অসংখ্য চিঠিপত্র এসেছে। মিছিল হয়েছে। সংশ্লিষ্ট নাট্যকার ও নির্মাতার বাড়িতে বোমাবাজি হয়েছে। কেউ কোথাও নেই সিরিজে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি যেন না হয় সেজন্য শহর-বন্দর, পাড়ায় মিছিল করে দাবি জানানো হয়েছে এবং দাবি না মানায় ক্ষুব্ধ দর্শক ক্ষোভ জানানোর জন্য নির্মাতা ও নাট্যকারের বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করেছে। ‘বহুব্রীহি’ সিরিজের প্রধান চরিত্র ডাক্তারকে সহজ-সরল, বোকা ডাক্তার হিসেবে দেখানোর জন্য তৎকালীন অনেক যুবক ডাক্তার নাট্যকার ও প্রযোজককে চিকিৎসা না করার হুমকি দিয়েছে। এ সমস্তই বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটকের জনপ্রিয়তার সুস্পষ্ট লক্ষণ।এমনও শোনা যায় সে সময় বাংলাদেশ টিলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্তবর্তীরা বড় বড় বাঁশ বা গাছের মগডালে অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল, ঢাকনা দিয়ে এন্টেনা বানিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করতো। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিপরিষদের কোনো কোনো সদস্য তাদের কর্মসূচি তৈরি করতেন বিটিভি’র নাটক সম্প্রচারের সময় মাথায় রেখে (শোনা কথা)। তবে এটা শোনা কথা নয়, ওই সময় বিশেষ বিশেষ সিরিজ প্রচারের দিনগুলোতে ঢাকার রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়তো। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত (আমার নিজের এমন অভিজ্ঞতা আছে)।

 

বাংলাদেশ টেলিভিশন উচ্চ মানের অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য একাধিকবার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সেই সুনাম ও অনুষ্ঠানের সুউচ্চ মান এখন নেই বলে শোনা যায়। তথ্যটি অসত্য বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। অনুষ্ঠানের মান নিম্নগামী। পরিকল্পনা দুর্বল। পরিবেশনা অনুজ্জ্বল। নির্মাণ নিম্নমানের। বিষয়বস্তু অনাধুনিক এবং অসময়োপযোগী। এ কালের দর্শকদের চাহিদা মেটানোর মতো  তেমন কিছু নেই- এ অভিযোগ অনেকেরই। দর্শক ধরে রাখার মতো উজ্জ্বল অনুষ্ঠান দেখা যায় না। যদিও অনুষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে, সম্প্রচার পরিধিও অনেক, সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন ঘটেছে, যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা নেই, লোকবলের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে, স্টুডিও অনেকগুলো হয়েছে, কাজ করার সুযোগ অনেক বেশি; তাহলে অনুষ্ঠানের মান উন্নত নয় কেন? বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে এ বিষয়টি সকলের ভাবনায় থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়।লেখক : অনুষ্ঠান উপদেষ্টা, এটিএন বাংলা।

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ডিসেম্বর ২০১৪/তাপস রায়