শিল্প ও সাহিত্য

বাংলা চলচ্চিত্রে প্রেম || চিন্ময় মুৎসুদ্দী

বাংলা চলচ্চিত্রের শুরুই প্রেম দিয়ে। সেটা মানব মানবীর প্রেম। কলকাতা বা ঢাকা- এ ক্ষেত্রে পার্থক্য নেই। সেই ধারা এখনো অব্যাহত। আজো প্রেম ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র কল্পনা করা যায় না। এটিই এখনো বাংলা সিনেমার গল্পের প্রধান ধারা। ঢাকায় হালে মুক্তি পাওয়া নয়া যান্ত্রিক কৌশলের ছবি জিরো ডিগ্রি কিংবা ডিজিটাল ফরমেটের ভালবাসার রঙ অথবা একটু নয়া আমেজের বৃহন্নলা সবখানেই প্রেম প্রধান হয়ে আছে। প্রেমের পরিণতিও সবখানে প্রায় এক, মানে মিলন বা পরিণয়। হালের ছবির এসব প্রেম চোখ ছুঁয়ে যায়, মন ছুঁয়ে না গেলেও।

গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করা হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। এই দিনটিকে মানব মানবীর নিছক মন দেওয়া নেওয়ার মধ্যে বেঁধে ফেলেছে আমাদের নব প্রজন্ম। আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতারা এর মধ্য থেকে নতুন কোনো বিষয়  তুলে আনতে পারেননি। সাধু ভ্যালেন্টাইন যে অর্থে প্রেমের মহিমা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সেই পরিপ্রেক্ষিত বাস্তবে আমরা দেখি না; চলচ্চিত্রেও না। সাধুর প্রত্যাশা ছিল প্রেমের জয়ের মধ্য দিয়ে একটি মমতাময়ী জগৎ, হানাহানি মুক্ত একটি প্রেমময় পৃথিবী। কিন্তু তার সেই আশা পূরণ হয়নি। আমাদের চলচ্চিত্রেও সেই দৃশ্যকাব্য আনতে উদ্যোগী হননি কেউ। ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপিত হয়, কিন্তু এর উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামান না বলেই আমার মনে হয়।প্রেমের আবেদন চিরস্থায়ী করার একটা চেষ্টা দেখেছিলাম সেই ১৯৬০-এর দশকে। কৌতুকাভিনেতা থেকে পরিচালক হয়ে সুতরাং ছবিতে সুভাষ দত্ত প্রেমকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন ঢাকার চলচ্চিত্রে বিয়োগান্তক পরিণতি দেখিয়ে। সে কারণে ছবিটি বিশিষ্ট হয়ে আছে। এত বছর পরও সুতরাং-এর সেই সাধারণ গ্রাম্য যুবক আর হাসিখুশি কিশোরীর ট্র্যাজেডির কথা মনে হলে সেই সব দর্শকদের হৃদয়ে বেদনা জাগে। যেভাবে কলকাতার সেই সময়ের শিল্পী ছবির দরিদ্র ভাস্কর আর ধনীর দুলালী’র জন্য কষ্ট পায় দর্শকরা। বাংলা চলচ্চিত্রের গল্পে প্রেমের উপাদান প্রায় একই রকম থাকলেও দেখানোর মাঝে নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছেন পরিচালকরা। সে দিক থেকে প্রেমের দৃশ্যে একটা পরিবর্তন অবশ্য এসেছে। তখন প্রেমের দৃশ্য ছিল হাতে হাত ধরে একটু ছুঁয়ে দেখা আর শেষ দিকে বুকে মাথা রেখে মিলনের বার্তা দেওয়া। সেটা ষাটের দশকের কথা। কলকাতায় উত্তম-সুচিত্রার মিলন ও বিরহের প্রেম আর ঢাকায় শবনম-রহমানের একই পরিণতির প্রেম।

গান তখনও ছিল, এখনও আছে।  গানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রগরগে নাচের মুদ্রা আর আইটেম গার্লের  সমাবেশ। এই নাচের জন্য এখন ভ্যাম্প চরিত্রের দরকার পড়ে না, নায়িকা নিজেই তা পূরণ করে দেন নেতৃত্ব দিয়ে। এখন আমরা দেখি নতুন শতকের পর্দা-কুশিলবরা আর আগের মতো মিন মিন করে না। অবস্থা বুঝে প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। আর নিজেরাও অত রাখঢাক করে না। প্ল্যাটনিক প্রেম ছাড়িয়ে যৌনতার আমেজ আনতে তারা আর দ্বিধা করে না। নাচের মুদ্রা আর গানের কথায় সেটা বেশ ভালো করেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়। কলকাতা অবশ্য ঢাকার চেয়ে বেশি এগিয়েছে। এক পাওলি দাম যে সাহস দেখিয়েছেন সম্প্রতি সেটা মুম্বাই বা হলিউডের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। ঢাকায় একবার চুম্বনের দৃশ্য গ্রহণ করা হয়েছিল অনন্ত প্রেম ছবির জন্য। রাজ্জাক-ববিতার সেই চুম্বন দৃশ্য আমজনতার কাছে চলমান প্রক্রিয়ায় পৌঁছাবার সাহস করেননি তারা শেষ পর্যন্ত। সেন্সরে দেওয়ার আগেই দৃশ্যটি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। কেবল পত্রিকায় এর স্থির দৃশ্য দেখেছেন পাঠকরা। বর্তমানে তারকারা প্রস্তুত থাকলেও প্রযোজক-পরিচালকরা এখনও চুম্বন দৃশ্য ধারণ করে সেন্সর বোর্ডকে চ্যালেঞ্জ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেননি। রাজ্জাক তখন বাদ দিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি কারণে। প্রথমত তিনি নিশ্চিত ছিলেন ঠোঁটে ঠোঁটে চুম্বন দৃশ্য সেন্সর বোর্ড রাখবে না। কেটেই দেবে। দ্বিতীয়ত বোর্ড সেটা রাখলে নিজেরা সমাজে বিব্রত হবেন এমন আশঙ্কাও ছিল রাজ্জাক-ববিতার। রাজ্জাক আরো চিন্তা করেছিলেন তার স্ত্রী, মেয়ে ও ছেলেরা সে দৃশ্য ভালোভাবে গ্রহণ না করলে পারিবারিক জীবনে একটা মনস্তাত্বিক সংকট তৈরি হবে। মিডিয়ায় এবং ব্যক্তিগত আলোচনায় রাজ্জাক এ ধরনের মতামত প্রকাশ করেছিলেন।

প্রেম শাশ্বত, প্রেম ঐশ্বরিক, প্রেম জৈবিক এমন নানান বিশেষণে দেখা হয় প্রেম। তবে চলচ্চিত্রের পর্দায় প্রেম অধিকাংশ ক্ষেত্রে জৈবিক।  মানব মানবীর প্ল্যাটনিক প্রেমেও শারীরিক চাহিদা থাকে যা দমন করা হয় বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। সেন্সর বোর্ডের ভয়ে আর সামাজিক অনুমোদন না পাওয়ার আশঙ্কায় ঢাকায় ছবির পর্দায় প্রেমের চরম পরিণতির ব্যাপারটি ইঙ্গিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। জড়াজড়ি, ঢলাঢলি, চাপাচাপি দেখিয়ে ক্ষান্ত থাকেন পরিচালকরা। জীবনের বাস্তবতা স্বাভাবিকভাবে পর্দায় স্থান পায় না। বেডরুমেও গলায় ভারি গহনা জড়িয়ে জামদানী শাড়ি পরে বসে থাকা বা ঘুমিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। গল্পে ভিন্নতা না থাকলেও সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র লোকেশনের সৌন্দর্য দর্শক টানছে, বিশেষ করে ডিজিটাল ছবিগুলো। তবে নতুন শতকের পঞ্চদশ বর্ষে এ কথা বলা যায়, নতুন চিন্তা ভাবনা নিয়ে নবীন পরিচালকদের কেউ কেউ প্রেম বিষয়টিকে আরো ব্যাপক অর্থে উপস্থাপনের প্রয়াস নেওয়ার চেষ্টা করছেন। গত বছরের আমি শুধু চেয়েছি তোমাকে, মাসখানেক আগের রোমিও বনাম জুলিয়েট পারিপার্শ্বিক আয়োজনে দর্শকদের ভুলিয়েছে। রোম্যান্টিক আমেজে হৃদয়গ্রাহি করে তুলতে পারলে প্রেম শাশ্বত আবেদন নিয়েই দর্শকদের কাছে জাগরুক থাকবে। রোম্যান হলিডে তাই আজো দর্শকের মনে ঝড় তোলে, ডিজিটাল যুগের তারুণ্যকে আকৃষ্ট করে। এ রকম চলচ্চিত্র পৃথিবীর বহু দেশে সময়ে সময়ে তৈরি হয়েছে। কেবল বাংলাদেশে এর সংখ্যা সীমিত। প্রেমের ছবির আবেদন চিরকালীন যদি চলচ্চিত্রের ব্যাঞ্জনায় তা স্পষ্ট করা যায় কুশলী নির্মাণের ধারায়।রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫/তাপস রায়