বৈশাখ ১৪২৬

যে ঐতিহ্য এখনো টিকে আছে স্বমহিমায়

নিজস্ব প্রতিবেদক : সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজেরও ব্যপক পরিবর্তন ঘটেছে। গড়ে উঠেছে নগর ভিত্তিক সমাজ। কালের বিবর্তনে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলে আসা অনেক ঐতিহ্যও হারিয়ে যাওয়ার পথে। কিন্তু কিছু ঐতিহ্যের শিকড় এতো গভীরে যে আধুনিকতার শত ঝাঁপটায়ও টিকে আছে। তেমনি বাঙালির এক চির ঐতিহ্যর নাম হালখাতা।  আগের মতো হালখাতার এতো ব্যাপকতা না থাকলেও   এখনো  টিকে আছে স্বমহিমায়। বাংলা নববর্ষের অবিচ্ছেদ্য  অংশ হালখাতা। বাংলা সন চালু হওয়ার পর নববর্ষ উদ্‌যাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে হালখাতা দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা ও গভীর সম্পর্কের প্রকাশ ঘটত হালখাতার মাধ্যমে। এটা ছিল সৌজন্য প্রকাশের এক ঐতিহ্য। চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব বকেয়া পরিশোধ করা এবং পরবর্তী দিন পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিক ও ব্যবসায়ীরা তাদের প্রজা ও পণ্য ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে নতুন বছরের হিসাব শুরু করতেন। দেশের গ্রাম অঞ্চলে এখনো হালখাতার প্রচলন রয়েছে। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মহলেও রয়েছে হালখাতার চল। যদিও তত ব্যাপকতা নেই।  বিশেষ করে স্বর্ণকারের মধ্যে হালখাতা করার প্রবণতা রয়ে গেছে। শাঁখারীবাজার, তাঁতিবাজার, ফরাশগঞ্জ, বাদামতলী, ইমামগঞ্জ, চকবাজারে ব্যবসায়ীরা ছোট পরিসরে হলেও হালখাতা করেন। বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ এটা অনুসরণ করে চলেছেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান   বলেন, ‘বাংলা সন চালু হওয়ার পর নববর্ষ উদ্‌যাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পয়লা বৈশাখের দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান ছিল হালখাতা।’ তিনি বলেন, ‘এখন মানুষের হাতে নগদ অর্থের অভাব নেই। এখন আর আগের মতো পরিস্থিতি নেই। সমাজের বিশাল বিবর্তন ঘটেছে। গ্রাম-বাংলার জনজীবনেও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কেউ কাউকে চেনেন না। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে সরে গিয়ে নগরভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠেছে, শিল্প বিকশিত হচ্ছে। সবার হাতে কম-বেশি নগদ অর্থ আছে এখন। তাই হালখাতা পালনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।’ হালখাতার প্রচলন : বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে উৎসব, নববর্ষ’, সাদ উর রহমানের ‘উৎসবের ঢাকা’ বই এবং ঢাকা কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, মোগল আমলে খাজনা আদায় করা হতো হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে। কিন্তু হিজরি বর্ষপঞ্জি চন্দ্র মাসের হিসাবে চলার কারণে এখানে কৃষি খাজনা আদায়ে অসুবিধা হতো। খাজনা আদায়ের শৃঙ্খলা আনা ও প্রজাদের অনুরোধে মোঘল সম্রাট আকবর বিখ্যাত জ্যোতিষবিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে বাংলা সালের সংস্কার আনার নির্দেশ দেন। তিনি সেই নির্দেশ অনুসারে হিন্দু সৌর ও হিজরি পঞ্জিকা বিশ্লেষণ করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম নির্ধারণ করেন। বাংলা সালের ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত মনে করেন ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করেন। আধুনিক গবেষকদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, আকবর সর্বভারতীয় যে ইলাহী সন প্রবর্তন করেছিলেন তার ভিত্তিতেই বাংলায় আকবরের কোনো প্রতিনিধি বা মুসলমান সুলতান বা নবাব বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সে জন্য একে ‘সন’ বা ‘সাল’ বলা হয়। ‘সন’ কথাটি আরবি, আর ‘সাল’ হলো ফারসি। প্রথমে এ সালের নাম রাখা হয়েছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর চৈত্র মাসের শেষ দিনে (সংক্রান্তি) জমিদারি সেরেস্তারা প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করতেন। এ সময় প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাসুল বা কর পরিশোধ করা হতো। এর পরের দিন পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকেরা নিজেদের অঞ্চলের প্রজা বা অধিবাসীদের মিষ্টি, মিষ্টান্ন, পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। একই ধারাবাহিকতায় ১৬১০ সালে মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে ঢাকায় সুবেদার ইসলাম খান চিশতি তাঁর বাসভবনের সামনে প্রজাদের শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ ও উৎসবের আয়োজন করেন। খাজনা আদায় ও হিসাব নিকাশের পাশাপাশি চলত মেলা, গান বাজনা ও হালখাতা অনুষ্ঠান। এভাবেই হালখাতার প্রচলন হয়।

       

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ এপ্রিল ২০১৯/মেহেদী/ইভা