সারা বাংলা

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে উদ্বেগ বাড়ছে

সুজাউদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার : কক্সবাজারসহ সারাদেশে বসবাসকারী মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।

 

যদিও উখিয়া ও টেকনাফে রয়েছে দুটি রেজিস্ট্রার্ড রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। তার কাছেই রয়েছে আরো দুটি অনিবন্ধিত ক্যাম্প। যেখানে রয়েছে দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

 

এর বাইরেও তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে বলে প্রচার করা হলেও এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।

 

এ সংখ্যা নির্ধারণে পরিসংখ্যান ব্যুরোর অধীনে কিছুদিন আগে শেষ হলো রোহিঙ্গা শুমারি। এ শুমারির ফল এখনো প্রকাশ হয়নি। এই পরিস্থিতির মধ্যে নতুন অনুপ্রবেশে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে।

 

স্থানীয় সাধারণ মানুষের দাবি, রোহিঙ্গারা ভয়ংকর। এরা এমন কোনো অপরাধ নেই যা করতে পারেন না। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে এ সব রোহিঙ্গা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নানা অপরাধে জড়িত রয়েছেন।

 

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এইচআরডিএফের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট অরূপ বড়ূয়া তপু জানান, অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক ব্যবসার পাশাপাশি আদম পাচারের মতো ঘৃণ্য বাণিজ্যও চালিয়ে আসছেন তারা। হত্যা, চুরি, ডাকাতি ও অপহরণসহ অন্যান্য অপরাধেও তারা জড়িত বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত করেছেন।

 

এ পরিস্থিতিতে নতুন করে রোহিঙ্গা প্রবেশ উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও মানবিক বিবেচনায় এদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। তবু তাদের ব্যাপারে সজাগ থাকা জরুরি।

 

এই আইনজীবীর বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায় সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাও। চলতি বছরের ৫ জুলাই রাতে বাড়ি ঢুকে টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রাক্তন ইউপি মো. সিরাজুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। একই সময় আরো দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিমকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করা হয়। পরে আবদুল হাকিমকে আসামি করায় মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে মো. ফারুককে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

 

মো. ফারুক জানান, তার বাবাকে হত্যার পর থেকে সংঘবদ্ধ রোহিঙ্গা ডাকাতরা তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা তাকে যে কোনো সময় হত্যা করতে পারে। এ নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। এমন কি তিনি ঘর থেকে বের হতেও ভয় পান এখন।

 

চলতি বছরের ১৩ মে রাতে  টেকনাফ নয়াপাড়ার রেজিস্ট্রার্ডকৃত রোহিঙ্গা শিবিরের আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আনসার কমান্ডার আলী হোসেনকে গুলি করা হয়। এ সময় হামলাকারীরা ১১টি অস্ত্র ও ৬০০ গুলি লুট করেছিল। দীর্ঘদিনেও সেই লুণ্ঠিত অস্ত্র-গুলি উদ্ধার করা যায়নি। এ ঘটনার ব্যাপারে টেকনাফ থানায় দায়ের করা মামলায় সন্দেহজনক অনেককেই আটক করা হয়েছিল। মামলায় আটক স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল আবছার নামে এক ব্যক্তি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দাবি করে, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সক্রিয় সদস্যরাই পরিকল্পিতভাবে আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট করে মিয়ানমারে নিয়ে গেছে।

 

এ ঘটনার সঙ্গেও রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম জড়িত ছিল জানান স্থানীয় লোকজন। গত ২০১৫ সালের ১২ জুন পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত মো. সেলিম ওরফে মুন্ডি সেলিমকেও গুলি করে হত্যা করেছিল রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম। এতে তাকে প্রধান আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করা হয়।

 

টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল মজিদ জানান, রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিমকে ধরার জন্য পুলিশ বেশ কয়েকবার পাহাড়ে অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে সে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা করলে তাকে দ্রুত ধরা সম্ভব হবে।

 

তিনি আরো বলেন, বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বিভিন্ন অপরাধামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তবে পুলিশের অভিযান জোরদার করা হয়েছে।

 

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রাক্তন সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, যে হারে রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে এতে আমরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছি। কেননা রোহিঙ্গারা আগে থেকে আমাদের দেশে বোঝা হয়ে আছে। এর মধ্যে আবার নতুন করে রোহিঙ্গা ঢুকছে। তাছাড়া রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপরাধামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এতে আমরা খুবই আতংকের মধ্যে রয়েছি।

 

রামুর খুনিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল মাবুদ জানান, সম্প্রতি মিয়ানমারের সংঘাতময় পরিস্থিতি আবারো নতুন করে ঘটেছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা। যারা অনিবন্ধিত ক্যাম্পের পাশাপাশি নানা স্থানে অবস্থান করছে। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সংস্থার ধারণা নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। যদিও এ নিয়ে কোনো জরিপ নেই। তবে এটা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

 

তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের একটি নির্ধারিত স্থানে অবস্থান করা জরুরি। অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায় রোহিঙ্গারা আমাদের দেশের জন্য জটিল সমস্যা।

 

এই পরিপ্রক্ষিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণসহ নানা পরার্মশ কক্সবাজারের বিশিষ্টজনদের। মানবপাচার বিরোধী জেলা টাস্কফোর্সের সদস্য দিদারুল আলম রাশেদ জানান, রোহিঙ্গাদের মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। এখন সরকারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে এদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় কক্সবাজারসহ অন্যান্য স্থানে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়বে। যা দেশের জন্য অমঙ্গল হবে।

 

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনা এ সময়ের একমাত্র দাবি। এদের নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এরা নতুন করে আমাদের দেশেও সমস্যা তৈরি করতে পারে।

   

রাইজিংবিডি/কক্সবাজার/৩ ডিসেম্বর ২০১৬/সুজাউদ্দিন রুবেল/রুহুল