সারা বাংলা

হাকালুকিতে হাহাকার

হোসাইন আহমদ, হাকালুকি থেকে ফিরে : হাকালুকিতে এখন হাহাকার চলছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এই হাওরের কুলাউড়া উপজেলার  মানুষ । বসত ঘর তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউ চলে গেছেন কেউ দূর-দূরান্তে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে । এদিকে, সরকারিভাবে বন্যার্তদের মাঝে যে সাহায্য বিতরণ করা হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। যা বিতরণ হচ্ছে, তাতেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ । পানিবন্দি মানুষ  বলছেন, জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তাদের পছন্দের লোকদের মধ্যে  বিতরণ করছেন। অন্যদিকে যারা অনিয়ম করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি  দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। হাকালুকি হাওরের ঘাটের বাজারে গেলে দেখা যায়, বাজারের মধ্যখানে উপরে টিন বেষ্টিত খোলা ঘরের চতুর্দিকে পর্দার বেড়া দিয়ে গত ১৫ দিন ২০-২৫টি পরিবার মানবেতর বসবাস করছে। আলাপকালে ওই আশ্রয় কেন্দ্রের বাসিন্দা আছিয়া বেগম, জুলেখা বেগম ও লিলু বেগম জানান, ঘরে পানি ওঠায় বাধ্য হয়ে বাচ্চাদের নিয়ে এখানে এসেছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় খাবার, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না। সরকারি ত্রাণ সামগ্রীও তাদের দেওয়া হচ্ছে না। বন্যায় এলাকায় কাজ না থাকায় তার স্বামী বেকার দিন কাটাচ্ছেন। হাতে নেই কোনো টাকাও। খেয়ে না খেয়ে দিনকাল কাটাচ্ছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে সরকারি ত্রাণ নিতে আসা মীরশংকর গ্রামের কালা মিয়া জানান, কাউকে একাধিকবার দেওয়া হচ্ছে, আর কেউ একবারও পাচ্ছে না। জনপ্রতিনিধিরা তাদের আত্মীয়-স্বজন দেখে এবং নির্বাচনের সময় যারা তাদের ভোট দিয়েছেন তাদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। এ সময় লিলা বেগম নামের একজন নারী জানান, গত ৩ দিন ধরে জ্বর, কিন্তু বারবার ধর্ণা দিয়েও সরকারি  কোনো ওষুধ পাচ্ছেন না।

হাকালুকি হাওর পারের ভুকশিমইল ইউনিয়নের কোরবানপুর, গৌড়করণ, মদনগৌরী, জালালপুর, কাইরচড়, মাঝরগাঁও, বাদে ভুকশিমইল, নোয়াকোনা, জাব্দা, শশারকান্দি, কালেশার, শিলারকান্দি, পশ্চিম বাদে ভুকশিমইল, মুক্তাজিপুরসহ আরো বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশেরও বেশি মানুষের বসত ঘরে পানি, অনেকের টিউবওয়েল তলিয়ে গেছে, ওই গ্রামগুলোর প্রতিটি প্রাইমারি স্কুল-মাদ্রাসা ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় তলিয়ে যাওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যা কবলিত ওই গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক পরিবার নৌকা দিয়ে অন্যত্র থেকে কলসি দিয়ে পানি আনছেন। এ ছাড়া মসজিদে পানি থাকায় গ্রামের মুসল্লিরাও ছাদে অথবা  অন্যত্র নামাজ আদায় করছেন। বন্যায় অধিকাংশ পরিবারের টয়লেট তলিয়ে যাওয়ায় এক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে খোলা জায়গায় পায়খানা করছেন। এতে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এলাকার গর্ভবর্তী নারীরাও পর্যাপ্ত খাবার ও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ওই এলাকার স্বচ্ছল কোনো মানুষই শহর বা বাজারে যাতায়াত করতে পারছেন না। ফলে তাদের মধ্যে দৈনন্দিন খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, তলিয়ে গেছে জেলার ৩৩টি ইউনিয়ন এবং ৭২২টি গ্রাম। বন্যার্তদের জন্য খোলা হয়েছে ৩৩টি আশ্রয় কেন্দ্র। এতে জেলার বিভিন্ন এলাকার ৯৫১টি পরিবার বসবাস করছে। গতকাল জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে বন্যা কবলিত পরিবারের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম ও পুলিশ সুপার মো. শাহ জালাল। এসময়  ভুকশিমইল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি সব মানুষের হাতে সরকারি সাহায্য পৌঁছে দিতে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় কম থাকায় সকলের হাতে দেওয়া যাচ্ছে না।’

   

রাইজিংবিডি/মৌলভীবাজার/৫ জুলাই ২০১৭/হোসাইন আহমদ/টিপু