সারা বাংলা

ইটভাটায় ঝুঁকি বাড়লেও মজুরি বাড়েনি

নিজস্ব প্রতিবেদক, টাঙ্গাইল : ইটভাটার কাজে ঝুঁকি বাড়লেও ভাটা শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। রোদে পুড়ে যাদের কঠোর শ্রমে আধুনিক সভ্যতার দালান-কোঠা নির্মাণের ইট তৈরি হচ্ছে, তারা মজুরি পাচ্ছেন সেই পুরনো নিয়মেই। স্বল্প মজুরির পাশাপাশি বছরের ছয়মাস ইটভাটা বন্ধ থাকায় জীবিকার জন্য করতে হয় অন্য কোনো কাজ। বইতে হয় দুর্বিষহ জীবনের বোঝা। তারপরও বার বার তারা ফিরে আসেন এই পেশায়। তেমনই এক ইটের কারিগর আব্দুল হামিদ। গত ২০ বছর ধরে কাজ করছেন টাঙ্গাইলের বাসাইলের বিবিএল নামক ভাটায়। নিজের কারিগরি দক্ষতায় জীবনে ইট বানিয়েছেন অনেক। কিন্তু সেই ইট নিজের বাড়ি বানাতে কাজে লাগেনি কখনো। ইট শ্রমিকদের জীবন যাত্রা নিয়ে তিনি বললেন অনেক কথা। তিনি বলেন, ‘গত ২০ বছর ধরে বছরের ৬ মাস্ আমি ইট ভাটায় কাজ করছি। দু’হাত দিয়ে লক্ষ লক্ষ ইট বানিয়েছি। আর সেই ইট গিয়েছে অন্যের বাড়ির উপকরণ হিসেবে। কিন্তু এতো ইট বানিয়েও কখনো নিজের বাড়ির ইট বানানোর সৌভাগ্য হয়নি। এখানে কাজ করে যে মজুরি পাই, সেই টাকা দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোন রকম ডাল-ভাত খেয়ে জীবন চলে। অর্থের অভাবে তিন ছেলে-মেয়েকেও লেখাপড়া করাতে পারিনি।’ তিনি বলেন, ‘নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ইট ভাটায় কাজ করি। আর বাকি সময় অন্যের ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাই।’ আলামিন নামের অপর এক শ্রমিক জানান, তিনি বাবার হাত ধরে ১০ বছর আগে নাম লিখিয়েছেন এই পেশায়। এতগুলো বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় দ্বিগুণ হলেও মজুরি বেড়েছে খুব সামান্য। আলাপ হয় আব্দুল হামিদ আর আলামিনের মতো টাঙ্গাইলের আরও অনেক ইট শ্রমিকের সঙ্গে। তাদেরও সেই একই ভাষ্য, বছরের ৬ মাস ভাটাগুলোতে পুরোদমে কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে হয় তাদের। আর বাকি ৬ মাস কেউ খেতে কাজ করেন, আবার কেউ বা রিক্সা, ভ্যান, ভাড়ায় অটোরিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। আবার অনেকে বেছে নেন রাজমিস্ত্রির জোগালি কিংবা দিনমজুরির কাজ।

 

শ্রমিকরা জানান, নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ইট বানানোর কাজ করতে হয় তাদের। আর এই কাজটি চুক্তিতে হয়ে থাকে। ভাটায় কাজ করতে আসতে হয় সর্দারের মাধ্যমে। পুরো ৬ মাসের জন্য সর্দারই শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তি করেন। কাজ শুরু হওয়ার আগে সর্দার কিছু টাকা অগ্রীম দিয়ে শ্রমিককে দাদন দিয়ে রাখেন। ইট বানানোর কারিগরদের দেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি টাকা।  ৬ মাসের জন্য কারিগর প্রতিদিন ১৬-১৭ ঘন্টা কাজ করে ১ লাখ, জোগালি ৪৫ হাজার, আগাটক ৮০ থেকে ৯০ হাজার, গোড়ারটক ৭০ থেকে ৮০ হাজার এবং মাটি বহনকারী ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। আবার প্রতিদিন কাজ শেষে দেওয়া হয় খোরাকি। সাতদিনে এই খোরাকি জনপ্রতি শ্রমিক পান ৩০০-৫০০ টাকা করে। শ্রমিকরা জানান, দুই শিফটে কাজ করতে হয় তাদের। ফজরের আযানের পর পরই শুরু হয় তাদের কর্মজীবন। চলে দুপুর পর্যন্ত। সামান্য বিরতি দিয়ে সন্ধ্যা ৭-৮ টা পর্যন্ত তাদের কাজ চলে। তাদের মাঝে ভাগ করে কয়েকজন দিনে কয়েকঘন্টা বিশ্রামের সুযোগ পান। বিনিময়ে তাদের কাজ চলে সারা রাত। ভাটার পাশেই টিনের ঘর তুলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন ভাটা মালিক। সেখানে নিজেরা তিনবেলা রান্না করে খাবারের ব্যবস্থা করেন। ইট ভাটাগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, কেউ মাটি কাটছেন। কেউ সেই মাটি এনে এক বিভিন্ন যায়গায় জড়ো করছেন। আবার কেউ সেই মাটি কাটের ছাঁচে ভরে ইটের আকারে সাজিয়ে যাচ্ছেন। রোদে পুড়ে সেই ইট শক্ত হলে কেউ কেউ তা ভ্যানে করে একস্থানে জড়ো করছেন। তারপর সেখান থেকে কয়েকজন কয়লার ভাটায় ছেড়ে ইট পুড়ছেন। এরপর সেই ইট জড়ো করা হচ্ছে বিক্রির জন্য। পুরুষদের পাশাপাশি নারী ও শিশুদেরও কাজ করতে দেখা যায় এই সকল ইট ভাটায়। শুধু নারীরাই নয়, ১৩ বছর বয়সী আশিক নামের এক শিশু শ্রমিকের দেখা মেলে এক ইট ভাটায়। স্কুল ছেড়ে তিন সপ্তাহ ধরে ইট বানানোর কাজে যোগ দিয়েছে সে। স্কুল ভালো না লাগায় পরিবারের অভাবের সংসারে আশার আলো ফোঁটাতে তার এই পেশায় আগমন বলে জানায় সে। এদিকে ভাটা মালিকরা বলছেন, সর্দারের মাধ্যমেই তারা শ্রমিক পেয়ে থাকেন তারা। তবে ভাটা মালিক হলেও তাদের লাভের পরিমাণ সামান্যই। তাই শ্রমিকদের মজুরিও বাড়াতে পারেন না তারা। টাঙ্গাইলের বাসাইলের বিবিএল ব্রিকস এর স্বত্ত্বাধিকারী হযরত আলী জানান, ১৪-১৫ ঘন্টা করে কাজ করে ইট শ্রমিকরা যে মজুরি পেয়ে থাকে, তা খুব সামান্যই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির সাথে এই মজুরিতে পাল্লা দেওয়া খুব কষ্টের। কিন্তু তারপরও ইচ্ছে থাকলেও তাদের জন্য কিছু করার সুযোগ থাকে না। ভাটা মালিক হলেও সব খরচ বাদ দিয়ে তাদের লাভের অংকটা খুব বেশি হয়না। 

   

রাইজিংবিডি/টাঙ্গাইল/১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/শাহরিয়ার সিফাত/টিপু