সারা বাংলা

মায়ের কাছে এখনো জীবন্ত ত্বকী

নিজস্ব প্রতিবেদক, নারায়ণগঞ্জ : পাঁচ বছর ধরে দৃশ্যমান উপস্থিতি না থাকলেও, মা রওনক রেহানার কাছে এখনো জীবন্ত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ত্বকীর সঙ্গে কথা বলেন তারই লেখা কবিতার মাধ্যমে। নীরবে নিভৃতে বসে ত্বকীর খাতায় লেখা কবিতাগুলো পড়েন মা রেহানা। এখনো তার চারপাশে ত্বকীর চলাফেরা অনুভব করেন পুত্রহারা এই মা। ত্বকীর সম্পর্কে এই প্রতিবেদকের কথা হচ্ছিল তার মা রেহানা রওনকের সঙ্গে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ‘ছোট্ট একটা শিশুকে তারা বড় হতে দিল না।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে ধরা গলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্য এমনটা হচ্ছে। যারা ক্ষমতায় আছে তারাই তো বিচার করবে। বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সরকারের কাছে ত্বকী হত্যার বিচারের জন্য এখনো আমি তাকিয়ে আছি।’ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ত্বকীর পরিবার এ জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছে। ত্বকী হত্যাকাণ্ডের বিচারে প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি। তিনি বলেন, ‘সব কিছু প্রমাণ হওয়ার পরও ত্বকী হত্যার বিচার হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক একটি দেশে এটি কোনো সুবিচার হতে পারে না। সব কিছু প্রমাণ হওয়ার পরেও আমার কাছে মনে হয়, হয়ত সরকার এই মামলা সমাধানের ব্যাপারে উদাসীন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের কোনো সমাধান কোনো দিনই হবে না। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময় তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘শিশু হত্যাকারী ঘৃণ্য জীব’ তাহলে আমার মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে ত্বকী হত্যার বিচার কেন হচ্ছে না।’ ত্বকী হত্যার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব ২০১৪ সালের ৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, ত্বকী হত্যাকাণ্ডে ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। অচিরেই তা আদালতে পেশ করা হবে। এরপর চার বছর পেরিয়ে গেলেও অভিযোগপত্র দিতে পারেনি। প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দেন তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার। তিনি ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে আসেন জেলা পুলিশের এক অনুষ্ঠানে। এ সময় তিনি বলেন, ত্বকী হত্যাকাণ্ড গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমি র‌্যাবের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি। তদন্ত শেষ হলে দ্রুততম সময়ে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। নাগরিক সামাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য হলেও ত্বকী হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া প্রয়োজন। নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটি সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, ‘ত্বকী হত্যার বিচার প্রাপ্তির জন্য আমাদের এখনো আন্দোলন করতে হচ্ছে। আমরা চাই না এই আন্দোলনের দীর্ঘ হোক। ত্বকী হত্যাকাণ্ডের বিচার বিলম্বিত বা এই বিচার না হওয়ার মাশুল বর্তমান সরকারকেই দিতে হবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে। মানুষ অবশ্যই এই সময় তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ নেবে।’ মানবাধিকার কর্মী আইনজীবী মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বন্ধ হওয়ার কারণ এটিই প্রমাণ করে যে, একটি প্রভাবশালী পরিবার এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সব কিছু স্পষ্ট। তারপরেও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া আমাদের হতাশ করে। আসন্ন নির্বাচনে ত্বকী হত্যার বিচারটি ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। আমি আশা করি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই হত্যার বিচার অচিরেই হবে।’ পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও নারায়ণগঞ্জের আলোচিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জে নিজ বাসার কাছ থেকে অপহৃত হয় ত্বকী। দুদিন পর ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে পুলিশ উদ্ধার করে তার নিথর দেহ। ঘটনার ১২ দিন পর ২০ মার্চ পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্তার অভিযোগে রিফান বিন ওসমানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়। অন্যদিকে একই দিন রফিউর রাব্বি পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত চিঠি দিয়ে শামীম ওসমানসহ ৭ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চান। রফিউর রাব্বির আবেদনে হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ত্বকী হত্যা মামলাটি গত ২০ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) কাছে হস্তান্তর করে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ। তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার আসামি সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কেএম মহিউদ্দিনের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে উঠে এসেছে ত্বকী হত্যার বিস্তারিত বিবরণ। নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বেই ত্বকীকে খুন করা হয়েছে বলে ভ্রমর জানান। ওই বছরের ১১ নভেম্বর রাত দেড়টায় রূপগঞ্জ থেকে ভ্রমরকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এ মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাব-১১ এর সিইও লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান বলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মামলা। এ বিষয়ে র‌্যাবের ঢাকার কর্তৃপক্ষ জানাবে। আমরা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। এদিকে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে প্রতি মাসের ৬ তারিখে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ বা অন্য কোনো সংগঠন প্রতীকী কর্মসূচি পালন করে। কেবল নারায়ণগঞ্জে নয় দেশের আর কোথাও কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে এভাবে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করার নজির নেই। নানান কারণে নারায়ণগঞ্জের এই হত্যাকাণ্ডটি এখনো সাধারণ মানুষকে বেশ প্রভাবিত করেছে। কর্মসূচি :

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ৫ বছর উপলক্ষে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় বন্দর ঘাট থেকে বন্দর সিরাজ শাহ এর আস্তানায় ত্বকীর কবর জিয়ারত ও ফাতেহা পাঠ অনুষ্ঠিত হবে। ৭ মার্চ বুধবার বিকেল ৩টায় নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিশু সমাবেশ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, শিক্ষাবিদ ড. হায়াৎ মামুদসহ অনেকে। ৮ মার্চ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার ৫ বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। ৯ মার্চ শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টায় নারায়ণগঞ্জ শহরের দুই নম্বর রেলগেট চত্বরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। রাইজিংবিডি/নারায়ণগঞ্জ/৬ মার্চ ২০১৮/হাসান উল রাকিব/এসএন