সারা বাংলা

মর্মস্পর্শী বীরাঙ্গনা আনোয়ারা গাঁথা

পটুয়াখালী সংবাদদাতা : স্বাধীনতা অর্জনের সপ্তাহকাল মাত্র পার হয়েছে। দেখা গেল পটুয়াখালী পৌর শহরের পুরাতন আদালত প্রাঙ্গণে ১৮-২০ জন অর্ধবসনা কিশোরী মাটিতে লুটিয়ে রয়েছে। ওদের বয়স ১২-১৫ এর কোঠায়। কারো জ্ঞান আছে, কেউ জ্ঞানহীন, কেউ সামান্য নড়াচড়া করছে। পতিত ওই কিশোরীদের গায়ে উড়ছে মশা-মাছি। পাশেই আরো এক কিশোরীর শুকিয়ে যাওয়া রক্তাক্ত বসনের গন্ধ শুঁকছে কয়েকটি কুকুর। দৃশ্যটি চোখে পড়ে সদ্য মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরা আনছার আলী নামে এক যুবকের। সন্ত্রস্ত মনে এগিয়ে যায় আনছার। দেখে রক্তাক্ত কিশোরীর সর্বাঙ্গেই ক্ষত। তার অবস্থা খুবই গুরুতর। আনছার আদালতপাড়া সংলগ্ন হোটেল মালিক মানিক মিয়াকে গিয়ে ঘটনা জানায়। তাদের বুঝতে বাকি থাকেনা যে, এরা পাকবাহিনী দ্বারা নির্যাতিত। মানিক মিয়া আনছারকে ষাট টাকা দিয়ে গুরুতর আহত কিশোরীকে সাহায্য করার পরামর্শ দেয়। তার পাশেই আরেক হোটেল মালিক মজিদ নাইয়াও কিশোরীটিকে সাহায্যের জন্য আনছারকে ষাট টাকা দেন। কিশোরীটির ক্ষত থেকে এতটাই দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে যে, কাছে যাওয়ার জো নাই। মজিদ মিয়ার হোটেলের এক নারী পরিচারিকা দিয়ে কিশোরীটিকে পার্শ্ববর্তী লাউকাঠি নদীতে গোসল করিয়ে কাপড় পড়ানো হয়। ১২০ টাকা সম্বলেই আনছার কিশোরীটিকে নিয়ে সন্ধ্যায় রওনা হন বরিশালের পথে। বরিশাল পৌঁছে ক্যাপ্টেন নাজির ক্লিনিকে ভর্তি করান। খাবার এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ছাড়াও দৈনিক ৭৫ পয়সা ক্লিনিকের বেড ভাড়া পরিশোধ করতে হতো আনছারকে। চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে হিমশিম খান আনছার। দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। দীর্ঘ দেড় মাস চিকিৎসার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। মৃত্যুর শঙ্কা কেটে যাওয়ার পরে বরিশালের নাজিরের পুল এলাকার রেনুবালা নামে এক নারীর বাসায় কিশোরীকে রেখে আনছার আলী পটুয়াখালীতে আসেন। ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সহপাঠিদের সাথে যোগ দিয়ে স্বাভাবিক জীবন শুরু করার প্রস্তুতি নেন। যুদ্ধে বিজয় লাভের পর তখন গোটা দখিনের জনপদে হাহাকার। বাতাসে লাশের গন্ধ। কর্মহীন হয়ে পরে অনেক পরিবার। খান মোশাররফ (পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক), সরদার রশিদ (সাবেক এমপি)সহ একাধিক যোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে আনছারকে নিয়ে আনছার বাহিনী গঠন করে র্নিযাতিত এবং ক্ষতিগ্রস্থ্ পরিবারগুলোকে দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়। গোটা শহরের লঙ্গরখানা, আটা-লবন সরবরাহ এবং শহরের নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করে আনছার বাহিনী। চার মাস পরে আব্দুল সালাম নামে আরো এক যুদ্ধাহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা করাতে বরিশালের একই ক্লিনিকে নিয়ে যান আনছার। সেখানে পৌঁছে মনে পড়ে কিশোরীটির কথা। সাড়ে পাঁচ মাস পরে কিশোরী তার পরিচয় বলতে সক্ষম হয়। তার নাম আনোয়ারা। বরগুনার পাথরঘাটায় তার জন্ম। আনোয়ারাকে নিয়ে আসেন পটুয়াখালীতে। সেখান থেকে সেদিন সন্ধ্যায়ই লঞ্চযোগে পাথরঘাটার উদ্দেশ্যে রওনা হন আনছার। নদী পথে ১২ ঘন্টা সময়ে আনোয়ারার শিশু থেকে কৈশোর জীবনের বর্ণনা শোনেন আনছার। আনোয়ারা বরগুনায় পৌঁছে প্রথমে যান নানীর কাছে। পরে যান পাথরঘাটার নিজ বাড়িতে। আনোয়ারা জানান, প্রসবকালেই পৃথিবী থেকেই বিদায় নেয় মা হাজেরা বেগম। পিতা মজিদ আকন একমাত্র শিশু আনোয়ারাকে তার বোন কাঞ্চন বালার কাছে রেখে যশোরে একটি পাটের মিলে কাজ নেয়। দীর্ঘ আট বছর পরে মেয়ের কথা মনে পড়লে বাড়িতে আসেন মজিদ। পাথরঘাটা ওয়ারলেস অফিস সংলগ্ন ২০০ টাকায় কেনা জমির উপর তোলা গোলপাতার ঘরটি এক ভিক্ষুককে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে যান যশোরে। তখন আনোয়ারার বয়স সাত থেকে আটের কোঠায়। বছর পাঁচেক যেতেই পিতা মজিদ অসুস্থ্ হয়ে মারা যায়। এরপর ১৩ বছর বয়সী আনোয়রা যশোরে এক নব দম্পতির বাসায় ঝিয়ের কাজ নেয়। ওই খানে কেটে যায় তার দুই বছর। এরপর শুরু হয় যুদ্ধ। স্থানীয়দের সাথে আনোয়ারাও পালিয়ে আশ্রয় নেয় অচেনা কোন গাঁয়ে। অনাহারে-অর্ধহারে কাটে এক-দেড় মাস। সেখানের পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে পটুয়াখালী-বরগুনার বাসিন্দারা বড় নৌকা ভাড়া করে মধ্যরাতে পাড়ি জমায় পটুয়াখালী-বরগুনা উদ্দেশ্যে। মাঝপথে নৌকা ত্যাগ করে স্টিমারে বাকেরগঞ্জের কলসকাঠিতে আসেন। সেখান থেকে নদীর পাড় ধরে পটুয়াখালীর প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করেন অন্তত দেড় মাস। তখন স্বাধীনতা অর্জনের দেড় মাস বাকি। একটি নৌকায় লাউকাঠি, কচাবুনিয়া নদী অতিক্রম করে পায়রা নদীতে পড়ার সাথে সাথেই রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক বাহিনীর হাতে আটক হয় নৌকা ভর্তি ত্রিশজন নারী-পুরুষ। নৌকা থেকে ৮-১০ জন কিশোরীকে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে আসে শহরের পুরাতন জেল খানায়। আনোয়ারা ওই জেলখানার কক্ষে পৌঁছে দেখেন, অন্তত শতাধিক কিশোরী সেখানে বন্ধী। এরপর আনোয়ারা ওপর চলে পাকসেনাদের অমানুষিক নির্যাতন। আনোয়ারার বর্ণনা শুনতে শুনতে লঞ্চটি পাথরঘাটা লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছায়। আনোয়ারাকে নিয়ে পাথরঘাটার বসত বাড়িতে যান। কিন্তু সে বাড়ি অন্যের দখলে। বাড়িতে ঠাঁই না হওয়ায় আনোয়ারাকে নিয়ে বরগুনা শহরের এক বন্ধুর কাছে আসেন আনছার। পরিস্থিতির কথা ভেবে অবিবাহিত যুবক-যুবতিকে জায়গা দিতে  রাজি নন বন্ধু। শরনাপন্ন হন বন্ধুর ছোট ভাই’র (এসডিওর গাড়িচালক)। তারও একই কথা। এমন অসহায়ত্বে কান্নায় ভেঙে পড়েন আনোয়ারা। কান্না দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন আনছার। উপায়ান্তর না পেয়ে আনোয়ারাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন আনছার। এমন প্রস্তাবে আনোয়ারা যেন ভরসা খুঁজে পায়। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বিয়ের পর বন্ধুর খাবার হোটেলের ম্যানেজারের দায়িত্ব নেন আনছার। এক বছর হোটেলের দায়িত্ব পালন করে পটুয়াখালী সদর উপজেলার মাদার বুনিয়ার নিজ গ্রামের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু কখনোই আনোয়ারার এই জীবনকথা পরিবারকে জানতে দেয়নি আনছার। সুদীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও আনোয়ারা ভুলতে পারেনি সেই নির্যাতিত জীবনচিত্র। আনোয়ারা নতুন করে বাঁচার স্বাদ পেলেও জীবন থেকে হারিয়ে গেছে মাতৃত্বের স্বাদ।

পাক সেনাদের পাশবিক নির্যাতনে মা হওয়ার স্বাদ লুণ্ঠিত হয়েছে তার। ওই সময়ে মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. হাবিবুর রহমান শওকত ঈদুল আজহায় আনছারের পরিবারকে নিমন্ত্রণ করলে ওই অনুষ্ঠানে প্রকাশ পায় মুক্তিযোদ্ধা-বীরাঙ্গনা দম্পতির কথা। অ্যাড. হাবিবুর রহমান শওকত বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলকে অবহিত করেন। তখন দ্বিতীয় কোন বীরাঙ্গনার পরিচয় মেলেনি পটুয়াখালীতে। বর্তমানে শহরের কলেজ এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন এই দম্পতি। রাইজিংবিডি/পটুয়াখালী/২৯ মার্চ ২০১৮/বিলাস দাস/শাহ মতিন টিপু