সারা বাংলা

ব্যক্তিগত জমিতে ‘সীমানা পিলার’ বসাচ্ছে কেসিসি!

নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা: নিজের জমিতে সিটি কর্পোরেশনের সীমানা পিলার দেখে হতভম্ব খুলনা নগরীর নিউ মার্কেট এলাকায় শাক-পাতা বিক্রেতা শেখ ইকবাল। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে তার। তিন বছর আগে অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে শহরতলীর ময়ুর নদীর ক্ষুদে খাল সংলগ্ন এলাকায় ৩ শতক জমি কিনেছিলেন তিনি। সেখানেই কোন রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। লেখাপড়া করাচ্ছেন তিন মেয়েকেও। নিজের পরিবারের মাথা গোঁজার এই ঠাঁইটুকু গড়তে গিয়ে ৯ লাখ টাকা ঋণও করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সম্প্রতি খুলনা সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসন ময়ুর নদ ও ক্ষুদের খাল খননের জন্য তার বাড়িসহ সীমানা নির্ধারণ করেছে। যে কোন সময় তিনি উচ্ছেদ হতে পারেন তারই কেনা জমি থেকে, এমন আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন শেখ ইকবাল হোসেন। শুধু তিনিই মাত্র নন, তার মত এখানের আরো শতাধিক ব্যক্তি মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানোর ভয়ে এখন পাগলপ্রায়। ইকবাল হোসেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘দলিল ও রেকর্ডসহ সকল কাগজপত্র দেখেই তিনি জমি কিনেছেন। ট্যাক্স-খাজনাও পরিশোধ করছেন। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে- ব্যক্তিগত রেকর্ডীয় জমিও নাকি নদী সিকস্তি ও এডি লাইনের মধ্যে রয়েছে।‘ ইকবাল জানান, জমি কেনার লোন এখনও পরিশোধ করতে পারেননি, জমিটুকু চলে গেলে বেঁচে থাকা আর না থাকা সমান হবে তার। এখানেরই সম ভূক্তভোগী আব্দুল মান্নান জানালেন, তিনি বাবুর্চির কাজ করে তিল তিল করে জমানো অর্থ দিয়ে মাত্র ২ শতক জমি কিনে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। এখন উচ্ছেদ করে দিলে পথে বসা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না তার। সরেজমিনে দেখা গেছে, নদী সিকস্তি ও এডি লাইনের (নদীর ভেঙ্গে যাওয়া অংশ)  নামে খুলনা নগরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ময়ুর নদ ও ক্ষুদে খাল খননের জন্য দ্বিতীয় দফায় সীমানা নির্ধারণ করা হচ্ছে। কিন্তু কেসিসির সম্পত্তি শাখা এবং জেলা প্রশাসনের সার্ভেয়াররা ব্যক্তিগত রেকর্ডীয় জমিও খালের সীমানায় অন্তর্ভূক্ত করছেন। শুধু তাই নয়, মসজিদ-মাদরাসাও বাদ দেওয়া হচ্ছে না। শত বছর ধরে মালিকানায় থাকা পৈত্রিক সম্পত্তিতেও ‘লাল নিশানা’ও ‘সীমানা পিলার’বসানো হচ্ছে। এভাবে খালের সীমানায় জুড়ে উচ্ছেদের তালিকায় রাখা হয়েছে একতলা, দোতালা বাড়িও । অথচ: দু’ বছর আগে কেসিসি, জেলা প্রশাসন, ডুমুরিয়া উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জমি মালিকদের আমীন দিয়ে পঞ্চম পক্ষীয় পরিমাপেও ব্যক্তিগত রেকর্ডীয় জমি খালের সীমানায় অন্তর্ভূক্ত ছিল না। কিন্তু এখন কেসিসির ও জেলা প্রশাসনের এ ধরণের খামখেয়ালী সিদ্ধান্ত কেন, প্রশ্ন বিপদে পড়াদের। হতাশা ও ক্ষোভে ভিটেমাটি আবাস ঠেকাতে বাধ্য হয়ে বিপদগ্রস্তরারা ‘মযূর নদী ক্ষুদে খাল ভূমি রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে আন্দোলনও শুরু করেছেন। ইতিমধ্যেই সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করে তারা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে ১৯৬০ সালের এসএ ম্যাপ  অনুযায়ী নদী খননের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় তারা আদালতের স্মরণাপন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ ইমাম হোসেন বাচ্চু, শেখ রাসেল কবির, এমএ কাশেম, মনোজ ব্যানার্জী, মো. শফিকুল ইসলাম, আব্দুল গফ্ফার, মো. তোফাজ্জেল হোসেন তুহিন, সৈয়দ আরিফ, মুন্সী ওছিকুল ইসলাম, শেখ ইকবাল হোসেন, মো. মহসিন কবির, মল্লিক মো. মামুন, আব্দুল জলিল বেপারী, রঞ্জিতা বেগম, সালাউদ্দিন, ইকবাল, আব্দুল মান্নান, আবু দাউদ শেখ, ওবাইদুল্লাহ, আরিফ হোসেন, মু.ওহিদুজ্জামান, সেলিম সরদার, বাচ্চু সরদার, সাইফুর রহমান, আব্দুস সাত্তার মোল্লা, মনোয়ারা বেগম, হায়দার আলী, রোকেয়া বেগম ও মো. পিয়াসসহ শতাধিক ব্যক্তির রেকর্ডিয় জমি নদী সিকস্তি ও এডি লাইনের মধ্যে নিয়ে ‘লাল নিশানা’ ও ‘সীমানা পিলার’ বসানো হয়েছে। এরই মধ্যে হরিণটানার আহসানখালীর বাচ্চু নগরে ‘আলহাজ্ব সৈয়দ ইমাম হাসান বাচ্চু জামে মসজিদ ও মাদরাসা, প্রস্তাবিত সৈয়দ ইফ্ফাত হাসান এতিমখানা এবং পার্শ্ববর্তী মসজিদুল আকসা ও মাদরাসা কমপ্লেক্সের একাংশ অজুখানাসহ সীমানা পিলার বসানো হয়েছে। ফলে মুসল্লিদের মধ্যেও চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ময়ুর নদী ক্ষুদে খাল ভূমি রক্ষা কমিটির সভাপতি এস এ কাশেম বলেন, ‘খুলনা নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ময়ুর নদ ও ক্ষুদে খাল খননে কাজ করছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু জেলা প্রশাসনের সার্ভে টিম সরকারি খাস জমি ও খাল সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে এবং জমি মালিকদের প্রকৃত কাগজপত্র না দেখে লাল পতাকা স্থাপন করছে। ফলে ওই দুই নদ ও খাল পাড়ের শত শত বসতবাড়ি ও ফসলের জমি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ তিনি জানান, একদিকে জমির দলিল করা হচ্ছে, মিউটেশন করা হচ্ছে, খাজনা নেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে প্রকৃত খালের নকশা বাদ দিয়ে নতুন নকশা তৈরি করা হচ্ছে- এটা দ্বিমুখী নীতি। তিনি রেকর্ডিয় জমি মালিকদের জায়গায় লাল নিশানা ও সীমানা পিলার স্থাপন বন্ধ রাখার দাবি জানান। কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. তোফাজ্জেল হোসেন তুহিন, আব্দুল গফ্ফার, আবুল কালাম আজাদ, মো. আসাদুর রহমান, আরজাহান বানু ও নূর মোহাম্মদ শেখসহ অধিকাংশ জমির মালিক বক্তব্য, তারা কেউ পৈত্রিক সূত্রে আবার কেউ নিয়ম মেনে জমি কিনে ঘর-বাড়ি করে বছরের পর বছর বসবাস করছেন। গাছপালা রোপণ করেছেন। এর মধ্যে কোন সংস্থা, প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষ কেউ তাদের বাঁধা দেয়নি, নিষেধও করেনি। এমনকি তাদের কাছ থেকে ট্যাক্স-খাজনাও নেওয়া হচ্ছে। তাহলে হঠাৎ করে তাদের রেকর্ডীয় জমি কেন খাস হলো? তারা জানান, যদি জমি প্রয়োজন হয়, তাহলে নিয়ম অনুযায়ী সরকার অধিগ্রহণ (এ্যাকোয়ার) করতে পারে। সে ক্ষেত্রে জমি ও স্থাপনাসহ সকল সম্পদের উপযুক্ত মূল্য দিলে তারা সহযোগিতা করবেন। জমি মালিক ইমাম হাসান বলেন, ‘তাদের পৈত্রিক সম্পত্তির মধ্যে লাল পতাকা বসানো হয়েছে। ১৯২৬, ১৯৬০ ও বর্তমান নকশা অনুযায়ী ওই জমির মালিক তার বাবা। কিন্তু কোন নকশা অনুযায়ী ওই পতাকা বসানো হয়েছে তা তারা বুঝতে পারছেন না। সার্ভেয়ারদের কাছে জানতে চাইলেও তারা বলছেন না।’ অপর জমির মালিক, কেসিসির ১৪নম্বর ওয়ার্ড পুলিশিং কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব শেখ আবু দাউদ অভিযোগ করে বলেন, ‘কোন পক্ষের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ ধরণের বেআইনি কাজ করা হচ্ছে। এটি বন্ধ না হলে প্রয়োজনে তিনি প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি অবহিত করবেন, এমনকি আইনি পদক্ষেপও নিবেন। এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবু সায়েদ মনজুর আলম বলেন, খুলনা নগরের ২২টি খালের সীমানা নির্ধারণের জন্য কেসিসি’র পক্ষ থেকে দু’জন সার্ভেয়ার চেয়ে পত্র দেওয়া হয়। সে মোতাবেক সার্ভেয়ার দেওয়া হয়েছে। কেসিসি’র সম্পত্তি শাখার লোকজন সার্ভেয়ার নিয়ে পরিমাপ করছে। কিন্তু সেটি নদীর সীমানা নির্ধারণ, কারো রেকর্ডীয় জমিতে সীমানা পিলার বা লাল নিশান স্থাপনের কথা নয়। কেসিসি’র সম্পত্তি শাখার প্রধান (স্টেট অফিসার) মো. নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সে কারণে তারা শুধুমাত্র সহযোগিতা করছেন। তাদের সার্ভেয়ার পরিমাপ করে যেখানে সীমানা চিহ্নিত করছে- তারা সেখানেই পিলার স্থাপন করছেন। আর পিলার বসাতে সময় লাগায় লাল নিশান বসানো হচ্ছে। নদী সিকস্তি এবং এডি লাইনের বিষয়টি সম্পূর্ণ জেলা প্রশাসনের এখতিয়ার। এখানে কেসিসি’র কোন বিষয় নেই।’ রাইজিংবিডি/ খুলনা/৫ নভেম্বর  ২০১৮/ মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/টিপু