সারা বাংলা

উপকূলে হ্রাস পেয়েছে অতিথি পাখির প্রজাতি

ভোলা সংবাদদাতা: ভোলার চরাঞ্চল এখন অতিথি পাখির কলতানে মুখর। যদিও শীত মৌসুমে আগের মতো পাখিদের তেমন ভিড় এখন আর দেখা যায় না। জানা গেছে, ৮০’র দশকেও ভোলার চরাঞ্চলে আসা অতিথি পাখির সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩৫০ প্রজাতির। কিন্তু বর্তমানে এরসংখ্যা নেমে ৬৫ প্রজাতিতে চলে এসেছে। প্রতিবছরই শীতের শুরুতে হাজার পাখির কলকাকলীতে এ অঞ্চল মুখরিত হয়ে উঠলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে দিন দিনই এর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে পাখির সংখ্যা কমতে থাকলে একসময় এখানের চরাঞ্চলগুলোতে পাখিদের কলতান আর শোনা যাবে না। গত সপ্তাহে রাজধানী ঢাকা থেকে ভোলায় অতিথি পাখিদের শুমারি করতে এসেছিলেন বন্যপ্রাণি গবেষক ও পাখি পর্যবেক্ষক সামিউল মোহসেনিন। জানালেন, গত শীত মৌসুমে সর্বমোট ৫০ হাজার ৪০টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি তিনি গণনা করেছেন। এর মধ্যে ৬৬ প্রজাতির পাখির সন্ধান মিলেছে। যার মধ্যে জলচর পাখি ছিল ৬৫ প্রজাতির। সর্বমোট সৈকত পাখির সন্ধান মিলেছে ৪হাজার ৪২১টি। যার মধ্যে চেগা, জিরিয়া, বাটান ছিল উল্লেখ যোগ্য। বনু হাসের সন্ধান মিলেছে ১২হাজার ৮শ ৭৩টির। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিথি হাঁস, বেবী, চখাচখি, রাজহাঁস। অন্যদিকে এ বছর শীত মৌসুমে মোট ৬৫ প্রজাতির ৫৬ হাজার ৫শ ২২টি জলচর পাখি দেখা গিয়েছে। এর মধ্যে ৫ প্রজাতির বিপন্নপ্রায় জলচর পাখি দেখা গিয়েছে, মহা বিপন্নদের মধ্যে চামুচ ঠুঁটো বাটান ৫টি। বিপন্ন নর্ড ম্যানের সবুজ পা ২টি। সংকটাপন্ন দেশি গাঙচষা ১৩ হাজার ৪৩টি। এছাড়া প্রায় সংকটাপন্ন প্রজাতির মধ্যে নদীয়া পানচিল ৬টি, এশীয় ডউইচার ২৮টি, কালা লেজ জৌরালি ৫হাজার ৪২৭টি, কালামাথা কাস্তেচরা ৪৫৫টি, ইউরেশীয় গুলিন্দা ৩১৩টি, ইউরেশীয় গুলিন্দা ৩৩১টি। ১০ প্রজাতির বনু হাঁসের সন্ধান মিলেছে ১৪ হাজার ৭শ ৯৬টির। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দাগি রাজহাঁস, সিথি হাঁস, খুন্তে হাঁস, পিয়াং হাঁস, খয়রা চখাচখি, পাতি চখাচখি, উওরের ল্যাঞ্জা হাঁস, মড়চে রঙা ভুতি হাঁস ও মেটে রাজ হাঁস। সামিউল মোহসেনিন উপকূলের মোট ২০টি চর পর্যবেক্ষণ করেছেন। এরমধ্যে মাঝের চর, পাতার চর, দমার চর, শাহাজালাল, কালকিনির চর, চর কুকরি-মুকরি, চর পিয়াল, চর পাতিলা, আন্ডার চর, সোনার চর, চর মনতাজ, টেগরার চর, সালুর চর, ডুব চর, ও বঙ্গের চরে এ পাখিদের বেশি সংখ্যায় দেখা গিয়েছে। তিনি দু:খ করে বলেন, মাঝের চর, বঙ্গের চর ও সালুর চর এ পাখি শিকারের প্রমাণ ও নমুনা পাওয়া গিয়েছে। তিনি বলেন, পরিযায়ী পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে ও একটি সুস্থ পরিবেশের সূচক স্বরুপ। দিন দিন পাখি কমে যাওয়ার পেছনে বিশ্বব্যাপি জলবায়ু পরিবর্তনের বড় কারণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পাখি পর্যবেক্ষক ইনাম আল হক। তিনি জানান, বাংলাদেশে ৩০ বছর আগে যেখানে ফসল শুধু জৈব সার ব্যবহার করা হতো। এখন সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক সার। যেটা পাখিদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। আবার এক শ্রেণির অসাধু শিকারীরা বিষ দিয়ে পাখি নিধন করে বাজারে বিক্রি করছে। যার ফলে পাখিরা থাকা ও খাওয়ার জন্য অনেক স্থানকে এখন আর নিরাপদ মনে করছে না। প্রকৃতি ও পাখি বিশেষজ্ঞ ড.এস.এম.এ রশিদের সাথে কথা হয়। যিনি ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে প্রথম পাখি শুমারি শুরু করেন। তিনি জানান, ৮০’র দশকে ভোলায় আসা অতিথি পাখির সংখ্যা যেখানে ছিলো প্রায় ৩৫০ প্রজাতির তা এখন নেমে ৬৫ প্রজাতিতে চলে এসেছে। কথা হয় পাখি-পর্যবেক্ষক ও পর্বত আরোহী এম.এ মুহিতের সাথে। তিনি জানান, ভোলার যে সকল চরে জনবসতি ছিলনা এখন সেখানে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। ফলে পাখিদের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়াও মেঘনা-তেতুলিয়া নদী বেষ্টিত এসব চরাঞ্চলে গাছের সবুজ বেষ্টনি একের পর এক উজাড় হচ্ছে। প্রকাশ্যেই বনের গাছ লুট করছে দস্যুরা। যার ফলে পাখিরা এখন ওইসব চর গুলোকে তাদের নিরাপদ স্থান বলে মনে করছে না। এ ছাড়াও নদীগুলোতে জেলেরা কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে মাছ শিকার করছে। যে কারণে একদিকে যেমন পাখিদের খাদ্যাপোযোগী মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে অন্যদিকে জালে জড়িয়ে অনেক পাখিও প্রাণ হারাচ্ছে। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি নিয়াজ আবদুর রহমান জানান, পাখিদের আবাসস্থল এখন লোকালয়ে পরিণত হয়েছে। পাখিদের কোলাহল মুক্ত বিচরণ ক্ষেএগুলো এখন প্রভাবশালীদের দখলে। তিনি নদীর প্রাণ-বৈচিত্র ফিরিয়ে আনতে সকলকে একযোগে কাজ করার আহবান জানান। উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: রুহুল আমিন জানান, শীত মৌসুমে উপকূলীয় চরগুলোতে আসা পাখির বিচরণ ক্ষেএগুলো রক্ষার জন্য বন বিভাগ সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। উপকূলে আসা পর্যটকদের পাখি দেখার জন্য ভোলার চর কুকরী-মুকরীতে বার্ড ওয়াচ সেন্ট তৈরির একটি প্রকল্প সরকার হাতে নিয়েছে। রাইজিংবিডি/ভোলা/২৭ জানুয়ারি ২০১৯/ফয়সল বিন ইসলাম নয়ন/টিপু