সারা বাংলা

চেতনায় লাল-সবুজ

অর্পিতা ঘরামীঢাকা, ১৬ ডিসেম্বর: ‘লাল-সবুজ’ বাঙালির অস্তিত্বে মিশে থাকা চেতনার নাম। বিজয়দিবসকে ঘিরে লাল-সবুজের আয়োজন চোখে পরে সবখানে। রাস্তা-ফুটপাত থেকে শপিংমল সবখানেই লাল সবুজের আয়োজন।

শহরতলীতে বিজয় দিবসের ছটা লাগতে শুরু করে ডিসেম্বর মাসের প্রথম থেকেই। দিনেদিনে লাল-সবুজের ছটা আরো বেশী গাঢ় হয়, বাড়তে থাকে আনন্দ অনুভূতি। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় আনন্দে বাঙালির গর্ব আর অহংকার আরো প্রকাশিত হয় দেশপ্রেমে। সবুজ জমিনে লাল বৃত্ত আঁকা পতাকা:বিজয় দিবসের আগমন আমাদের প্রতিদিনের জীবনে লাল-সবুজের প্রভাব ফেলে ভিষন রকম। পথে যেতে যেতে চোখ পরে পতাকা বিক্রেতাদের। কিশোর-তরুন-প্রবীন সব বয়সের পতাকা বিক্রেতার হাসিমুখ আর দীপ্ত পথচলায় ফুঁটে ওঠে তাদের দেশপ্রেমের পরিচয়। দোয়েল চত্বর এলাকায় কথা হয়, সদ্য শৈশব পেরোনো হাসানের সাথে। হাসি হাসি চেহারা নিয়ে হাসান জানায়, পথে পথে বিক্রি হওয়া এসব পতাকার দরদাম।

পতাকা ফেরীওয়ালাদের কাছে থাকা সবচেয়ে বড় সাইজের পতাকা মিলবে ৩০০-৩২০ টাকায়, এর থেকে  একটু ছোট সাইজের পতাকা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়, আরো একটু ছোট সাইজের পতাকার দাম ২০০ টাকা, ১৫০-১৩০ টাকায় পাওয়া যাবে আগের চেয়ে ছোট সাইজের পতাকা। আর আপনি যদি আরও ছোট সাইজের পতাকা চান তবে তার দাম পরবে ৫০-৭০ টাকার মধ্যে। তাছাড়া, প্লাষ্টিক পাইপের সাথে আটকানো একেবারে ক্ষুদে পতাকা পাওয়া যাবে ১০-১৫ টাকায়। এছাড়া, লাল-সবুজ রঙের মাথায় ও হাতে পরার ব্যান্ড, ফিতা পাওয়া যাবে ২০-৩০ টাকার মধ্যে। তবে এলাকা ভেদে এই দাম কিছুটা কম-বেশী হতেই পারে।

সংসদ ভবন এলাকার পতাকা বিক্রেতা সেলিম জানালেন, তাদের কাছে থাকা সব পতাকাই ৬:৩ অনুপাতে তৈরী করা হয়। যা সাধারন ব্যাবহার বিধির মধ্যে পরে। তিনি আরও জানান যে তারা সাধরণত পুরান ঢাকা থেকেই পাইকারী দরে পতাকা কিনে এনে বিক্রি করেন। কিছু পতাকা স্ট্যান্ডে সাজানো থাকলেও বাকিগুলো রয়েছে স্ট্যান্ডের নিচে রাখা ব্যাগের ভেতর। প্রতিদিন কেমন লাভ হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট কিছু না বললেও মুখে ফুঁটে উঠলো নির্ল এক হাসি। সেই সাথে বললেন, “বছরে একটা মাস অন্য কাজ ফেলে পতাকা বিক্রি করি, লাভ নিয়ে ভাবিনা, আনন্দটাই আসল”।

জানতে ও মানতে হবে:পতাকা ছাড়া বিজয়দিবস! ভাবাই যায়না। আপনার পছন্দমত পতাকাটি কিনে নিতে পারেন পতাকা ফেরীওয়ালাদের কাছ থেকে। চাইলে প্রয়োজন অনুযাই তৈরীও করিয়ে নিতে পারেন লাল-সবুজ পতাকাটি। মনে রাখবেন, ভবনের জন্য জাতীয় পতাকার নির্দিষ্ট পরিমাপ(১০ফুটX৬ফুট),(৫ফুটX৩ফুট),(২.৫ফুটX১.৫ফুট)।

মোটরগাড়ীর জন্য পতাকা তৈরী করতে হলে ১৫ইঞ্চিX৯ইঞ্চি মাপটি খেয়াল রাখতে পারেন। তবে বাসা বাড়ীর জন্য পতাকা তৈরী করতে হলে ১০:৬ অনুপাতটি ভুলবেন না। মাপের পাশাপাশি ভালোবেসে পালন করতে হবে কয়েকটি নিয়ম।

# জাতীয় পতাকা দিয়ে নৌযান, রেল কিংবা মোটরযানের সামনে কিংবা পিছনে আচ্ছাদিত করা যাবে না। # আমাদের পতাকার উপরে অন্য কোন দেশের পতাকা উত্তোলন করা যাবে না।# শোভাযাত্রায় মধ্যভাগে জাতীয় পতাকা বহন করুন।# দেয়ালে ব্যবহার করতে চাইলে খেয়াল রাখুন পতাকাটি যেনো দেয়ালের সমতলে থাকে।# ব্যাক্তি বা জড়বস্তুর দিকে পতাকা নিম্নমুখী করে রাখবেন না ।# খেয়াল রাখবেন লাল-সবুজ পতাকাটি কোনভাবেই মেঝে, পানি, পণ্যদ্রব্য স্পর্শ না করে।# আনুভূমিক/সমতলে নয়, পতাকা উর্ধ্বে ও মুক্তভাবে বহন করুন।  # সামরিক ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের শবযানে পতাকা আচ্ছাদিত করা যায়।এছাড়াও খেয়াল রাখবেন, ব্যবহারের অনুপযোগী পতাকা পূর্ণ সম্মানের সাথে সমাধিস্ত করতে হবে। তারুন্যে লাল-সবুজবিজয় দিবস মানেই লাল-সবুজের আলপনা। আলপনা চিন্তা-চেতনায়, আলপনা জীবনযাপনে। বিজয় উৎসবকে রাঙিয়ে দিতে ফ্যাশন হাউজের ব্যস্ততা চোখে পরার মত। সমানতালে ব্যস্ত রয়েছেন কারুশীল্পের কারিগররাও। লাল-সবুজকে ঘিরে নান্দনিক সৃষ্টিতে ব্যাস্ত সবাই। রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেট ঘুরে দেখা গেল প্রায় সব দেশীয় ফ্যাশন হাউসেই লাল-সবুজের প্রাধান্য।

ক্রেতাদের মধ্যে তরুনরা-ই বেশী। শুধু লাল কিংবা সবুজ রংয়ের পোশাকের প্রাধান্য কম থাকলেও লাল-সবুজের যৌথ উপস্থাপনায় মুগ্ধ ক্রেতারা। আজিজে ছেলেদের ফতুয়া পাবেন ৪০০-১০০০ টাকার মধ্যে। পাঞ্জাবী পাওয়া যাচ্ছে ৭০০-১৫০০ টাকায়। মেয়েদের ফতুয়া ও পাঞ্জাবী পরবে ৬৫০-১২০০ টাকা। লাল-সবুজ থ্রী-পিস পাওয়া যাবে ১৫০০-২৫০০ টাকার মধ্যে। এছাড়া চারুকলা ও আজিজ থেকে নিতে পারেন খাদি কিংবা সুতির ওড়না আর চাদড়।

বিজয় উৎসবকে ঘিরে বিশেষ আয়োজনে সেজেছে দেশীয় দশ ফ্যাশন হাউজ। নিপুন লাল-সবুজ কম্বিনেশনে পোশাক এনেছে ছেলে-মেয়ে আর শিশুদের জন্য। ১০০০-১২৫০ টাকায় পাওয়া যাবে মেয়েদের জামা, শর্ট ফতুয়া কিনতে খরচ হবে ৪৫০-৬০০ টাকা। ছোট মেয়েদের জামা পাবেন ৩৫০-৫০০ টাকায়, ছেলেদের ফতুয়া মিলবে একই ধরনের দামে। হালকা জরির পাড় আর জ্যামিতিক নকশায় ছেলে-মেয়েদের পোশাক এনেছে নগরদোলা।

শাড়ির আয়োজনে থাকছে ব্লক-বাটিক আর লাল-সবুজ সেডের প্রাধান্য। তাদের লাল-সবুজ রঙের পোশাক পাওয়া যাবে ৭৫০-১৫০০ টাকার মধ্যে। এছাড়া অঞ্জনস্, রঙ এবং বিবিয়ানার পোশাকেও থাকছে লাল-সবুজের প্রাধান্য। ষোলআনা বাঙালিয়ানায় পূর্ণতা আনতে শাড়িতে লেগেছে লাল-সবুজের বিভিন্নতা। শাড়ির রঙে বিভিন্ন ধরনের লাল-সবুজের শেড ব্যবহার চোখে পরার মত। সেই সাথে থাকছে লেস, জরি আর পুথির বাহারিয়ানা।লাল-সবুজের সাজলাল-সবুজের ফ্যাশনের অন্যান্য অনুসঙ্গের আয়োজনেও অপূর্ণতা নেই। মেয়েদের পোশাকের সাথে মিল রেখে পাওয়া যাচ্ছে গলার মালা, চুড়ি ও কানের দুল। লাল-সবুজ রঙের প্রধান্য পাওয়া এসব ফ্যাশন অনুসঙ্গের পসরা বসে চরুকলার সামনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর এলাকায়, নিউমার্কেট এবং দেশীয় ফ্যাশন হাউজ গুলোতে। দরদাম আপনার হাতের নাগালের মধ্যেই, মাটির তৈরী গলার মালা পাবেন ৩০-৭০ টাকায়, মেটাল ১৫০-৩০০ টাকা, অন্যান্য ৭০-৫০০ টাকার মধ্যে কিনতে পারবেন। সাদামাটা চেনের সাথে থাকা লাল-সবুজ পতাকার আদলে তৈরী মাটির লকেট মানিয়ে যাবে যে কোন দেশীয় পোশাকের সাথে।

লাল-সবুজ চুড়ির দাম নির্ভর করবে ধরনের উপর। মাটি, প্লাস্টিক, মেটাল ও কাঠের তৈরী এক জোড়া চুড়ি পাবেন ৮০-২০০ টাকায়। এছাড়া কাঁচের কিংবা রেশমী চুড়িও বেছে নিতে পারেন। বালা টাইপের লাল-সবুজ চুড়ি পাওয়া যাবে চারুকলা আর আজিজের দোকানগুলোতে। লাল-সবুজের টুকিটাকি মোম থেকে মগ সবখানেই লাল-সবুজের ছড়াছড়ি। আড়ং, যাত্রা এবং বিভিন্ন গিফট শপগুলোতে লাল-সবুজ রঙের বাহারী মোম মন কেড়ে নেয় সহযেই। বিজয়ের রঙের সাথে জড়ির কাজকরা মোমের প্রতি তরুনদের ঝোঁকটা একটু বেশী, জানালেন বিক্রয়কর্মীরা।

মগের গায়ে শুধু পতাকা নয়, ফুটে উঠেছে লাল-সবুজ রংয়ের নানান নকশা। বিভিন্ন গিফটশপের পাশাপাশি আপনি চাইলে কাঁটাবন কিংবা হাতিরপুল এলাকা থেকে পছন্দ মত লাল-সবুজ নকশায় রাঙিয়ে নিতে পারেন আপনার মগটি। বিজয় দিবসের উপহার হিসেবে এসব মগ বেশ নান্দনিক। সারা বছর স্মৃতিতে বিজয়ের আমেজ ধরে রাখতে লাল-সবুজ মোম আর মগ অতুলনীয়।

লাল-সবুজের ছটা লেগেছে নোটবুক, ডাইরী কিংবা ছবি আঁকার খাতাটিতেও। মাঝখানে লাল বৃত্ত আর পুরো কভারটিই সবুজ। পুরো সবুজ কভারের উপর লাল রংয়ের দেশী মোটিভের আলপনা! এমন অনেক বাহারি নকশা ফুটে উঠেছে কাভার ডিজাইন হিসেবে। গ্রাসহোপারস কিংবা অন্যান্য খাতা-কলমের দোকান থেকে বেছে নিতে পারেন বিশেষ এই পণ্যটি।

আপনি চাইলে নিজের মতো করে তৈরী করে নিতে পারেন আপনার ডায়রী কিংবা নোট বুকটির কাভার। সাহায্য নিতে পারেন নীলক্ষেত-টিএসসি এলাকার বই বাঁধাই করেন যারা তাদের। এতে করে ব্যবহৃত অথবা নতুন দুটোই পাবে বিজয়ের রূপ। কাভার হিসেবে বেছে নিতে পারেন নরম সুতি কাপড় কিংবা কাগজ। রঙ হিসেবে লাল সবুজ-কে বেছে নিয়ে নান্দনিক নকশা করে নিতে পারেন আপনার মনের মত করে। বন্ধু আর ছোট বড় সবার জন্যই এটি হতে পারে বিজয়ের সবচেয়ে ভালো উপহার।

বিজয় দিবস মানেই পুরো দিন জুড়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন। সন্ধ্যে হলেই রঙিন আলোর উপস্থিতি থাকবেই। ঘরোয়া কিংবা অন্যান্য অনুষ্ঠানে লাল-সবুজ আলোর ব্যাবস্থা করতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন শুধু একরঙা লাল-সবুজ আলো ব্যবহার না করে বিজয় রঙের বিভিন্ন শেড ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া লাল-সবুজের সাথে সাদা অথবা রূপালী আলো ব্যাবহার করতে পারেন। খেয়াল রাখবেন গাঢ় লাল-সবুজ  রঙের সাথে আরো একটি গাঢ় রঙের কম্বিনেশন না করাই ভালো।

শিশুতোষ লাল-সবুজবিজয়দিবসকে ঘিরে শিশুদের আনন্দ থাকে অনেক বেশী। চেষ্টা করুন তাকে গল্পের মতো করে বিজয় দিবসের আয়োজনটি বুঝিয়ে দিতে। তারপর হাতে দিন তার বয়স উপযোগী ছোট্ট একটি উপহার। হতে পারে লাল-সবুজ রঙের কলম, পেন্সিল, পেন্সিল বক্স, ডায়রী, বাধানো খাতা, বই যে কোন কিছু। মনে রাখবেন, উপহারটি যেনো বিজয় উৎসবকেই প্রতিনিধিত্ব করে। পরিবারের সব শিশু-কিশোরদের একসাথে নিয়ে আয়োজন করতে পারেন বিজয় দিবসের সকালের অনুষ্ঠান।

শিশুদের জন্য বিজয় দিবসের লাল-সবুজ জামাটি তাকে আগের দিন রাতেই দিয়ে দিতে পারেন। এতে করে বিজয় দিবসের সকালে তার আনন্দ আরো একটু বেড়ে যাবে।

বিজয় দিবসের দিনে সবখানেই থাকে লাল-সবুজের আয়োজন। রাস্তায়, রিক্সার সামনে, বাসের ছাদে, প্রাইভেট কারের সামনে, বাড়িতে, দোকানে সবখানে মুক্তির প্রতীক হয়ে উড়তে থাকে লাল-সবুজ পতাকা। বিজয় উৎসবের সবখানে লাল-সবুজ অনুসঙ্গ। ছোট্ট শিশুটির লাল-সবুজ জামাটির সাথে গালে আঁকা বিজয় চিহৃ আর মুখের হাসি আমাদের বিজয়েরই প্রতিচ্ছবি।

লাল-সবুজ শাড়ির সাথে মেয়েটির কপালের জ্বলজলে লাল টিপটি আমাদের বিজয়ের নতুন রবির মতোই উজ্জ্বল যেনো। বিজয় রঙের খাদী পাঞ্জবীটি পরে তরুনটি দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত ভঙ্গিতে, এই আমাদের মুক্তির আত্মবিশ্বাস। লাল-সবুজ আমাদের মুক্তির রঙ, আমাদের বিজয়ের রঙ।  

 

রাইজিংবিডি/ অর্পিতা / ফাতমা / রাশা