সারা বাংলা

জানালা দিয়ে লাফিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন রাব্বি

নিজস্ব প্রতিবেদক, নারায়ণগঞ্জ : বনানীর এফ আর টাওয়ারে বৃহস্পতিবার অগ্নিকাণ্ডে নিহত নারায়ণগঞ্জের ফজলে রাব্বি ও আহমেদ জাফরের লাশ বাড়িতে পৌঁছেছে। বৃহস্পতিবার মধ্য রাতে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ফজলে রাব্বির লাশ শনাক্তের পর শুক্রবার ভোর রাত ৪টায় সদর উপজেলার ফতুল্লা থানার ভূঁইগড় এলাকার বাড়িতে নিয়ে আসেন স্বজনরা। এরপর থেকে রাব্বিকে শেষবারের মতো দেখতে নবীনগর ভিলায় ছুটে আসতে শুরু করেন আত্মীয়-স্বজনরা। একই সময়ে সোনারগাঁও উপজেলার শম্ভুপুরার ইউনিয়নের নবীনগর এলাকায় নিহত আহমেদ জাফরের বাড়িতে মাতম চলছে । শুক্রবার সকালে ফতুল্লার ভূঁইগড়ে নবীনগর ভিলায় গিয়ে দেখা যায়, স্বজনদের আহাজারি আর আর্তনাদ। পরিবারের মূল উপার্জনকারী বড় সন্তান ফজলে রাব্বির এই করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না বৃদ্ধ বাবা জহিরুল হক। নিজে ছোট একটা চাকরি করলেও সংসার চলতো বড় ছেলে রাব্বির উপার্জনের টাকা দিয়ে। এ অবস্থায় একদিকে ছেলে হারানোর শোক, অন্যদিকে কীভাবে সংসার চলবে সেই দুশ্চিন্তায় ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন বাবা জহিরুল হক। শোকে পাথর হয়ে গেছেন মা শাহনাজ বেগম ও একমাত্র ছোট বোন শাম্মি আক্তার। ছেলের ঝলসে যাওয়া নিথর দেহের কথা বার বার মনে করে বিলাপ করছেন মা শাহনাজ বেগম ও বাবা জহিরুল হক। নিহত রাব্বির বাবা জহিরুল হক জানান, বনানীর এফ আর টাওয়ারের ১২ তলায় ফ্লোগাল লজিস্টিস (ইউরো সার্ভিস) নামে একটি কোম্পানিতে কাস্টমার সার্ভিস এন্ড ডকুমেন্টেশন বিভাগে এক্সিকিউটিভ পদে কাজ করতেন ফজলে রাব্বি। গত এক বছর আগে এখানে কাজে যোগদান করেন তিনি। ঘটনার দিন দুপুর ১২টা থেকে কয়েকবার বাড়িতে ফোন করে কথা বলেন রাব্বি। ১টা ৫৩মিনিটে শেষ কথা হয় ছোট ভাই ও বাবার সঙ্গে। রাব্বি তাদের জানিয়েছিলেন- অফিস ফ্লোরে আচ্ছন্ন ধোঁয়ায় আটকা পড়ে গেছেন তিনি। বাঁচার জন্য জানালা দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়বেন কি না সেই সিদ্ধান্ত চেয়েছিলেন ছোট ভাই ও বাবার কাছে। কিন্ত তারা রাব্বিকে বার বার নিষেধ করেছিলেন। এই ছিল পরিবারের সঙ্গে রাব্বির শেষ কথা। মা শাহনাজ বেগম জানান, সকালে নাস্তা করে মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে অফিসে চলে যায় রাব্বি। দুপুর ১২টায় তিনি ফোন করে অফিস ভবনে আগুনের কথা জানালে চিন্তিত ও আতংকিত হয়ে পড়েন তিনি। বার বার ছেলের খবর নিতে তাগাদা দিচ্ছিলেন স্বামী, ছোট ছেলে ও মেয়েকে। শেষমেষ রাত ১২টায় জানতে পারেন ছেলে আর নেই। ভোরে ছেলের ঝলসে যাওয়া নিথর মৃতদেহ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর থেকে প্রায় বাকহীন হয়ে পড়েছেন তিনি। স্বামীকে লাশ হয়ে ফিরে আসতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন রাব্বির স্ত্রী সাবিয়া। দুই বছরের সন্তানকে কীভাবে মানুষ করবেন ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। সরকারের কাছে তার দাবি, শিশু সন্তানকে মানুষ করার ব্যাপারে যেন সহায়তা করা হয়। রাব্বির বৃদ্ধা শাশুড়িও কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্বামীহারা মেয়ের বেদনায়। ক্রমাগত বিলাপ করছিলেন তিনি। রাব্বির ছোট ভাই রিফাত আলম জানান, বড় ভাইয়ের রোজগারের টাকায় মাস্টার্স শেষ করেছেন। ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছেন বড় ভাই রাব্বি। মূলত পরিবারের আয়ের মূল উৎস ছিলেন পরিবারের রড় সন্তান রাব্বি। তার প্রশ্ন রাব্বিকে হারিয়ে কীভাবে চলবে পরিবারটি? ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার সাতমোড়া গ্রামে পূর্বপুরুষদের বাড়ি হলেও ফজলে রাব্বি গত পাঁচ বছর নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়ের এই বাড়িত স্বপরিবারে বসবাস করে আসছিলেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। স্বজনরা জানান, আজ বাদ জুমা স্থানীয় মসজিদে জানাজা শেষে রাব্বির লাশ দাফন করা হয়েছে গ্রামের বাড়িতে। এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার আহমেদ জাফরের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে একই সময়ে। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে লাশ শনাক্ত করার পর স্বজনরা বাড়িতে নিয়ে আসেন। আহমেদ জাফর সোনারগাঁওয়ের শম্ভুপুরা ইউনিয়নের নবীনগর এলাকার হেলাল উদ্দিনের ছেলে। তার ভাতিজা আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, আহমেদ জাফর ছিলেন সোনালী ব্যাংকের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মাত্র তিন মাস আগে চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করে বনানীর এফ আর টাওয়ারের আসিফ এন্টারপ্রাইজের ট্রান্সপোর্ট বিভাগের প্রধান পদে যোগদান করেছিলেন তিনি। বর্তমানে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদী হাউজিংয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করছিলেন। রাইজিংবিডি/নারায়ণগঞ্জ/২৯ মার্চ ২০১৯/হাসান উল রাকিব/বকুল