সারা বাংলা

বৈশাখ উপলক্ষে জমজমাট টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ির বাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক, টাঙ্গাইল : কয়েক দিন পরে বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ। এই দিনে পথেপ্রান্তরে বেজে উঠবে বাঙালির প্রিয় সুর ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’। বৈশাখী মেলায় লাল-সাদার বৈশাখী শাড়ি পরে ভিড় করবে রমণীরা। এই উৎসবে নারীদের প্রথম পছন্দ টাঙ্গাইলের শাড়ি। এক সময় লাল আর সাদা রঙের শাড়িতে সীমাবদ্ধতা থাকলেও, আধুনিক নারীরা ঝুকছেন লাল, সাদাসহ বিভিন্ন রঙ ও ডিজাইলের শাড়ির দিকে। আর তাই, পছন্দমত শাড়ি কিনতে ভিড় করছে পাইকারি ও খুচরা শাড়ির দোকানে। বৃহৎ এই উৎসবে শাড়ির চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত সময় পার করছে টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁত কারিগররা। চাহিদা আর কিছুটা বাড়তি আয় করতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করছেন তারা। তাঁত মালিকরাও এ বছরও কাঙ্ক্ষিত ব্যবসার প্রত্যাশা করছেন।  

সরেজমিন তাঁত শাড়ির জন্য খ্যাত দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলের তাঁতপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, ভোর হতেই তাঁতের খট খট শব্দে মুখর পুরো তাঁতপল্লি। এই পেশার সঙ্গে কেউ জড়িয়ে আছেন ১০ বছর, আবার কেউ বা পৈত্রিক সূত্রে জন্মের পর থেকেই। অন্যদের জন্য রঙিন শাড়ি বুনলেও জীবনের রঙ বদলাতে পারেনি এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা। অভাবে-অনাটনে কোনো রকমে টিকিয়ে রেখেছেন এই পেশা। পাথরাইল তাঁতপল্লির কয়েকশত কারখানায় কাজ করছেন প্রায় ১০ হাজার তাঁত কারিগর। বৈশাখ সামনে রেখে তাদের ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে দিনে-রাতে অন্তত ১২ ঘণ্টা। বৈশাখ উপলক্ষে লাল-সাদা রঙের তাঁত শাড়িই বেশি তৈরি হচ্ছে। তার সঙ্গে গতানুগতিক তসর, এন্ডি, ডেনু সিল্ক, জামদানির ওপর চুমকির কাজসহ বাহারি ডিজাইনের শাড়ি রয়েছে। শ্রমিকেরা বলছেন, দৈনিক ১২ ঘণ্টা করে তাঁত বুনলেও তাতে মজুরি মিলছে মাসে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে সংসার চালানো কষ্টকর। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে অন্যের নতুন শাড়ি বুনলেও অর্থাভাবে পরিবারের সদস্যদের নতুন পোশাক দিতে পারেন না তারা। তাঁত কারখানার শ্রমিকদের জীবনের চিত্রটা বিষাদে ভরা থাকলেও তাঁতপল্লির দোকানের দৃশ্য জমকালো। বৈশাখ সামনে, তাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শাড়ি কিনতে ভিড় করছেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকার ও সাধারণ ক্রেতারা। যাচাই-বাছাই করে বেছে নিচ্ছেন নিজের পছন্দের শাড়ি। বুনন আর রঙে সেরা থাকায় এখানকার শাড়ির প্রতি আগ্রহ বেশি সকলের। পাথরাইলের তাঁতপল্লিতে শাড়ি কিনতে আসা শম্পা বলেন, এখান থেকে শাড়ি কিনলে মানের প্রতি সন্দেহ থাকে না। শপিংমল বা মার্কেটের দোকানে বিক্রেতারা নিন্মমানের শাড়ি ধরিয়ে দেয়। তাই বৈশাখ উপলক্ষে এখাসে শাড়ি নিতে আসেন।  ক্রেতা রেহেনা পারভীন বলেন, শুধু শাড়ি নয়, পাথরাইলের তাঁতপল্লিতে শাড়ির পাশাপাশি থ্রি-পিসও ভালো পাওয়া যায়। তাই বাংলা নববর্ষের উৎসবের জন্য এখান থেকে পোশাক কিনতে এসেছেন। খুচরা ক্রেতারা বলছেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার বৈশাখী শাড়ির দাম কিছুটা চড়া। গত বছর যে শাড়ি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবার সেই শাড়ি হাজারের উপর বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাদের এমন অভিযোগ স্বীকার করে তাঁত শাড়ির ডিজাইনাররা বলছেন, সুতার মূল্যবৃদ্ধি আর শ্রমিক সংকটের কারণে গত বছরের তুলনায় এবার দাম বেড়েছে বৈশাখী শাড়ির।  

পাথরাইলের পাইকারি তাঁত শাড়ি বিক্রেতা যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী রঘুনাথ বসাক বলেন, দেশের প্রায় ৪৬ শতাংশ নারী টাঙ্গাইলের শাড়ি পরে। আর বিভিন্ন উৎসবে এই শাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। পয়লা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এই উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি একসঙ্গে উপভোগ করে। একসময় শুধু লাল-সাদাতেই বৈশাখী শাড়ি সীমাবদ্ধ থাকলেও, বর্তমানে অন্যান্য  রঙের শাড়িও বৈশাখে বিক্রি হচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে শাড়ির ডিজাইনে আনা হয়েছে নতুনত্ব। এই বৈশাখী শাড়ি দামেও কম। এবারের বৈশাখপরবর্তী বাজার ভালো যাবে। বৈশাখের দুই মাসের কম সময়ে ঈদ হওয়ায় শাড়ি কারিগর ও ব্যবসায়ীদের ব্যস্ত সময় পার করতে হবে। শুধু পাথরাইলের তাঁতপল্লি নয়, পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে ব্যস্ত টাঙ্গাইলের পাইকারি শাড়ির হাট। রঙ-বেরঙের বাহারি ডিজাইনের শাড়িতে সয়লাব দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শাড়ির হাট করটিয়া শাড়ির হাট। প্রতিবছরের মতো এবারও বেনারসি, সিল্ক, জামদানি, বালুচুরীসহ নানা ডিজাইনের শাড়িতে ঠাসা এই হাট। সপ্তাহে মাত্র দুই দিন হাট বসায় হাটের দিন কাকডাকা ভোর থেকে সারা রাত চলছে কেনাবেচা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ক্রেতারা ট্রাক ভরে শাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন এখান থেকে। স্থানীয় অনেক ক্রেতাও ভিড় করছেন এই হাটে।

   

রাইজিংবিডি/টাঙ্গাইল/১০ এপ্রিল ২০১৯/শাহরিয়ার সিফাত/বকুল