সারা বাংলা

লবণ উৎপাদনে রেকর্ড করেও চাষির মাথায় হাত

সুজাউদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার : চলতি মৌসুমে দেশে রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়েছে। পরিমাণে তা ১৮ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে, যা ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রান্তিক চাষিরা বাম্পার উৎপাদনে খুশি হলেও দাম নিয়ে হতাশ। অনেকে লবণ বিক্রি না করে মাঠেই গর্ত করে মজুদ করেছেন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) দাবি, রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হওয়ায় বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করে রপ্তানি বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, স্থানীয় সংসদ সদস্য জানিয়েছে, লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সরকার কাজ করছে।

কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামপুর এলাকার লবণচাষি ছৈয়দ আলম বলেন, অন্য বছর প্রতি মণ লবণ যেখানে বিক্রি হতো ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়, সেখানে বর্তমানে দাম দেওয়া হচ্ছে মাত্র ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। এই টাকায় লবণ বিক্রি করলে যে আয় হবে, তাতে শ্রমিকের খরচই উঠবে না।

চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া পাহাড় গ্রামের লবণচাষি তানভীর হাসান বলেন, মিল মালিক তথা বড় বড় কোম্পানিগুলো লবণের দাম কমিয়ে দেওয়ায় মাঠপর্যায়ের চাষিরা দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। ধার-দেনা করে লবণ চাষ করে চাষিরা বিনিয়োগের টাকাও ওঠাতে পারছেন না। উৎপাদিত লবণ মাঠের গর্তেই পড়ে রয়েছে।

বিসিকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬০ সালে। সেই থেকে গত ৫৮ বছরে কখনো ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়নি। এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করে রপ্তানি করার চিন্তা করছে বিসিক। এবার ২০১৮ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ, কক্সবাজার সদরসহ কক্সবাজারের উপকূল এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় লবণ উৎপাদন হয়। এর সঙ্গে জড়িত ৬০ হাজারের অধিক চাষি।

বিসিকের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ আহামদ বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ১৮ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে আমাদের চাহিদা ছিল ১৬ দশমিক ৫৭ লাখ মেট্রিক টন। ইতোমধ্যে লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের যে চাহিদা ছিল সেই চাহিদার তুলনায় আমরা এবার বাম্পার ফলন উৎপাদন করতে পেরেছি। এ বছর যে পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে তা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।

তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এ বছর লবণ আমদানির প্রয়োজন তো হবেই না, বরং আমাদের বিসিক কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে, আরো কিছু লবণ রপ্তানি করতে। সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।

লবণচাষিরা জানান, শীতকালে তারা লবণ চাষ শুরু করেন। বৃষ্টি শুরু হলে চাষ বন্ধ হয়ে যায়। এ বছর পর্যাপ্ত রোদ ও কম বৃষ্টিপাত থাকায় তাদের লবণ উৎপাদন ভালো হয়েছে। বর্ষার এই সময়ে সবাই লবণ বিক্রি শেষ করবেন। কিন্তু এমন সময় হঠাৎ লবণের দাম কমে যায়। ডিলাররা লবণের দাম প্রায় অর্ধেক বলছেন। তাই লবণ বিক্রি না করে মাঠে গর্তে লবণ মজুদ করা হয়েছে।

সম্প্রতি চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম জাতীয় সংসদেও লবণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। তিনি সংসদে বলেছেন, চাষিরা ধার-দেনা করে লবণ চাষ করেন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে যেখানে লবণ রপ্তানি করার কথা, সেখানে বিদেশ থেকে লবণ আনার পাঁয়তারা হয়। এতে লবণের দাম পড়ে যায়। তিনি সরকারিভাবে ভর্তুকি দিয়ে লবণ কেনার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্নিষ্টদের প্রতি আবেদন জানান।

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, অবৈধ পথে যেকোনো ধরনের লবণ অনুপ্রবেশ, আমদানি অথবা কমার্শিয়াল সল্টের নামে বা যেকোনো শিল্প কারখানার নামে লবণ আমদানি সরকার যাতে নিরুৎসাহিত করে সেজন্য আমরা ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। বিসিকের পক্ষ থেকে আমাদের যে বাম্পার লবণ উৎপাদন হয়েছে সে ব্যাপারে ইতোমধ্যেই তথ্য প্রেরণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, লবণ উৎপাদনের বিষয়টি মাথায় রেখে এ মুহূর্তে দেশে লবণ আমদানির প্রয়োজন নেই।

তিনি বলেন, ‘চাষিরা যাতে লবণের নায্যমূল্য পেতে পারে সেজন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি লবণ বোর্ড গঠন করার দাবি জানিয়ে আসছেন কক্সবাজারবাসী। আমরা চাই, সেই কাঙ্ক্ষিত লবণ বোর্ড গঠনের মধ্য দিয়ে আমাদের চাষিদের আগামী দিনের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সরকার যেভাবে অতীতে কাজ করেছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা কাজ করেছি, এখনো আমরা লবণচাষিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করব।’

কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, কক্সবাজার অঞ্চলের চাষিরা লবণ উৎপাদন করে সারা দেশের মানুষের এবং শিল্প খাতের লবণের চাহিদা পূরণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বরাবরের মতোই লবণচাষিরা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রাইজিংবিডি/কক্সবাজার/৪ জুলাই ২০১৯/সুজাউদ্দিন রুবেল/রফিক