সারা বাংলা

নির্বাক ভালোবাসার ২ যুগ

তারা কেউ কাউকে কোনোদিন মুখে শব্দ করে বলতে পারেননি ‘ভালোবাসি’। কেউ কোনোদিনই পরস্পরের কাছ থেকে শুনতে পাননি ভালোবাসার ভাব বিনিময়ের একটি শব্দও। তবু অকৃত্রিম ভালোবাসায় তাদের কেটে গেছে টানা ২৪ বছর।

গল্পটা চট্টগ্রামের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী দম্পতি মনজুরুল আলম এবং আরেফা খাতুন দম্পত্তির। তারা কেউ কথা বলতে পারেন না। কানেও শুনতে পান না। তারপরও গড়েছেন ভালোবাসার সংসার। পেশায় টেইলারিং মাস্টার মনজুরুল ২৪ বছর ধরে তার সহযোগী হিসেবে পেয়েছেন স্ত্রী আরেফা খাতুনকে।

এই সুখী দম্পত্তির এক ছেলে ও এক মেয়ে। সন্তানদের মধ্যে ছেলে ইফতি বাবা-মায়ের মতোই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। তবে মেয়ে আফরোজা মুক্তা পুরোপুরি সুস্থ। চট্টগ্রামের একমাত্র ইশারা ভাষায় দক্ষ প্রশিক্ষক এবং উপস্থাপিকা মুক্তা। অনার্স পড়ুয়া মেয়েটি তথ্যমন্ত্রীর কল্যাণে বাংলাদেশ টেলিভিশনে চাকরি পেয়েছেন।

মনজুরুল আলম এবং আরেফা বেগমের ভালোবাসার গল্পের শুরুটা স্বপ্নের মতো ছিল না। মনজুরুল আলম মাত্র ১৩ বছর বয়সে জীবনযুদ্ধ শুরু করেন। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার জঙ্গলখাইন গ্রামে বাড়ি তার। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে ৩ ভাই ও ৩ বোনের সংসার। ভাইদের মধ্যে বড় ছিলেন মনজুরুল। বড় সন্তান হওয়ার কারণে কৈশোর থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে।

চট্টগ্রামের নিউমার্কেটের একটি টেইলারিং শপে টেইলার মাস্টারের সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন মনজুরুল। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেই জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া মনজুরুল কম সময়ের মধ‌্যে টেইলারিং কাজে দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হন। তারুণ্য আসতে আসতেই পরিণত হন পূর্ণ টেইলার মাস্টারে। দক্ষ মাস্টার হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম জুড়ে। টেইলারিং কাজের যাবতীয় আয় দিয়ে সংসারে সহায়তা চালিয়ে যান। পাশাপাশি ছোট ভাইকে স্কুল-কলেজ পেরিয়ে মেডিক‌্যাল কলেজে পড়াতে শুরু করেন মনজুরুল।

মেয়ে মুক্তার মাধ্যমে ইশারা ভাষায় মনজুরুল আলম রাইজিংবিডিকে জানান, জীবনের পরিশ্রমের আয়ের সিংহভাগ টাকাই ব্যয় করেছেন ছোট ভাইকে চিকিৎসক বানানোর জন্য।

সততা এবং দক্ষতার কারণে নিজ পেশায় সুনাম অর্জন করেন তিনি। তার সহকর্মী ছিলেন জসিম উদ্দিন। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার কুয়াইশ ভরাপুকুর পাড় এলাকায় বাড়ি তাদের। তিনিও একজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। জসিম উদ্দিনের ছোট বোন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী আরেফা খাতুন। জসিম উদ্দিনের মাধ্যমে তাদের বাসায় যাতায়াত। আর সেই সূত্র ধরেই মনজুরুল হকের সাথে পরিচয় ঘটে আরেফা খাতুনের।

আরেফা খাতুন ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। শুধুমাত্র এ কারণেই অনেক ভালো পরিবার থেকে আরেফার বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। আরেফাকে বিয়ে করতে আগ্রহী পাত্রদের কেউ প্রতিবন্ধী নন। কিন্তু আরেফা সেসব সুস্থ-স্বাভাবিক পাত্রদের কাউকে বিয়ে করতে রাজি হননি।

ইশারা ভাষায় মেয়ের মাধ্যমে আরেফা খাতুন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। কিন্তু যারা আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন তারা সবাই ভালো পরিবারের সুস্থ মানুষ। শুধুমাত্র দেখতে সুন্দর হওয়ায় তারা আমাকে বিয়ে করতে চান। আমার মনে হয় আমি তাদের সাথে সুখি হতে পারব না। তারা আমাকে পুতুল হিসেবে বিয়ে করতে চান। তারা আমার মনের ভাব কখনই বুঝতে পারবেন না। সেজন‌্য আমারই মতো বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী টেইলারিং মাস্টার মনজুরুল আলমকে আমি বেছে নিই। ’

একইভাবে মনজুরুল আলমও স্ত্রী হিসেবে আরেফাকে পেতে ব্যাকুল ছিলেন। আরেফার পরিবার এতে সম্মত ছিল না। তবে আরেফার বড় ভাই জসিম উদ্দিনের প্রচেষ্টায় ১৯৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিয়ে হয় আরেফা এবং মনজুরুলের। সেদিন থেকেই শুরু হয় বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী দম্পতির অন্যরকম ভালোবাসার গল্প।

একমাত্র কন্যা মুক্তার সাথে মনজু ও আরেফা দম্পতি

 

নগরীর কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় আরেফাদের বাড়িতেই এই বাকহীন ভালোবাসার সংসার শুরু হয়। ১৯৯৭ সালে জন্ম নেন তাদের প্রথম সন্তান। ঘর আলো করে আসা সেই সন্তানের নাম রাখেন মুক্তা। পুরো নাম আফরোজা মুক্তা। পরবর্তীতে জন্ম নেয় একটি পুত্র সন্তান। নাম রাখেন ইফতি। মুক্তা এবং ইফতিকে নিয়েই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী আরেফা ও মনজুরুলের দুই যুগের সংসার।

বিয়ের পর ২০০৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের নিউমার্কেটে টেইলার মাস্টার হিসেবে কাজ করেন মনজুরুল। পরে আরেফাদের বাড়িতে নতুন করে নিজেদের একটি টেইলারিং শপ খোলেন। মেয়ে মুক্তার নামে টেইলারিং শপের নাম দেন ‘মুক্তা টেইলার্স’।

২০০৭ সাল থেকেই মুক্তা টেইলার্স পরিচালনা করছেন আরেফা এবং মনজুরুল। দু’জন পরস্পরের সহযোগী। নিজের দক্ষতা দিয়ে স্ত্রী আরেফাকেও দক্ষ করে গড়েছেন মনজুরুল। চট্টগ্রাম মহানগরীর কয়েককটি স্বনামধন্য হাসপাতাল ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় পোষাকের সেলাইয়ের কাজ করেন এই দম্পত্তি।

টেইলারিং কাজ করেই ছেলে-মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছেন। মেয়ে আফরোজা মুক্তা বর্তমানে অনার্সে অধ্যায়নরত। ছেলে ইফতি ঢাকার মিরপুরে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ছে।

আফরোজা মুক্তা বলতে ও কানে শুনতে পেলেও মাতৃভাষা হিসেবে আত্মস্থ করেছেন ইশারা ভাষা। ইশারা ভাষায় দক্ষতার কারণে ইতোমধ্যে তিনি চট্টগ্রামে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন। তার ইশারা ভাষার গুণের কথা তথ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছেছে। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কল্যাণে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইশারা ভাষায় সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে চাকরি নিশ্চিত হয়েছে মুক্তার।

টেইলারিং কাজের আয়ের টাকায় ছোট ভাইকে দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তুলেছেন মনজুরুল। বর্তমানে সেই ভাই মধ্যপ্রাচ্যের একটি সরকারি হাসপাতালে উচ্চ বেতনে সরকারি চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে যার অবদানে তিনি আজকের এই অবস্থানে আছেন, সেই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ভাইটির কোনো খবর রাখেন না তিনি। সেজন্য কোনো দুঃখও করেন না মনজুরুল হক।

নিজেদের ভালোবাসার গল্প বলতে গিয়ে আরেফা খাতুন ইশারা ভাষার মাধ্যমে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দীর্ঘ দুই যুগের ভালোবাসার সংসারে তাদের কোনোদিন ঝগড়া হয়নি। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। পরস্পর একসাথে ভালোবেসে, সহায়তা করেই আমাদের সংসার চলছে। ’

মনজুরুল আলম বলেন, ‘আমরা কখনো কাউকে মুখে বলতে পারিনি ‘ভালোবাসি’। কিন্তু আমাদের প্রতিদিনই কাটে অকৃত্রিম ভালোবাসাবাসিতে। দীর্ঘ সংসারে কোনোদিন মনোমালিন্য হয়নি। আমার মেয়েটি নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি বাবা-মাকেও সর্বাত্মক সহযোগীতা করে।’

আগামী দিনের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে মনজুরুল আলম বলেন, ‘একমাত্র পুত্র ও কন্যাকে ঘিরেই আমাদের দু’জনের স্বপ্ন। তারা সমাজে একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে। সুনাম অর্জন করবে, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। এটাই আমাদের স্বপ্ন।’

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মনজুরুল আলম বলেন, ‘তথ্যমন্ত্রী আমার মেয়েকে নিজের মেয়ে হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই ভালোবাসার ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না।’ চট্টগ্রাম/রেজাউল/সনি