সারা বাংলা

সুনামগঞ্জের সীমান্তে হতে পারে পর্যটন অঞ্চল

সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে সৌন্দর্য আর ঐতিহ‌্যের লীলাক্ষেত্র যেনো মিলে মিশে রয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওর, হাসন রাজা মিউজিয়াম, ঐতিহ্য জাদুঘর, বারেকের টিলা, লাউড়ের রাজবাড়ী, গৌরারং জমিদার বাড়িসহ নানা ঐতিহ্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে একটি পর্যটন অঞ্চল। যা ব‌্যাপক সম্ভাবনাময়।

সুনামগঞ্জকে ঘিরে গত দশ বছরে পর্যটকদের সংখ্যা বেড়েছে। পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে টাঙ্গুয়ার হাওর। প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক দল টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে আসছেন। মাঝে মধ্যে আসছেন বিদেশি পর্যটকরাও।

সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওরে বিলাবহুল ট্রলার যুক্ত হওয়ায় পর্যটকদের অনেকেই এখন হাওরে রাত্রিযাপনও করেন। উপজেলা সদরে আবাসিক হোটেল থাকলেও হাওর দেখতে আসা ৯৫ ভাগ পর্যটকই নৌকায় রাত্রিযাপন করতে পছন্দ করেন। প্রতিটি দলে অন্তত ১৫/২০ জন করে পর্যটক থাকেন।

সাধারণত ছুটি ও বন্ধের দিনই পর্যটকদের আগমন বেশি হয়। টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে এসে পর্যটকরা মেঘালয় সীমান্ত সংলগ্ন দেশের বৃহত্তম শিমুল বাগান, শহীদ সিরাজ লেক (নীলাদ্রী লেক), লাকমা ছড়া, চাঁনপুর ঝর্ণা, বড়গোপ টিলা (বারেক টিলা), যাদুকাটা নদী, হাওর এবং সীমান্তে বসবাসকারী আদিবাসীদের জীবনযাপন দেখে মুগ্ধ হন।

পর্যটকদের সুবিধার্থে এসব এলাকার লোকজন পর্যটনকেন্দ্রিক নানা কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এতে তারা নিজেরা যেমন উপকৃত হচ্ছেন তেমনি পর্যটকদেরও আস্থা বাড়ছে।

ঢাকার ধানমন্ডি’র বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওর, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ লেক, বারেকের টিলা এবং যাদুকাটায় আসলে যে কারো মন জুড়িয়ে যাবে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর এই সীমান্ত এলাকা দেশের বৃহত্তম পর্যটন অঞ্চল হতে পারে। এই হাওর ঘুরে মনে হয়েছে, এখানকার সুবিধাজনক স্থানে পর্যটন মোটেল, কিংবা একটু ভাল মানের রেস্টুরেন্ট বা আবাসিক হোটেল বা কটেজ হতে পারে। রাতে পুলিশি নিরাপত্তা আরেকটু বেশি থাকলে ভাল হয়।’

হাওরে রাত কাটানোর জন‌্য রয়েছে বিলাসবহুল নৌকার ব‌্যবস্থা

 

হাওরে ঘুরে বেড়ানো ও রাত্রিযাপনের একমাত্র ব্যবস্থা নৌযান। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে তাহিরপুরের স্থানীয়রা বাহারী ও বিলাসবহুল নৌযান তৈরি করছেন। অন্তত ২০টি বিলাসবহুল নৌযান আছে এখানকার হাওরে। পর্যটকদের ভ্রমণকে নিরাপদ ও আনন্দময় করতে কম ভাড়ায় নৌযানগুলোতে ভ্রমণ ও থাকা-খাওয়ার ব‌্যবস্থা আছে। এগুলো ছাড়াও ছোট বড় আরো শতাধিক ভাড়ায় চালিত নৌযান রয়েছে।

বিলাসবহুল এসব নৌযানে ২২ জন পর্যটকের রাত্রিযাপন করতে পারবেন। তারা এসব নৌকায় নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকাতে পারবেন। এতে আলাদা কেবিন আছে, প্রতিটি কেবিনে দু’টি করে খাট পাতা। আছে বালিশ, লেপ, তোষক ও মশারির ব্যবস্থা।

এসব নৌযানে তিনটি করে টয়লেট রয়েছে। এর মধ্যে একটি হাই কমোড আর দুইটি ফ্ল্যাট কমোড। ফ্ল্যাট কমোডের একটি নৌকার স্টাফদের জন্য। নিজস্ব পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য আলাদাভাবে বেসিন দেয়া আছে। বেসিন ও টয়লেটে পানি সরবহরাহের জন্য ৩০০ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতার ট্যাংকি রয়েছে। নৌযানের নিজস্ব মোটরে এই রিজার্ভ ট্যাংকিতে পানি ওঠানো হয়।

সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবাহের জন্য আইপিএস-এর ব্যবস্থা রয়েছে। এর মাধ্যমে ল্যাপটপ বা মোবাইলে চার্জ দেয়া যায়। আর আলোর ব্যবস্থাতো আছেই। আইপিএসটি নৌকার ইঞ্জিন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হয়ে থাকে।

ইঞ্জিনের শব্দদূষণ ঠেকাতে থাই গ্লাস ব্যবহার করা হয়েছে। শক্তিশালী ইঞ্জিনে চলা নৌযানের গতি কমানো বাড়ানোর জন্য অটো গিয়ারের ব্যবস্থা রয়েছে। নৌযানের ছাদে একসাথে অন্তত দেড়শ’ লোক যে কোনো অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবেন।

নয়নাভিরাম বারেকের টিলা

 

তাহিরপুর উপজেলার রতনশ্রী গ্রামের আতাউর রহমান তালুকাদার জানান, হাওর দেখতে আসা পর্যটকদের জন্য তিনিই প্রথম বিলাসবহুল নৌযান নির্মাণ করেন। এই নৌযানে দিনের বেলায় ১৫০ থেকে ২০০ পর্যটক ঘুরে বেড়াতে পারেন। এ ছাড়া রাত্রিযাপনে পর্যটকের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

তাহিরপুরের লেখক ও শিক্ষক নেতা গোলাম সরোয়ার লিটন বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে বিলাসবহুল ২০টি নৌযানের পাশাপাশি ছোট-বড় আরো শতাধিক নৌযান রয়েছে। স্টিলের শিট দিয়ে তৈরি ছয়টি আকর্ষণীয় নৌযান তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে পর্যটকদের নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই হাওরে ঘুরছে। এসব নৌযানে পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দে রাত কাটাচ্ছেন।’

সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হায়াতুননবী টাঙ্গুয়ার হাওরে আসা পর্যটক ও নৌ-যান প্রসঙ্গে বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী নৌযানগুলোর ওপর তাহিরপুর থানা ও ট্যাকেরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির কড়া নজরদারী রয়েছে। হাওরে সময়ে সময়ে পুলিশ টহলও দিচ্ছে। সকল নৌযান চালকদের স্থানীয় থানা ও ফাঁড়ির পুলিশ অফিসারদের এমনকি, জেলা পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মুঠোফোন নম্বরও দেয়া আছে।’

ঢাকার থেকে আসা পর্যটক ক্রিস্টিনা গোমেজ বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওর দর্শনের জন্য সুবিধাজনক স্থানে আরো কয়েকটি পর্যটক টাওয়ার করা জরুরি।’

দৃষ্টিনন্দন শিমুল বাগান

 

হাওর ছাড়াও তাহিরপুরের যাদুকাটা নদীর নিকটবর্তী মানিগাঁও গ্রামে রয়েছে শিমুল বাগান। প্রায় ১০০ বিঘারও বেশি জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে এ বাগান। ২০০৩ সালের দিকে তিন হাজার শিমুল গাছ রোপন করেন জয়নাল আবেদীন নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। বসন্তকালে শিমুল বাগানের দিকে তাকালে গাছের ডালে ডালে লেগে থাকা লাল আগুনের ঝলখানি চোখে এসে লাগে। শিমুল ফুলের রক্ত লাল পাপড়িগুলো ভ্রমণপিপাসুদের মনকে রাঙিয়ে দেয়। এক দিকে মেঘালয়ের পাহাড় সারির অকৃত্রিম সৌন্দর্য্য অন্য দিকে রূপবতী যাদুকাটা নদীর তীরের শিমুল বাগানের আগুনলাগা রূপ পর্যটকদের মনে ভাল লাগার শিহরণ ধরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

তাহিরপুরের দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের লাকমা গ্রামের উত্তরেই ভারতের বড়ছড়া। খাসিয়া পাহাড়ের বুক চিরে নেমে এই লাকমা গ্রামের পাশ দিয়ে নেমে এসেছে ছড়াটি। যার নাম হয়েছে লাকমা ছড়া। সারা বছরই কমবেশি পানি থাকে এখানে। তবে বর্ষায় পানি একটু বেশিই থাকে।

দ্বিতীয় বিছানাকান্দি খ‌্যাত অপূর্ব সুন্দর লাকমা ছড়া

 

এক সময় ছড়াটিতে প্রচুর দৃষ্টিনন্দন মোটা মোটা পাথর- থাকলেও পাথর চোরাচালানিরা সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে পাথরের উপস্থিতি কমে গেছে। তারপরও এখানে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। নীলসবুজ পাহাড় বেয়ে নামা ছড়াটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অনেকেই সিলেটের বিছানাকান্দির সঙ্গে এ ছড়ার তুলনা করছেন। প্রতি শুক্রবার এখানে পর্যটকদের ভিড় বাড়ে। দিনদিন এটিও জনপ্রিয় হচ্ছে।

তবে টাঙ্গুয়ার হাওর যেনো একটু বেশিই টানছে পর্যটনপ্রেমিদের। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক আকর্ষণীয় নৌকা বাড়ানো ও ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে নৌ-মালিকদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। টাওয়ার বাড়ানোর জন্যও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলা হবে।’

এদিকে, গত ২১ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জের পর্যটন সম্ভাবনাময় সকল স্থাপনা ও স্থান সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন পর্যটন কর্পোরশেনের চেয়ারম্যান রাম চন্দ্র দাস। তিনি জানান, পর্যটক আকর্ষণীয় সকল স্থাপনাকে একটি নেটওয়ার্কে এনে যোগাযোগ, থাকা-খাওয়াসহ সকল উন্নয়নের চিন্তা করা হচ্ছে।

 

সুনামগঞ্জ/আল আমিন/সনি