সারা বাংলা

ময়না, বিউটি ও জোসনারা ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে যেভাবে

বিয়ের একমাস পর বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে ভারতের ব্যাঙ্গালোরের একটি নারী পাচার সিন্ডিকেটের কাছে জোসনাকে বিক্রি করে দেয় তার স্বামী।

১৮ বছর বয়সেই পারিবারিকভাবেই বিয়ের পিড়িতে বসেন জোসনা (ছদ্মনাম) । পাত্র সম্পর্কে তেমন কোনও খোঁজখবর না জেনেই দরিদ্র বাবা তাকে বিয়ে দেন।

বিয়ের একমাস পরই স্বামীর ভয়ঙ্কর রূপটি বেরিয়ে আসে। বেড়ানোর নাম করে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে একটি নারী পাচার সিন্ডিকেটের হাতে জোসনাকে তুলে দেয়া হয়। এরপর তাকে সেখানের বিভিন্ন হোটেলে নিয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয়। রাজি না হলেই জোটে মারধর, খেতে না দেয়া, সিগারেটের ছ্যাকাসহ বিভিন্নভাবে অমানুষিক নির্যাতন। দীর্ঘ তিনটি বছর এ অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সইতে হয় তাকে।

এরপর পরিচিত একটি পরিবারের সহযোগিতায় গর্ভাবস্থায় দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন জোসনা। কিন্তু নির্যাতনের সেই দাগগুলো এখনও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।

শুধু জোসনা নয়, প্রায় একই ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে ময়না ও বিউটি বেগমদেরও (ছদ্মনাম) । ভারতে পাচারের শিকার খুলনাঞ্চলের এসব নারীরা সম্প্রতি দেশে ফিরে বর্ণনা করেছেন সেখানকার সব লোমহর্ষক কাহিনী।

জানা গেছে, পাচারের শিকার জোসনা বেগম ফিরে এসে তার স্বামী আলমগীরের নামে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু অর্থের জোরে মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যায় সে। পরবর্তীতে তার স্বামী ক্ষমা চেয়ে আবারও জোসনাকে নিয়ে সংসার শুরু করে। কিছুদিন যেতে না যেতে আবারও ভারতে নেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন দেখাতে থাকে। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে খুলনায় বাবার বাড়ি চলে আসেন জোসনা। বর্তমানে মেয়েকে নিয়ে সুখে থাকলেও সর্বদা আতঙ্কে থাকেন তিনি।

জোসনা বেগম বলেন, ‘ওই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও গাঁয়ে কাটা দেয়। আমারে দিয়ে সে (স্বামী) অনেক খারাপ কাজ করাইছে। অনেক মাইর খাইছি তার হাতে। মাইরের দাগ এখনও আমার গায়ে আছে। এখন মেয়েটারে নিয়ে ভাল আছি। ওর জন্যিই বেঁচে আছি। আর শুধু আল্লার কাছে বিচার দিছি, আল্লাহই যেন ওকে সব কুকর্মের শাস্তি দেয়। আমি যেন নিজ চোখে দেখতি পারি।’

এমনই পাচার ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় আরেক তরুণী বিউটি (ছদ্মনাম)। দারিদ্রতার কারণে পাচারকারীর ফাঁদে পড়ে এক ছেলের সাথে বিয়ে দেয় বিউটির পরিবার। বিয়ের এক সপ্তাহ পর বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে চেতনা নাশক ওষুধ খাইয়ে ভারতে পাচার করে দেয় তার স্বামী। মুম্বাই শহরের এক পতিতালয়ে বিক্রি করা হয় তাকে। সেখানে একটি অন্ধকার রুমে আটক রেখে অসংখ্যবার গণধর্ষণ করা হয় তাকে। এছাড়া আবাসিক হোটেলে নিয়েও করানো হয়েছে নানা অনৈতিক কাজ। রাজি না হলে অমানুষিক নির্যাতন আর গায়ে সিগারেটের আগুনের ছ্যাকা দেয়া হয়। এমনকি ব্লেড দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় তার শরীর।

ঘটনাক্রমে জনৈক ব্যক্তির সহায়তায় বিউটি তার পরিবারের সাথে যোগাযোগের সুযোগ পায়। এরপর এক দেশীয় দালালের সহায়তায় গর্ভাবস্থায় সেখান থেকে পালিয়ে দেশে ফিরতে সক্ষম হন বিউটি। এরপর এক কন্যা সন্তানের জননী হন তিনি। বর্তমানে মেয়েকে নিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় নিজ বাড়িতেই মুদি দোকান পরিচালনা করছেন তিনি।

বিউটি বেগম বলেন, ‘ওখানে চার মাস ছিলাম। ওইসব কাজ করতে রাজি না হওয়ায় খেতে দিত না, মারধর করতো। সেখানে আরও ৭টা বাংলাদেশি মেয়ে ছিল। পরবর্তীতে জীবন বাজি রেখে জানালা ভেঙ্গে সেখান থেকে পালিয়ে আসি। বর্তমানে দোকান চালাচ্ছি। তবে মেয়েকে নিয়ে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। মেয়েটার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা হয়। তবে মনে সাহস রেখেছি।’

খুলনা মহানগরী থেকে পাচার হয় মাত্র এগোরো বছর বয়সী ময়না (ছদ্মনাম)। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে দাদা বাড়িতেই বড় হয়েছে সে। সংসারের দারিদ্রতার কারণে মা অন্যত্র কাজের সন্ধানে চলে যান। এ সুযোগে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে তারই স্বজনরা পাচারচক্রের সহযোগিতায় তাকে ভারতে নিয়ে যায়। এর দশ মাস পর একটি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয় তাকে।

শুধু জোসনা, ময়না বা বিউটি বেগমই নয়, তাদের মত শত শত নারী ও শিশু বাংলাদেশ থেকে পাচারের শিকার হচ্ছে। পাচারের পর তাদেরকে দিয়ে করানো হচ্ছে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ। পরবর্তীতে এসব নারী ও শিশুরা উদ্ধার হলে বা ফিরে এলেও সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে অবহেলার শিকার। অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হচ্ছে তাদের। এতে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন আগের অবস্থানে ফিরে যেতে, আবার অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে হতাশাগ্রস্ত জীবন কাটাচ্ছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতের মুম্বাই, হায়দরাবাদ ও কলকাতা দীর্ঘ দিন ধরেই বাংলাদেশি নারী-শিশু বিক্রির হাট (!) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাচারের শিকার ৬০ ভাগের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশের পাচারকারী সিন্ডিকেট নানা প্রলোভন দেখিয়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে নারী-শিশুদের তুলে দিচ্ছে ভারতীয় সিন্ডিকেটের কাছে। হাত বদলের পর ভারতের কলকাতা, মুম্বাই ও হায়দরাবাদের নারী পাচারকারী সিন্ডিকেট ভাগ্যহত অধিকাংশ নারী-শিশুকে তুলে দিচ্ছে সেখানকার পতিতালয়ে। সাতক্ষীরা-যশোর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের ১৮টি রুট দিয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে নারী ও শিশু।

এদিকে, গত ছয় বছরে শুধুমাত্র খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৯টি জেলা থেকে পাচারের শিকার ৩১১জন নারী-শিশুকে ভারত থেকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক গবেষণায়  উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে। পাচারের শিকার কিশোরীদের ৬০ ভাগের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভারতীয় একটি চক্র দালালদের মাধ্যমে এসব নারী-শিশুকে সংগ্রহ করছে। প্রতিটি নারীর জন্য দেওয়া হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। পরে এসব নারী ও  শিশুকে মুম্বাই, হায়দরাবাদ ও কলকাতায় নারী পাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেখানে একটি নারী পাচার সিন্ডিকেট তৎপর রয়েছে। এছাড়া ভারতের কেরালা রাজ্যের কোচি জেলা পুলিশ সম্প্রতি এক বাংলাদেশি নারীকে উদ্ধারের সময় তার কাছ থেকে জানতে পেরেছে যে, একটি ভারতীয় চক্র বাংলাদেশ থেকে নারী-শিশু নিয়ে তাদের পতিতালয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আর যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, নড়াইল, কুষ্টিয়া এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের ১৮টি পয়েন্ট পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

নারী-শিশু পাচার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রাইটস যশোর’র এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৯টি জেলা থেকে পাচারের শিকার ৩১১জন নারী-শিশুকে ভারত থেকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে খুলনা জেলায় ৬৮, বাগেরহাটে ২৩, যশোরে ১১৯, নড়াইলে ৫২, সাতক্ষীরায় ২৮, ঝিনাইদহে ৯, চুয়াডাঙ্গায় ২, কুস্টিয়ায় ৩৭ ও মাগুরায় ৩জন। তবে, উল্লিখিত সময় মেহেরপুর জেলার কেউ ফিরে আসেনি।

এ বিষয়ে রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, ‘মূলত: নানা দুর্বলতার সুযোগে কাজ দেওয়ার কথা বলেই সাধারণত: ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের ঘটনাগুলো ঘটছে। এছাড়া ভারত হয়ে দুবাইসহ অন্য দেশগুলোতেও পাচার করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশই প্রতারণার শিকার হয়ে নির্যাতন ও পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে, যাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে- তাদের ক্ষেত্রে মামলা হলেও রাষ্ট্রপক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হচ্ছে।’

এছাড়া বাদির নিরাপত্তাহীনতা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, নানাবিধ হয়রানি, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও পুলিশের অসহযোগিতা এবং পাচারকারী চক্রের পেশি শক্তি, কালো টাকা এবং অবৈধ ক্ষমতার প্রভাব বাদির ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনেকটা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

প্রতিষ্ঠানটির ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং অফিসার মো. তৌফিকুজ্জামান বলেন, ‘নানাভাবেই ভারতে নারী-শিশু পাচারের ঘটনা ঘটছে। যে কারণে খুলনাঞ্চল থেকে ঠিক কতজন পাচার হয়েছে- তার সংখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। তবে, শুধুমাত্র উদ্ধার হওয়া এবং ফেরত আসাদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।’ এর মধ্যে তারা ছয় বছরে ৩১১জনের ফিরে আসার তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন বলে জানান তিনি।

মহিলা আইনজীবি সমিতির খুলনা বিভাগীয় প্রধান অ্যাডভোকেট হামিদা লায়লা খান বলেন, ‘পাচারের দিক থেকে খুলনার ফুলতলা, ডুমুরিয়া ও দাকোপসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণেই এ ধরণের অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খুলনা/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/টিপু