সারা বাংলা

বিষাক্ত মাদকে ঝরে গেছে ৯ প্রাণ : দায় কার?

খুলনায় দুর্গা পূজার উচ্ছ্বাসে অবৈধ ও বিষাক্ত মদ পান করায় ঝরে গেছে নয়টি তাজা প্রাণ। কিন্তু এ ধরণের অপমৃত্যুর দায় নিচ্ছেন না কেউ।

এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে- এ ধরণের ঘটনার দায় আসলে কার?

এদিকে, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার দায় এড়াতে নড়েচড়ে বসেছে খুলনার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গঠন করা হয়েছে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি।

এ কমিটিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর খুলনার সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমানকে প্রধান করা হয়েছে। সদস্যরা হলেন পরিদর্শক হাওলাদার মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, এস আই নিরঞ্জন কুমার ও এস আই পারভিন আক্তার।

এ কমিটিকে রোববারের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. খালেদ মাহমুদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মদ পানের কারণেই এসব লোকের মৃত্যু হয়েছে। সেটি হতে পারে অতিরিক্ত মদপান অথবা ভেজাল মদ। সবকিছুই পাওয়া যাবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর।’

মদপানে মৃত অমিত শীলের স্বজন রমেশচন্দ্র শীল জানান, অমিত পূজার দিন বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে বাংলা মদ পান করেন। অতিরিক্ত মদ্যপান করায় অমিতসহ তিনজনই অসুস্থ হয়ে পড়ে। অমিতকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আইসিসিইউতে ভর্তি করান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় অমিত।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর খুলনার সহকারী পরিচালক ও গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মো. মিজানুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মদ পানে মৃত্যুবরণকারীদের বাসভবন পরিদর্শন করেছি। পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাচেনার ভিত্তিতে জানতে পারি, মৃতরা বিজয়া দশমীর রাতে স্পিরিটের সঙ্গে মদ মিশিয়ে পান করেছিলেন। লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো দোকানের মদ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটেনি। মৃতরা এ মদ কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে তা খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চলছে। র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরাও এ ব্যাপারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘খুলনার রূপসা উপজেলায় মৃত ইন্দ্রানী বিশ্বাস, পরিমল ও দীপ্ত একসঙ্গে ইন্দ্রানীর বাসায় বসে দশমীর রাতে নাচ গান করেছে। ওই সময় সেখানে তারা স্পিরিটের সঙ্গে মদ মিশিয়ে খেয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। আমরা মদের বোতলটি উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছি। বিষাক্ত মদ পানে নিহতরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাদের পেট ব্যথা, বমি ও মাথা ব্যথা হয়। এক পর্যায়ে তারা নিস্তেজ হয়ে পড়ে।’

তদন্ত টিমের সদস্য পরিদর্শক হাওলাদার মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকানে যে অ্যালকোহল বিক্রি হয় তা পরীক্ষিত। ওই অ্যালকোহল পানে কেউ মারা যাওয়ার নজির নেই। তবে, আমরা এর সঠিক কারণ উদঘাটন ও কোথা থেকে এ মদ এলো তা খুঁজে বের করতে তৎপর রয়েছি।’

   

এদিকে, খুলনায় অনুমোদিত দোকানের বাইরেও হরহামেশা মিলছে মদ। যত্রতত্র ছড়াছড়িতে খুলনায় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে খুব সহজেই মদ পৌঁছে যাচ্ছে। এর ফলে মদ খাওয়ার অনুমোদন পাওয়া ব্যক্তিদের বাইরের লোকজনও ইচ্ছা করলেই মদ পেয়ে যাচ্ছেন।

এতে করে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ ধর্মীয় ও পারিবারিক বিশেষ দিনে অহরহ মদপান করছে। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা বাহিনীর কোন প্রকার নজরদারি নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, মহানগরীতে দেশি মদের লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকান ছয়টি, ফুলতলা ও চালনায় ১টি করে রয়েছে। এছাড়া বিদেশি মদের দোকান রয়েছে ১টি। ক্লাব রয়েছে দু’টি। খুলনায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার লোকের মদ খাওয়ার অনুমোদন রয়েছে।

খুলনার পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বলেন, ‘মূলত দু’টি কারণে মানুষ মদ খেয়ে মৃত্যুবরণ করে। প্রথমত অতিরিক্ত মদপান, দ্বিতীয়ত ভেজাল মদ।’

তিনি আরো বলেন, ‘হতে পারে সাম্প্রতিক পুলিশি তৎপরতার কারণে চাহিদামত মদ পাচ্ছে না। এতে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন ড্রিংকসের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করে বিক্রি করছে। প্রকৃত মদ না পেয়েই মানুষ ভেজাল মদ খাচ্ছে। এই ভেজাল মদের কারণেই তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে  ঠিক কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে সেটি নিশ্চিত হওয়া যাবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর।’

খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘দেশি মদ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা তেমন ঘটে না। ভারতীয় ও চোলাই মদ খেয়ে এ ধরনের মৃত্যু হতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘যারা মদপান করেছে তাদের কোনো পারমিট ছিলো না। এই মদ কোন জায়াগা থেকে কিনেছে, কার মাধ্যমে এনেছে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এছাড়া ওই মদের মধ্যে বিষাক্ত কিছু ছিলো কি না, তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।’

উল্লেখ্য, ৮ অক্টোবর বিজয়া দশমীর রাতে খুলনার বিভিন্ন এলাকায় মদ্যপানে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদেরকে হাসপাতালে নেয়া হলে নয়জন মারা যান। মৃতরা হচ্ছে- মহানগরীর গল্লামারী এলাকার নরেন্দ্র দাসের পুত্র তাপস দাস (৩৫) ও তার ভাই প্রসেনজিত দাস (২৯), ভৈরব টাওয়ার এলাকার বাসিন্দা মানিক বিশ্বাসের পুত্র রাজু বিশ্বাস ওরফে রাহুল (২৫), গ্লাক্সোর মোড়ের বাসিন্দা প্রদীপ শীলের পুত্র সুজন শীল (২৬), রূপসা উপজেলার রাজাপুর গ্রামে সত্যরঞ্জন সাহার পুত্র পরিমল সাহা (৩০), নির্মল দাসের পুত্র দীপ্ত দাস (৩০) এবং রাজাপুর গ্রামের প্রবাসী সমীর বিশ্বাসের স্ত্রী ইন্দ্রানী বিশ্বাস (২৫), মহানগরীর রায়পাড়া ক্রস রোড এলাকার বাসিন্দা বিমল শীলের পুত্র অমিত শীল (২২) এবং আর্জেন আলী লেন এলাকার ধীরাজ বিশ্বাসের ছেলে মনোজিৎ বিশ্বাস (৫২)। খুলনা/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/জেনিস