সারা বাংলা

এত লাশ কেটেও চাকরি হলো না

মৃত লাশের সাথেই বসবাস তার। দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত লাশ, গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া লাশ, অমানবিকভাবে নিহত লাশ, তুলতুলে শিশুর লাশ আর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ফালা ফালা হওয়া লাশ- এই তার জীবন। হাজার হাজার লাশ কাটাছেঁড়া করেছেন। আর এ কাজেই পার করেছেন ১৫ বছর। তবুও চাকরি পাকা হলো না কদম আলীর। 

হরেক রকমের লাশের সাথেই জীবন গেঁথে নিয়েছেন ২৮ বছর বয়সি কদম আলী। চট্টগ্রাম মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের মর্গ সহকারী তিনি। ময়নাতদন্তের জন্য আসা লাশের কাটা-ছেঁড়া করা, লাশের ভেতর থেকে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বের করে আনা এবং শেষ পর্যন্ত লাশ সেলাই করে স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেয়াই তার কাজ। 

কদম আলী মাত্র সাড়ে ৩ হাজার টাকা বেতনে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে মর্গ সহকারীর কাজটি করছেন ২০০৬ সাল থেকে। এতোগুলো বছর কেটে গেছে, করেছেন নানা দেন-দরবার, আবেদন নিবেদন, কিন্তু তার চাকরিটা স্থায়ী হলো না। নিত্যদিন লাশের সাথে বসবাস করা মানুষটির জন্য মন গলেনি কারো। আর এখন চাকরি স্থায়ী হওয়ার বয়সটাও প্রায় ফুরিয়ে আসছে।

রাইজিংবিডির সাথে আলাপকালে কদম আলী জানান, ১৯৯০ সালে জন্ম তার। চট্টগ্রাম মহানগরীর এনায়েত বাজার চৈতন্যগলি এলাকায় নগরীর সবচেয়ে বড় কবরস্থান সংলগ্ন এলাকায় তার বাড়ি। জন্মের পর জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখছেন কবরস্থানে লাশের সাড়ি। সেই থেকেই যেনো লাশের সাথেই অন্যরকম প্রেম জমে গেছে তার।

মাত্র ১১ বছর বয়সে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল মর্গে লাশ আনা-নেওয়ার কাজে সহায়তাকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০১৬ সালে যোগ দেন চট্টগ্রাম মেডি‌ক‌্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ সহকারী হিসেবে। সেই থেকে এখনো আছেন মর্গে। অস্থায়ী ভিত্তিতে।

বেতন মাত্র ৩ হাজার ৫০০ টাকা। ঈদে বোনাস পাওয়া না পাওয়াও নির্ভর করে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মন মর্জির উপর। কদম আলী আবেদন করেন, কর্মকর্তাদের দয়া হলে সেই আবেদন অনুমোদন করে বেতনের সমপরিমাণ বোনাস প্রদান করেন। এভাবেই চলছে কদম আলীর জীবন।

কদম আলী রাইজিংবিডিকে জানান, তার পুরো নাম কদম আলী হলেও মর্গে সবাই তাকে লাশ ঘরের কদম নামেই চিনেন। প্রতিদিন ২ থেকে ৩টি লাশ তিনি কাটছেড়া করেন, কখনো কখনো এর চেয়েও বেশি। ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকদের সব ধরনের সহায়তা করেন কদম। মর্গের যে কোন লাশের খোঁজ খবর নিতে হলে কদম আলীই সবার ভরসা।

ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত কদম আলী দুই কন্যা সন্তানের জনক। লাশ কাটা-ছেড়া করে চিকিৎসকদের ময়নাতদন্ত কাজে সহায়তা করেছেন। নিষ্ঠার সাথে এই কাজটি তিনি করে যাচ্ছেন প্রতিদিন।

মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনে কি করে সংসার চলে-এমন প্রশ্নে কদম আলী বলেন, কিশোর বয়স থেকেই লাশের সাথেই জীবন জড়িয়ে গেছে। এখন চাইলে আর অন্য পেশায় যেতে পারি না। লাশের ময়নাতদন্তের পর চাইলে লাশের স্বজনরা কিছু খুশি করেন। তবে তিনি হাত পেতে কারো কাছ থেকে কখনো কিছু নেন না।

কদম আলী বলেন- লাশের সাথে তো ব্যবসা করা যায় না। মৃত লাশই আমার সর্বক্ষণের বন্ধু লাশ কাটতে কাটতে ক্লান্ত হলে লাশের সাথেই ঘুমিয়ে যান কদম আলী। আর লাশ কেটেই জীবনটা যেনো স্বাচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারেন সেই জন্য চান তার চাকরিটা যেনো স্থায়ী হয়।

নিজের লাশ কাটার লোম শিউরে উঠা নানা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে কদম আলী বলেন, বিভিন্ন সময় ছিন্নভিন্ন, গলিত, পঁচা অনেক লাশ মর্গে আসে। সবাই এসব লাশ থেকে দূরে থাকতে চাইলেও কদম আলীর কাছে এসব লাশও আপনজন। তবে কোন শিশুর লাশ মর্গে এলে কদম আলী নিজের কষ্ট চাপা দিয়ে রাখতে পারেন না। কদম আলী বলেন শিশুর লাশ মর্গে এলে এগুলো কাটা-ছেড়া করতে কান্না থামিয়ে রাখতে পারি না।

কদম আলী বলেন, আমার কোনো চাওয়া নেই। আমার স্থায়ী চাকরি পাওয়ার বয়সটাও এখন ফুরিয়ে আসছে। আমি কারো কাছে হাত পেতে চলতে চাই না। মাত্র সাড়ে ৩ হাজার টাকা বেতনে দুই কন্যা আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হয় না। আমি চাই আমার চাকরিটা স্থায়ী হোক। হাসপাতালের পরিচালক এবং প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একটু সদয় হলেই চাকরিটা স্থায়ী হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন কদম আলী। এই জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কদম। চট্টগ্রাম/রেজাউল/বুলাকী