সারা বাংলা

জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে জাগরণী পাঠাগার

নরসিংদীতে ৫০ বছর ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে জাগরণী নামের একটি পাঠাগার।

নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ ইউনিয়নের সিরাজনগর গ্রামের শিক্ষক ও হোমিও চিকিৎসক অছিউদ্দীন আহমদ ব্যক্তি উদ্যোগে নিজ বাড়িতে ১৯৬৮ সালে গড়ে তোলেন এই “জাগরণী” পাঠাগার।

এই পাঠাগারে ইতিহাস-ঐতিহ্য, জ্ঞানবিজ্ঞানসহ সব ধরনের প্রায় বিশ হাজারের অধিক বই রয়েছে। গবেষকদের জন্য রয়েছে দুর্লভ জ্ঞানগর্ভ তথ্য-উপাত্ত ভাণ্ডার। তাছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সাময়িকী ও পত্র-পত্রিকার বিপুল সমাহার।

এ পাঠাগারের বই পড়ে আলোকিত হচ্ছেন এলাকার শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণির মানুষ। প্রতিদিন আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে অনেকে বই পড়ছেন এই পাঠাগারে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে নিজের বই পড়ার আগ্রহ থেকেই এই উদ্যোগ নেন অছিউদ্দীন আহমদ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গ্রামীণ জনপদের এই বাতিঘরে দিনে দিনে বেড়েছে বই প্রেমি মানুষের আনাগোনা।

১৪ হাত দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি টিনের ঘরে প্রধান কার্যালয় ও সিরাজনগর গ্রামের পাশে রাধাগঞ্জ বাজারে ভাড়ায় নেয়া একটি ঘরে শাখা কার্যালয়ে চলছে বই প্রেমিদের জ্ঞান অন্বেষণ কার্যক্রম।

শিশু কিশোরদের বই থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য, বিনোদন, রাজনীতি, অর্থনীতি,উপন্যাস, প্রবন্ধ, রচনা সমগ্র, জীবনী, ছোট গল্প, কবিতা, ভাষাতত্ত্ব, দেশি-বিদেশি জ্ঞান বিজ্ঞানসহ সাহিত্যের প্রায় সকল শাখার বই রয়েছে এই পাঠাগারে। পছন্দের বই সহজে খুঁজে পেতে ক্যাটাগরি অনুযায়ী আলাদা আলাদা আলমারিতে সাজানো হয়েছে এ সকল বই।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও দুষ্প্রাপ্য প্রকাশনার খোঁজ মেলে এখানে। প্রতিদিন স্থানীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চাকরি প্রত্যাশী যুবক যুবতীসহ কয়েকশ মানুষ জ্ঞান অন্বেষণ করতে আসেন এখানে।

শুধু বই পড়া নয়, পাশাপাশি নানা ধরনের জ্ঞান অন্বেষণী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে জাগরণী। এরমধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ, সাহিত্য বার্ষিকী প্রকাশ, বই পাঠ প্রতিযোগিতা, বিতর্ক সভা, প্রকাশনা উৎসব, চিত্রাংকন ও রচনা প্রতিযোগিতা, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, আবৃত্তি ও সাহিত্য সভাসহ অন্যান্য কার্যক্রম।

ইতোমধ্যে এখানে বহু বইপাঠ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে ১৯৯৬ সালে শতাধিক প্রতিযোগী অংশ নেয়। বিজয়ী ৫০ জনকে পুরস্কৃত করা হয়। এর প্রথম পুরস্কারটি ছিল মূল্যবান স্বর্ণালংকার।

   

২০১২ সালের বইপাঠ প্রতিযোগিতায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এর প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কার ছিল যথাক্রমে ৫০ হাজার টাকা দামের দুটি কম্পিউটারসহ অনেক মূল্যবান উপহার সামগ্রী।

প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবশ্রেণির পাঠকদের জন্য খোলা থাকে পাঠাগারটি। বর্তমানে ২০ হাজারেরও বেশি বই থাকলেও পর্যাপ্ত জায়গা ও অবকাঠামোর অভাবে অনেকটা ঘিঞ্জি পরিবেশে বসেই বই পাঠ করতে হয় এখানে।

৫০ বছর ধরে সমাজ আলোকিত করে প্রশংসিত হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এ পাঠাগারটি। স্থানীয় বইপ্রেমী লোকজনের সহায়তার পাশাপাশি জীবনের সময় ও উপার্জনের বেশিরভাগ এ পাঠাগারের পেছনে ব্যয় করেছেন অছিউদ্দীন আহমদ।

৫০ বছরে মধ্যে যারা পাঠাগার পরিদর্শনে এখানে এসেছেন তার মধ্যে উল্লেখ্য হলেন, লন্ডনের অক্সফোর্ড ইউনিভারসিটির অধ্যাপক ইংরেজ কবি ড. উইলিয়ম রাদিচে, ব্রিটেনের পর্যটক দম্পতি টনি এন্ড মিলা, অষ্ট্রেলিয়ান ক্যানভেরা ইউনিভারসিটির অধ্যাপক ড. রইস উদ্দিন, নরসিংদীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক কাজী আখতার হোসেন, জেলা প্রশাসক জিল্লার রহমান, জেলা প্রশাসক কামাল উদ্দিন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিজন কান্তি সরকার, ঢাকাস্থ সৌদি এম্বেসির অনুবাদক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ও বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর মুজিবুর রহমান।

আদিয়াবাদ ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র মেহেদী হাসান বলেন, আমি বিকাল বা সন্ধ্যা বেলায় বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে এ পাঠাগারে প্রতিদিনই আসি। এখান থেকে সব বিষয়ের বই পড়া যায়। সমাজ বিজ্ঞান, ভূগোল, পৌরনীতি, ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞান ও ধর্মীয় বিষয় সবগুলো জ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারছি।

স্থানীয় শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, পাঠাগারটি আদর্শ মানব তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে পাঠাগার থাকাতে ব্যক্তিগত ভাবে আমি যেমন উপকৃত হয়েছি, তেমনি গ্রামের এবং গ্রামের বাইরে যারা আছেন তারা অনেকটা উপকৃত হচ্ছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা অহিদুল্লাহ বলেন, জাগরণী পাঠাগারটি আমাদের এলাকার একটি দৃষ্টান্ত। এখানে প্রতিদিন বহু পাঠক সমাগত হচ্ছে। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এ পাঠাগারটি সমাজকে আলোকিত করে যুব সমাজকে বই পড়তে উৎসাহিত করছে।

সিরাজ নগর উম্মুরকুড়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাহাবুবুর রহমান বলেন, পাঠাগারটি ৫০ বছর ধরে জ্ঞানের আলো বিতরণ করছে। এতে করে সমাজ উপকৃত হচ্ছে, মানুষ জ্ঞান অর্জন করে ব্যক্তি জীবনে কাজে লাগাতে পারছেন। যুব সমাজ মাদকসহ বিভিন্ন অন্যায় থেকে বিরত থাকছে। জ্ঞানের আলো বিকশিত করার যে প্রচেষ্টা জাগরণী করে যাচ্ছে এটা প্রশংসার দাবি রাখে।

জাগরণী পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা অছিউদ্দীন আহমদ বলেন, বই পড়তে আনন্দ পাই, বই পড়াতে আনন্দ পাই, সেজন্যই আমার এ প্রচেষ্টা। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জাগরণী পাঠাগারকে দেশের শীর্ষস্থানীয় গ্রামীণ পাঠাগারে পরিণত করার স্বপ্ন আমার।

তিনি আরো বলেন, আজকের যুবসমাজ সীমাহীন অনৈতিকতার দিকে ধাবিত। মাদক,পর্নোছবি ও ইন্টারনেট আসক্তিতে যুব সমাজ নিমগ্ন। এই যুবশক্তিকে ভালো বই পড়ায় উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে ধ্বংসমুখী জীবনকে রক্ষা করাই অত্র পাঠাগারের লক্ষ্য। যে কোনো বয়সী নারী-পুরুষকে অবাধে বিনা টাকায় পাঠাগারে বসে পড়ার সুযোগ রয়েছে। নরসিংদী/গাজী হানিফ মাহমুদ/জেনিস