সারা বাংলা

গরীবের প্রতি কৃষ্ণপদের ভালোবাসা

‘বাবা গত হওয়ার পর মা বড় অসুখে পড়ে। সেই থেকে এখনো পরের বাড়িতে কাজ করে মাকে নিয়ে আছি। বিয়ে করা হয়নি। বয়স ৬০ পার করেছি। গতবছরও আমি এ বাড়ি থেকে ডাল-ভাত, আলুর তরকারি খেয়েছি আর একটা কম্বলও দিয়েছিল। এবারও দিয়েছে। গরীবের দরদ গরীবই বোঝে’ কথাগুলো বলছিলেন খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার ভেন্নাবুনিয়া এলাকার নীলা রায়।

এ উপজেলা সদরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মাইটভাঙ্গা এলাকার কৃষ্ণপদ মণ্ডলের গরীবের প্রতি ভালোবাসার এ কথাগুলো অসহায়দের মুখে মুখে। প্রতিবছর অগ্রহায়ণে এলাকার অসহায় কৃষক-কৃষাণীকে নিমন্ত্রণ করেন তিনি। আয়োজন করেন ডাল, ভাত এবং আলুর তরকারি, থাকে নারিকেল, গুড়। খাওয়া শেষে থাকে পান-সুপারী। অতিথিদের যাওয়ার বেলায় প্রত্যেককে দেন শীত নিবারণের কম্বল।

কৃষ্ণপদ মণ্ডল নিজে একজন বর্গা চাষী। নিজের বলতে পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া ১০ শতকের ভিটে। পরের জমি চাষ করে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে বেশ সুখে আছেন। আর সেই সুখ নামক পাখিকে দরিদ্র, অসহায় কৃষক-কৃষাণীর মাঝে বিলিয়ে দিয়ে তিনি পান মহাসুখ।

অভাবের তাড়নায় ৯ম শ্রেণির পরে আর লেখা-পড়া হয়নি। কলম রেখে ধরতে হয়েছিল লাঙ্গল-জোয়াল। আজও সেই চাষাবাদের কাজ করেন পরের জমিতে। ছেলেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। আর ছেলে বৌকে পড়িয়েছেন মাস্টার্স পর্যন্ত। সবাই কৃষি কাজ করে।

তিনি মনে করেন, লেখা-পড়া শিখলেই চাকরি দরকার না। দেশে শিক্ষিত কৃষক দরকার। তবে একমাত্র নাতী দেশ মণ্ডলকে শেখাচ্ছেন দেশপ্রেম, মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা। এলাকার দরিদ্র-পিড়িত অসহায় মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে তাকে তৈরি করছেন চিকিৎসক হিসেবে।

এক সময় যাদের সঙ্গে যারা বিলে কাজ করতেন, আজ তারা অনেকেই গত হয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন তারাও রুগ্ন, অসহায় হয়ে পড়েছে। কিন্তু কৃষ্ণপদর হৃদয় কাঁদে তাদের জন্য। নিজের যে সামর্থ্য রয়েছে, তা দিয়ে বছরে একবার হলেও দু’মুঠো খাওয়াবে এবং শীত নিবারণে দেবেন কম্বল। আর সঙ্গে থাকবে সুখ-দুঃখের গল্প। ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছর অগ্রহায়ণে তার বাড়িতে হয় এমন আয়োজন। তার এ কাজে এগিয়ে আসে তার পরিবারের সকলে।

মাইটভাঙ্গা এলাকার নিলীমা মন্ডল জানান, ‘আমাগেরতো কেউ নিমন্তন্ন করে না। বছরে একবারই কৃষ্ণদার বাড়িতে নিমোন্তন্ন পাই। সঙ্গে আবার কম্বল। কত কষ্টে আছি, তা আমরা জানি। বড়লোক হলি হয় না, বড় মন থাকতি হয়।’

শারিরীক অক্ষমতা থাকায় খুববেশি কাজ করতে পারেন না মাইটভাঙ্গা এলাকার নরায়ণ মণ্ডল। বয়স ৬৫ পার করলেও দারিদ্রতার কারণে বিয়ে করেনি আজও। থাকেন সরকারি অনুদানের একটি বাড়িতে।

তিনি জানান, ‘পরের বাড়িতে, জমিতে কাজ করি। খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে পেটটা চলে। ভাল জামা, জুতো কিনতে পারিনে। তবে মনে মনে ভাবি, শীত আলি কৃষ্ণদার কাছ থেকে কম্বল পাবো, ভাল খাবারও পাবো।’

কৃষ্ণপদ মণ্ডলের ছেলের বৌ ঝুমুর মণ্ডল জানান, বাবার (শশুর) এ কাজটা আমাদেরও ভাল লাগে। আমাদের পরিবারের কেউ বাজে খরচ করে না। আমরা সেই খরচ বাঁচিয়ে বছরে একবার হলেও এ ধরণের কাজ করি। এ কাজ করতে মনের মধ্যে এক অন্যরকম তৃপ্তি পাওয়া যায়। যে দিন সবাই আসে, আমাদের কাছে বড় কোনো উৎসবের মতো লাগে।

কৃষ্ণপদ মণ্ডল জানান, অভাবকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এলাকার ঘুরে ঘুরে প্রকৃত অসহায়, গরীবকে বাছাই করি। প্রতিবছর ২০/২২ জন অসহায়, গরীব মানুষকে খাওয়াই আর শীতের জন্য কম্বল দেই। অনেক ধনীদের দেখেছি, তারা মারা গেছে। কিন্তু সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারেনি। সব দুনিয়ায় ফেলে গেছে। তাহলে কার জন্য এসব করবো? প্রয়োজনের বেশি গোচ্ছিত করে লাভ নেই। এর থেকে ভাল, নিজে সুখে থাকলাম আবার অন্যকেও সুখে রাখার চেষ্টা করলাম। নিজে ভোগ করে যে সুখ পাওয়া যায়, অন্যের মাঝে বিলিয়ে তার থেকে অধিক সুখ পাওয়া যায়।

এ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য গোবিন্দ বাছাড় জানান, কৃষ্ণপদ মণ্ডলের এই উদ্যোগটা অনেক ভাল। সমাজে অনেক ধনী মানুষ রয়েছে। সবাই যদি তার মতো এমন চিন্তা করে এগিয়ে আসতো। তাহলে সমাজ পাল্টে যেত, বদলে যেত দেশ। খুলনা/নূরুজ্জামান/বুলাকী