সারা বাংলা

এখনো টিকে আছে পুতুল নাচ!

পুতুল নাচ এখন আর আগের মতো দেখা যায়না। ডিজিটাল যুগের হাওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ।

বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে সুতা দিয়ে হাতের নৈপুণ্যে পুতুলের নাচ দেখে একসময় কতইনা মুগ্ধ হতো মানুষ। বিশেষ করে শিশুরাই মুগ্ধ হতো বেশি।

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের এই পুতুল নাচ এখনো বেঁচে আছে কুষ্টিয়ায়। আজো মাঝে মাঝে কোন কোন অনুষ্ঠানে দেখা যায় এই পুতুল নাচ ও গানের আসর।

কুষ্টিয়ার তেমনই একটি পুতুল নাচিয়ে দলের নাম ‘মনহারা পুতুল নাচ’। এই দলটির মালিক কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়ী ইউনিয়নের নওদাপাড়া গ্রামের মৃত সলিম মালিথার ছেলে আব্দুস কুদ্দুস।

তিনি জীবনের প্রায় সবটুকু সময় ব্যয় করে দিয়েছেন এই মনহারা’র পেছনে। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি এই ‘মনহারা পুতুল নাচ’ দলের হাল ধরেছেন। নিজ হাতে এখনো তৈরি করে যাচ্ছেন বিভিন্ন পালার জন্য পুতুল। পুতুল নাচিয়ে দেখে যাচ্ছেন আজো সুদিনে ফেরার স্বপ্ন।

পুতুল নাচের সাথে জড়িয়ে যাওয়া জীবনের গল্প বলতে গিয়ে আব্দুস কুদ্দুস বলেন, ‘১৯৬৫ সালে তখন আমার বয়স ৯-১০ বছর। আমার বাবা খুবই সৌখিন মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন গান-বাজনা শেখানোর জন্য এই ‘মনহারা পুতুল নাচ’ দলে নিয়ে যায়। সেখানে শুকচান মাল নামের একজন ওস্তাদের কাছে নিয়ে যায় আমাকে। আমি তখন দেখতে খুব সুন্দর ছিলাম। সেখানে মাস কয়েক পুতুল নাচের বিভিন্ন গান শিখি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে পুতুলের সাথে নাচ-গান করি। এরই মধ্যে ওস্তাদের প্রিয় হয়ে উঠি।’

বলেন, ‘প্রায় ১৬ বছর আমি পুতুল নাচের আসরে পুতুলের সাথে মেয়ে সেজে গান করি। ৪-৫ দিন অনুষ্ঠান করলে আমি ৫০-১০০ টাকা পেতাম।’

বলেন, ‘১৯৭২ সালে পুতুল নাচের দলটির দায়িত্ব পাই আমি। তখনো ওস্তাদ আমার সাথে থাকতেন। তারপর ওস্তাদ শুকচান অসুস্থ হয়ে মারা যান। দলে দুর্দিন নেমে আসে। মনহারা পুতুল নাচের দলে ছিল ১৪জন সদস্য। এর মধ্যে ১০জন গানের তালে পুতুলকে পরিচালনা করতো। বাকিরা বাদ্যযন্ত্র বাজাতো আর গান গাইতো।’

আব্দুস কুদ্দুস বলেন, ‘১৯৭৫ সালে আমি হারমনি বাজানোর প্রশিক্ষণ নেই কুষ্টিয়া শিল্পকলা থেকে। তারপরে দলের দুর্দিন কাটিয়ে উঠি। একটা অনুষ্ঠানে গেলে আরেকটি অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেতাম। তখন বেশ ভালোই চলছিল আমাদের পুতুল নাচ। কুষ্টিয়াসহ বেশ কিছু অঞ্চলে পুতুল নাচ করে বেশ সুনাম অর্জন করি।’

যাত্রার মতো পুতুল নাচেরও আছে পালা। তিনি বলেন, ‘কুষ্টিয়ার বাইরে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নাটোর, রাজশাহী, নড়াইল, ঢাকায় ‘রাজকন্যা মানিক মালা’, ‘সীতার বনবাস’, ‘রুপবান’, ‘গরীবের ছেলে’, ‘গরীবের মেয়ে’, ‘হিংসার পরিনাম’‘প্রেম সার্থক’ ও ‘কালু গাজী’ এসব পুতুল নাচের পালা করেছি। ঢাকার শিল্পকলায়ও ‘গুনাই সুন্দরী’ পালা করেছি। এছাড়াও আমি পুতুল নাচে সাপ, নৌকামাঝি, কুমার, মাছ, বাঘ, হনুমান, হরিণ, ঘোড়া প্রভূতি বিষয় নিয়ে গ্রাম্য জীবনভিত্তিক হাসি-ঠাট্টা ও তামাশামূলক গল্পে রচিত পুতুল নাচ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্যবার দেখিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘আমার এই মনহারা পুতুল নাচে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ‘সোনার যাদু’ও ‘রুপবান’। এছাড়াও ‘সাগর ভাষা’, ‘ফেরারী সম্রাট’, ‘নাচ মহল’, ‘ভিখারীর ছেলে’ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় পালা।’

২০০৭ সালে ঢাকায় শিল্প কলা একাডেমিতে পুতুল নাচ প্রতিযোগিতায় ‘মনহারা পুতুল নাচ’ দল সারা দেশের ৪৮টি পুতুল নাচের দলের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। এছাড়া ২০১৩ সালে এবং ২০১৬ সালেও আব্দুস কুদ্দুস পুতুল নাচের জন্য পুরস্কৃত হন।

তিনি বলেন, ‘পুতুল নাচে পুতুল তৈরি করতে যেমন অর্থের প্রয়োজন তেমনি এই নাচ-গান পরিচালনার জন্যেও অর্থের প্রয়োজন। বর্তমানে পুতুল নাচের শো করতেও নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। প্রশাসন আমাদের প্রোগাম করার অনুমতি দেয় না। এসব প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও দলটিকে খুব কষ্টে টিকিয়ে রেখেছি। জানিনা, সরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া আর কতদিন এভাবে টিকে থাকবে ঐতিহ্যবাহী এই ‘মনহারা পুতুল নাচ’ এর দল। তবে আমি যতদিন বেঁচে আছি এই পুতুলের সাথেই জীবনটা কাটিয়ে দেবো। মানুষের মনে একটু আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করবো।’

   

কুষ্টিয়া/ কাঞ্চন কুমার/টিপু