সারা বাংলা

চোখের সামনে মৃত্যু, অসহায় ডাক্তার

গতকাল বুধবার (২৪ জুন) রাত থেকে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে একটি পোস্ট। নোয়াখালীর হাতিয়ার এক চিকিৎসকের দায়িত্ববোধ আর রোগীকে বাঁচানোর লড়াই নিয়ে এই পোস্ট। শত চেষ্টার পরও রোগীকে বাঁচাতে না পারার দুঃখ ক্লান্ত-বিদ্ধস্ত ওই চিকিৎসককে ব্যাথিত করে তুলেছে। সে বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে ওই পোস্টটিতে।

গত মঙ্গলবারের (২৩ জুন) রাতের ঘটনা। তবে গতকাল বুধবার রাতে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।

বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) এ নিয়ে রাইজিংবিডির নোয়াখালী প্রতিনিধির সাথে কথা হয় ওই চিকিৎসকের সাথে। হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার তিনি। নাম ডা. নিজাম উদ্দিন মিজান।

ডা. নিজাম উদ্দিন মিজান বলেন, ‘এই পেশা হচ্ছে একটি মহান পেশা। এই পেশায় সব শ্রেণির মানুষের সাথে মেশা যায়। কর্তব্যের ভিতরে দেশপ্রেম থাকে। এই বোধদয় থেকে আমি হাতিয়ার মতো একটি রিমোট এরিয়ায় চাকরি করছি। সরকার আমাকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যে দায়িত্ব দিয়েছেন আমি সেটা পালনের চেষ্টা করছি মাত্র।’

চিকিৎসেবায় হাতিয়ায় অপ্রতুলতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো অক্সিজেন সিলিন্ডারের। চাহিদার তুলনায় খুবই কম। এখানে আইসিইউ সম্ভব না। সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ওষুধ যা পাই, তা দিয়ে মোটামুটি চলে। কিন্তু করোনা রোগীদের জন্য কিছু বিশেষ ওষুধ প্রয়োজন, যা সব সময় পাওয়া যায় না। মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে গিয়ে আনতে হয়।

‘মঙ্গলবার রাতের কথাই ধরুন। একবারে শেষ সময়ে হাসপাতালে আনা হয় পবন দাসকে। তার জ্বর ও শ্বাসকষ্ট ছিলো। সঠিক সময়ে তাকে হাসপাতালে আনা হলে এবং অক্সিজেন পেলে তাকে হয়তো বাঁচানো যেতো।”

ফেসবুকে তাকে নিয়ে ভাইরাল হওয়া পোস্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি আপনার কাছ থেকেই শুনলাম। এ নিয়ে কিছু বলার নেই আমার। আমি আমার দায়ত্ব পালন করেছিমাত্র। রোগীকে বাঁচাতে পারলে আমি সবচেয়ে খুশি হতাম। এভাবে হাতের উপরে কেউ মারা যাবে তা কল্পনা করাও কঠিন।’

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন, ‘ডাক্তার নিজাম নিজেকে রিস্কের ফেলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তা খুবই প্রসংশনীয়। হাতিয়ার মতো রিমোট এরিয়ায় তিনি যে সেবা দিচ্ছেন, তা অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। আমরা তার পাশে আছি। করোনার এই দুঃসময়ে আমরা তাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি। সব সময় তার পাশে থাকবো।’         

ফেসবুকে ডাক্তার নিজামকে নিয়ে যে পোস্টটি ঘুরে বেড়াচ্ছে, রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তা হুবুহু তুলে ধরা হলো-   

“রাত এগারোটা। ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছেন ডাঃ নিজাম। পিপিই খুলে বিছানা গা এলিয়ে দেবার জন্য শরীরটা ছেড়ে দিচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে খবরটা এলো। নীচে একজন রোগী এসেছে, খুব খারাপ অবস্থা তার।

শেষ রোগীকে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। ব্যস্ত না থেকে উপায়ও ছিলো না। রোগীর অবস্থা ভালো ছিলো না। বিকাল থেকে করোনা পজিটিভ রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওষুধ দিয়েছেন, লকডাউন করেছেন তিনি। তিন জায়গা ঘুরে এই রোগীর বাড়িতে গিয়ে দেখেন রোগীর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেনের মাত্রা মাত্র ৩৫ শতাংশ।

সাথে থাকা একজনকে দ্রুত পাঠিয়ে দিলেন তিনি হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অক্সিজেন সিলিন্ডার আনার জন্য। অক্সিজেন সিলিন্ডার আসার পরে অক্সিজেন দেওয়া হলো রোগীকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অক্সিজেনের মাত্রা উঠে এলো ছিয়ানব্বই শতাংশে। সমস্যা হলো অক্সিজেন সরিয়ে নেবার পরেই। রোগীর শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা সাথে সাথেই নেমে আসতে লাগলো।

বাইরে থেকে অক্সিজেন দিলে রোগী ভালো থাকে, সরিয়ে নিলেই দ্রুত নেমে আসতে থাকে। এই রোগীকে বাসায় রাখা মানে মৃত্যু নিশ্চিত, এটা ভেবে রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। হাসপাতালে নিয়ে এসে এই রোগীকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে কেটে যায় আরো কয়েকটা ঘণ্টা।

পিপিই পরেই নীচে নেমে আসেন ডাঃ নিজাম। হাসপাতালের সামনে রাস্তায় এক কিশোর তার নিথর বাবাকে কোলে নিয়ে রাস্তায় বসে আছে। কাঁদতে কাঁদতে সাহায্য চাইছে সবার। তার বাবাকে বাঁচানোর জন্য আকুল আর্তনাদ করছে সে। আশেপাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কেউই সাহায্য করছে না।

ডাঃ নিজাম দ্রুত গিয়ে রোগীর নাড়ি চেক করলেন। পালস নেই। রোগীকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে সিপিআর দেওয়া শুরু করলেন তিনি। একটা সময় পরে গিয়ে পালস পেলেন। তখনও সিপিআর চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সারাদিনের ক্লান্তির পরে এই কষ্টকর কাজটা করার জন্য শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই তার। তারপরেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।

বিকাল থেকে পিপিই পরা, মুখে এন৯৫ মাস্ক। ক্লান্তির সাথে শ্বাস নিতেও অসুবিধা হচ্ছিলো তার। একটা সময় পরে গিয়ে আর পারেন না তিনি। তিনি ক্লান্ত হয়ে থেমে যেতেই কিশোর ছেলেটা দায়িত্ব নেয়। পাশে থেকে দেখে বুঝে গেছে কীভাবে সিপিআর দিতে হয়। বাবাকে বাঁচানোর চেষ্টায় ক্রমাগত সিপিআর দিয়ে চলে সে। কিছুতেই মরতে দেবে না সে তার বাবাকে।

পাশে বসে রোগীর দিকে নজর রাখছিলেন ডাঃ নিজাম। হঠাৎ করেই রোগীর চোখ স্থির হয়ে গেলো। এটা দেখেই দ্রুত পালস চেক করলেন তিনি। পালস নেই। তার চোখের সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে রোগী চলে গেছে অন্য কোনো ভূবনে।

বাচ্চা ছেলেটা তখনও সিপিআর দিয়ে চলেছে। ওর কাঁধে আলতো করে হাত রাখলেন তিনি। ডাক্তারের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ছেলেটা, তারপরে বাবার মুখের দিকে। স্থির হয়ে গেলো তার হাত দুটো। অনভিজ্ঞ জীবনের সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাটা সয়ে গেলো সে নীরবে।

বাবা তার ফিরবে না আর কখনো।” মাওলা সুজন/সনি