সারা বাংলা

৭ বছর ধরে শরীরে গুলি বয়ে বেড়াচ্ছেন জেলে নজির হাওলাদার

জেলে নজির হাওলাদার জীবন জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনে মাছ আহরণ করতেন। সুন্দরবন লাগোয়া শরণখোলা উপজেলায় তার বাড়ি। বনের ওপর নির্ভরশীল তার পরিবার।

২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি বনদস্যুদের গুলিতে পঙ্গু হন তিনি। সে থেকে অসহ্য যন্ত্রণার কষ্টের জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন।  হুইল চেয়ার ও বিছানায় দিন কাটছে তার।

‘পিঠে ও কোমরের নিচে বড় বড় ছিদ্র হয়ে পচে যাচ্ছে। আর পিঠে বন্দুকের কার্তুজের যন্ত্রণা তো আছেই, সেটা মৃত্যুর থেকেও ভয়ানক। ' চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলছিলেন নজির হাওলাদার।

শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের উত্তর রাজাপুর গ্রামের রাজাপুর বাজারে কথা হয় পঙ্গু নজির হাওলাদারের সাথে।

বললেন, ‘সাত বছর ধরে হুইল চেয়ার ও বিছানায় শুয়ে দিন কাটছে। এখন হাত দিয়ে হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরাতেও কষ্ট হয়।  বাড়ি থেকে বের হয়ে বেশি দূর যেতে পারি না।  সকালে বের হয়ে স্থানীয় বাজার ও এলাকায় কষ্ট করে ঘুরি সারাদিন।যে যা দেয় তাই দিয়ে সংসার চালাই। '

জানালেন, স্ত্রী ও ৩ মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। বড় মেয়ের বয়স ১২, মেঝো মেয়ের বয়স ৯ ও ছোট মেয়ের বয়স ৭ বছর। 

তিনি বলেন, ‘অর্থের অভাবে ভালভাবে চিকিৎসা করাতে পারেনি। পরিবারের চার সদস্য ও নিজের বেঁচে থাকার জন্য এখন ভিক্ষাই ভরসা।'

কিভাবে গুলিবিদ্ধ হন, জানতে চাইলে বলেন- ‘সেবার আমরা স্থানীয় বাবুল মিয়ার ট্রলারে মাছ ধরতে সুন্দরবনে যাই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জিরো পার্টি নামের একটি বনদস্যু বাহিনী মুক্তিপণের দাবিতে ট্রলারসহ আমাদের চারজনকে ধরে নিয়ে যায়। আটকে রাখে ছাফরাখালির চরে। ট্রলার মালিক বাবুলের সাথে যোগাযোগ করে দস্যু বাহিনীর লোকেরা। বাবুল দস্যু মোশারফ বাহিনীকে পাঠান তার জেলেদের উদ্ধার করতে। ৯ জানুয়ারি রাতে মোশারফ বাহিনী ও জিরো পার্টির সাথে গোলাগুলি হয়। তখন আমার পিঠে গুলি লাগে। তারপর আমি অচেতন হয়ে যাই। এর কয়েকদিন পরে দেখি আমি বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে আছি। জানতে পারি আমাকে এখানে এনে ফেলে রেখে গেছে। কিন্তু চার-পাঁচ দিনেও আমার পিঠের রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি। '

‘আমার স্বজনরা জানালেন- পিঠে এখনও গুলি রয়ে গেছে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স না পেলে চিকিৎসকরা অপারেশন করবেন না। পরিবারের লোকেরা পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য থানায় গেলেও থানা থেকে কোন ক্লিয়ারেন্স দেয়নি। তারপরও চিকিৎসকদের হাতে পায়ে ধরে ১৪ দিন থেকেছি ওই হাসপাতালে। শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না পেয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাই। সেখানেও ১৪ দিন থাকি।  কিন্তু পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের অভাবে পিঠের গুলি বের করেননি চিকিৎসকরা। বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে আসি।  গুলির যন্ত্রণা আর পঙ্গুত্ব নিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু আমি মরে গেলে আমার সন্তানদের কি হবে?' 

কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘সাত বছরে অনেক হাসপাতালে গেছি। কিন্তু পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের অভাবে চিকিৎসকরা আমার গুলি বের করেননি। এলাকার সবাই জানে আমি জেলে। আমি চোর-ডাকাত না।  তারপরও আমার চিকিৎসা হয়না। দিন দিন আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছি। কোমরের নিচে ও পিঠে কয়েকটি ফুটো রয়েছে। পচে ওখান থেকে সব সময় পানি বের হয়। আর প্রথম দিকে সেখানে শুধু ব্যাথা করত।  কিন্তু বছর খানেক ধরে সারা শরীরে ব্যাথা করছে। এ ব্যাথা মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকেও বেশি। '

নজিরের স্ত্রী বলেন, ‘সুন্দরবনের বনদস্যুদের সরকার সহযোগিতা করে, পুনর্বাসন করে। কিন্তু বনদস্যুদের গুলিতে আহত আমার স্বামীর জন্য সরকারের কোন দয়া নেই। স্বামীর ভিক্ষার টাকা আমরা খাই। টাকার অভাবে বড় মেয়ের পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছি। ছোট দুই মেয়ে স্কুলে যেয়ে কারও সাথে মিশতে পারে না, বাবা ভিক্ষা করে তাই। সারাদিন সন্তানরা চোখের পানি ফেলে। '

স্বামীর চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন অসহায় এই নারী।

প্রতিবেশীরা বলেন, ‘সরকার বনদস্যুদের মাফ করে দিলেন। তাদেরকে টাকা পয়সা দিল, তাদের সম্মানের সাথে পুনর্বাসন করল। কিন্তু বনদস্যুদের গুলিতে আহত নজিরকে কোন সুবিধা দেওয়া হল না। তাকে যারা গুলি করল তাদেরও কোন বিচার হল না। হুইল চেয়ারে নজিরের কষ্টের জীবন দেখলে যে কারও চোখে পানি আসবে। '

স্থানীয় ইউপি সদস্য জাকির হোসেন খান বলেন, ‘নজির হাওলাদার সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে ডাকাতদের গুলিতে পঙ্গু হয়েছে। হুইল চেয়ারে থাকা অবস্থায় যখন তার খিঁচুনি ওঠে তা দেখার মত নয়, খুবই কষ্টের। তিন সন্তান নিয়ে সে খুবই অসহায় জীবন যাপন করে। আমরা তাকে ছোট-খাট যে সহযোগিতা পারি করি। কিন্তু বড় সহযোগিতা করার সামর্থ্য আমাদের নেই। '

স্থানীয় রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছাদুজ্জামান মিলন বলেন, ‘বনদস্যুদের গুলিতে পঙ্গু নজির হাওলাদারকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় তাকে সহযোগিতাও করেছি।  তার উন্নত চিকিৎসার জন্য আমরা চিন্তাভাবনাও করছি। তার সুস্থতার জন্য আমরা চেষ্টা করব। '

শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহিন বলেন, ‘নজির হাওলাদার ২০১৪ সালে বনদস্যুদের গুলিতে আহত হয়েছেন। যার কারণে বিষয়টি আমি অবহিত ছিলাম না। আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম। যতদূর সম্ভব তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করব। '

বনদস্যুদের গুলিতে আহত পঙ্গু নজির হাওলাদারের চিকিৎসারও আশ্বাস দেন তিনি।

 

বাগেরহাট/টুটুল/টিপু