সারা বাংলা

হারিয়ে যাচ্ছে ঘটকালি, ১৭০০ বিয়ের ঘটক চালান ইজিবাইক

প্রযুক্তির মাধ‌্যমে পাত্র-পাত্রীরা নিজেরা পরিচিত হয়ে নিজেরাই বিয়ের ব‌্যবস্থা করার প্রবণতা বাড়ায় হারাতে বসেছে ঐতিহ‌্যবাহী ঘটকালি পেশা। এ অবস্থায় আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হওয়ায় মেহেরপুরের ঘটকরাও পেশা বদলে সংসার চালাতে অন‌্য কাজ করছেন।

গাংনী উপজেলার রুয়েরকান্দি গ্রামের ঘটক আব্দুর রশিদ। ছোটবেলা থেকে ঘটকালির কাজ করতে করতে অভিজ্ঞ হয়েছেন, পুরো জেলায় সবার ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র। মনে কষ্ট নিয়েই পেশা বদলেছেন, চালাচ্ছেন ইজিবাইক।

ঘটক হাসান বলেন, ‘গত ১৫ বছরে সে ১৭০৩টি বিয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ১৫টি। এখন ঘটকালি না থাকায় ইজিবাইক চালিয়ে খাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগে ঘটক ছাড়া বিয়ে কল্পনা করা যেতো না। আর এখন বিবাহ উপযোগী তরুণ-তরুণীরা এমনকি বিধবারাও পালিয়ে বিয়ে করছে। তাছাড়া এখন ছেলে-মেয়েরা আর তাদের পরিবারের লোকজন নিজেরাই বিয়ের দেখাশোনা পর্বটি সেরে ফেলায় আর ঘটকের প্রয়োজন পড়ছে না। আগে ঘটকের আগমনে বিয়ে বাড়িতে নানা গীত চলতো, যা বিভিন্ন নাটকেও দেখা যায়। এখন আর যেমন বিয়ে নেই পারিবারিকভাবে, তেমন এ ঘটকালি প্রথাটির প্রচলনও হারাতে বসেছে।’

বিয়ের উপযোগী পাত্র ও পাত্রী ও তাদের পরিবারের মধ‌্যে সমঝোতা গড়ে তোলার কারিগর ঘটক এবং বিয়ের আনুষ্ঠানিক বৈধতার নিবন্ধনকারী কাজিদের সঙ্গে কথা বলে সারা জেলাতেই এই পেশার বিষয়ে একই চিত্র পাওয়া যায়।

তারা বলেন, কালের বিবর্তনে আজকাল ঘটকের আর তেমন প্রয়োজন পড়ে না। নিত্য প্রয়োজনীয় মোবাইল ফোনের বদৌলতে ফেসবুক, হোয়াট্স আপের মাধ্যমে ছেলে-মেয়েরা প্রেম  করে একাই বিয়ে সেরে নিচ্ছেন। এভাবে এখন পরিবারের লোকজন নিজেরাই বিয়ের ব্যবস্থা করছেন। এতে করে আয়-রোজগার হারিয়ে বাধ‌্য হয়ে মেহেরপুরে নামকরা ঘটকরাও অন‌্য পেশায় যেতে বাধ‌্য হচ্ছেন।  

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মিনাপাড়া গ্রামের ইমান আলী ছোটকালে মজা ও আনন্দের বশে এক বন্ধুর বিয়ে দেন পাশের গ্রামের এক অনাথ মেয়ের সঙ্গে। সেই সময় গ্রামের এক মৌলভির মুখে শুনেছেন ১০১টি বিয়ে দিলে জান্নাতি হওয়া যায়। এ থেকেই তিনি শুরু করেন ঘটকালি। গত ২২ বছরে কয়েক হাজার ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন সবাই তাকে ইমান ঘটক নামে চেনেন। তবে এখন আর ঘটকালিতে হাক ডাক নেই।

মেহেরপুর জেলা কাজি সমিতির সাধারণ সম্পাদক এমএকে খাইরুল বাশার বলেন, ‘এমনিতে বিয়ে হয়ে গেলে আসে ঘটক বিদায়ের পালা। ছেলে বা মেয়ের পক্ষ থেকে তিনি কিছু নগদ টাকা পান , সঙ্গে জামাকাপড় ও একটা ছাতা। কিন্তু আজকাল কাজি বিয়ে পড়ায় ঠিকই, কিন্তু ঘটকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। পাত্র-পাত্রীর পছন্দে-অপছন্দে ঘটকের দায়িত্ব পালন করছে মোবাইল ফোন।

মেহেরপুর আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম জানান, আগে থেকে এ ঘটকালি প্রথাটি চালু ছিল। আগে গ্রাম-গঞ্জে পেশাদার ঘটক প্রথা ছিল না। তারা টাকা পয়সা নিয়েও কোন চিন্তা করতো না। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে এ প্রথাটি ব্যাপকতা পায়। তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেও ঘটকের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। এতে খরচও বেশি। বর্তমানে কেউ আর বেশি খরচ করতে চাচ্ছে না। আবার নিজেরাই এ ঘটকালির কাজটি করছেন।

মেহেরপুর শহরের বাসস্ট্যান্ড পাড়ার ঘটক সেন্টারের স্বত্বাধিকারী আব্দুল হালিম বলেন, ‘২০০০ সালের আগে বিয়ের জন্য পাত্র ও পাত্রীর অভিভাবকরা আমাদের কাছে আসত। ছেলে-মেয়ের বায়োডাটা ও বিভিন্ন স্টাইলের রঙিন ছবি দিয়ে যেতেন। ঘটকালিতে একটা ফিস পেতাম। এখন আর ঘটকালি চলে না। রুটি রোজগারের জন্য অন্য পথ বেছে নিয়েছি।’

   

মেহেরপুর/মহাসিন/সাজেদ