সারা বাংলা

তাজরীন অগ্নিকাণ্ড: আহত শ্রমিকদের দুর্বিষহ ৮ বছর

আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বেঁচে আসলেও আট বছরেও সেই ভয়াবহতা ভুলতে পারেননি তাজরীনের আহত শ্রমিকরা। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। সাভারের আশুলিয়ায় আকাশে হঠাৎ উড়তে থাকে কালো ধোঁয়া। অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ১১৩ শ্রমিক। বেঁচে ফেরেন অনেকে। আগুন থেকে বেঁচে ফেরার আট বছর আজ।

এতদিন পরেও সেদিনের ভয়ালস্মৃতি তাড়া করে ফেরে আহত শ্রমিকদের। পোড়া শরীর, পঙ্গু দেহ নিয়ে বেঁচে আছেন তারা। ঘটনার পরপর কিছু আর্থিক সহায়তা পেলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি কেউ। আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসন না করায় অনেকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এখন ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কেউ দিন হাজিরায় লিফলেট বিলি করছেন, কেউ পিঠার দোকান দিয়েছেন, কেউ অন্যের দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

সবিতা রাণী। তাজরীনের সুইং অপারেটর ছিলেন। ভালো বেতন পেতেন। ঘটনার দিন তৃতীয় তলায় ছিলেন তিনি। সন্ধ্যায় হঠাৎ বেজে ওঠা কারখানার ফায়ার অ্যালার্মে ভয় ঢোকে তার মধ্যে। একসময় ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে পুরো ফ্লোরে। এরপর অনেকের সঙ্গে তিনি তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে শুরু হয় তার অনিশ্চিত পথচলা।

তিনি বলেন, দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে পেটের দায়ে কাজে ফিরেছেন। তবে কারখানায় কাজ করার মতো শারীরিক ক্ষমতা হারিয়েছেন। তারপরও কারখানায় ঘুরে ঘুরে কাজ না পেয়ে কয়েকজন আহত শ্রমিককে নিয়ে কারখানা শুরু করেছিলেন, তবে পুঁজির অভাবে সেটা দাঁড়ায়নি।

সবিতা বলেন, ‘এরপর অনেক কষ্টে একটা সেলাই মেশিন কিনে বাসায় টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করছি। পাশাপাশি একটি সংস্থার প্রচারণার জন্য বিভিন্ন জায়গায় লিফলেট বিতরণ করে দিন ৪০০ টাকা মজুরি পাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর সরকার যে সহায়তা দিয়েছে, তা চিকিৎসার পেছনে শেষ হয়ে গেছে। আমরা সহায়তা চাই না, ক্ষতিপূরণ চাই। আমরা যেন সুস্থভাবে চলতে পারি, সরকার ও বিজিএমইএ যেন সেই ব্যবস্থা করে।’

একই ফ্লোর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মেশিন অপারেটর শিল্পী বেগম। চিকিৎসার জন্যে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় সরকারি সাহায্যের তালিকায় নামটিও ওঠেনি তার। পরে আবার ফিরে আসেন নিশ্চিন্তপুরে। এখানে ভাড়া বাসায় ছোট মেয়ে ও পাগল বোনকে নিয়ে থাকেন তিনি। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাজরীনের শ্রমিক হিসেবে কিছুটা চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন। সরকারি সাহায্যের তালিকায় তার নাম ওঠেনি।

শিল্পী আরও বলেন, তাজরীনের ঘটনার পর শত চেষ্টা করেও কোনো কারখানায় চাকরি নিতে পারেননি। তাজরীনের শ্রমিকের কথা শুনলেই তাড়িয়ে দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। উপায়ন্তর না পেয়ে কখনও পিঠা বিক্রি করেন, আবার কখনও টেইলার্সের কাজ করে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন পার করছেন।

সুইং সুপারভাইজার সোলায়মান বলেন, চতুর্থ তলা থেকে লাফ দেওয়ার কারণে তার ডান পায়ের আট জায়গায় ভেঙে যায়। মাজায়ও ব্যথা পান। পরে পায়ে রড ঢুকানো অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। এরপর সুস্থ হলেও ভারী কাজ করতে পারেন না। এখনও কর্মহীন অবস্থায় বড় ভাইয়ের সংসারে বোঝা হয়ে কষ্টে দিন পার করছেন।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র সাভার-আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, তাজরীন ট্র্যাজেডির ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা সামান্য সাহায্য ছাড়া পুনর্বাসন সুবিধা পায়নি। আর দীর্ঘ দিন ধরে কর্মহীন থাকার কারণে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মানসিক অশান্তির আরেকটি কারণ দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া।

তিনি বলেন, তাজরীনের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের প্রকৃত পুনর্বাসন নিশ্চিত করা গেলে তারা দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যেও টিকে থাকার একটা অবলম্বন পেতেন।