সারা বাংলা

প্রতিবন্ধী ক্রিকেটার ইকবালের মানবেতর জীবন যাপন 

বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান ইকবাল হোসেন খান। দেশ-বিদেশে খেলেছেন একাধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচ। দেশের জন্য বয়ে এনেছেন সম্মান। নিজেও পেয়েছেন একাধিক পুরষ্কার। খ্যাতির দিকে দিয়েও পিছিয়ে নেই তিনি। তবে চরম আর্থিক অস্বচ্ছলতাকে কিছুতেই জয় করতে পারেননি এই গুণী ক্রিকেটার।

চরম আর্থিক সংকটে বিধবা মা ও প্রতিবন্ধী ভাইকে নিয়ে এখন অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটে ইকবালের। টাকার অভাবে সিডর ও আইলার তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড ঘরটিও সংস্কার করতে পারেননি। ভাঙা ঘরে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বসবাস করেছেন তারা। এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতার আশায় বুক বেঁধে আছেন ইকবাল। 

বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার মধ্যকালিকাবাড়ি গ্রামের ইয়াছিন খানের ছেলে ইকবাল হোসেন খান। বয়স যখন দেড় বছর, তখন পোলিও টিকা দেওয়া হয় তাকে। এরপরই পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইজড) হয়ে পড়েন তিনি। 

অদম্য মানসিক শক্তি, বাবা-মায়ের ভালবাসা ও চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে বড় হন। কয়েক বছর পরে কিছুটা সুস্থ হলেও বাম পায়ের শক্তি কমে যায়। বয়স যত বাড়ে, বাম-পায়ের হাঁটু থেকে পাতা পর্যন্ত চিকন হতে থাকে। একসময় স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন ইকবাল।

তারপরও থেমে থাকেননি ইকবাল। ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা থেকে অদম্য মনবল নিয়ে গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে ব্যাট হাতে মাঠে নামেন তিনি। দিন যত গড়ায় পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে ওঠেন প্রতিবন্ধী ইকবাল খান। 

পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে খুলনার একটি হোটেলে কাজ নেন ইকবাল। ফাঁকে ফাঁকে ক্রিকেটও খেলেন। একদিন শারিরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমে চান্সও হয়ে যায় ইকবালের। ৪-৫ বছরে দেশে-বিদেশে একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেছেন তিনি। 

জাতীয় টিমে খেললেও পরিবারের আর্থিক কষ্ট দূর হয়নি ইকবালের। তাই খেলার পাশাপাশি হোটেলের সেই কাজটিও করছেন। এভাবেই চেষ্টা করছেন মা ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছোট ভাইয়ের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে।

তবে করোনাকালীন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বন্ধের সাথে সাথে হোটেলের কাজও চলে যায় ইকবালের। ভাঙা ঘর নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে পুরো পরিবারটিকে। 

ইকবাল হোসেন খান বলেন, ‘‘বাবা মারা যাওয়ার পরে মায়ের মুখে এক মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার আশায় খুলনার একটি হোটেলে কাজ শুরু করি। পায়ের সমস্যার কারণে অন্যদের চেয়ে বেতন কম পেতাম। তবে কথা শুনতে হতো বেশি। সবকিছু সহ্য করে কাজ করে যেতাম। এরমধ্যে একটি পত্রিকায় বাংলাদেশ শারিরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমের জন্য ক্রিকেটার চেয়ে বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। বিজ্ঞাপন দেখে আমি আবেদন করি।

‘প্রায় পাঁচ হাজার প্রতিবন্ধী ছেলেদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশ শারিরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমে চান্স পাই। এরপর আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)-র তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশ শারিরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমের হয়ে দেশের বাইরে ও ভিতরে একাধিক আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলেছি। লিগও খেলেছি। 

‘আসলে আমাদের সুযোগ সুবিধা খুব কম। আমাদের এই টিমকে পরোক্ষভাবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ও বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) তত্ত্বাবধায়ন করে। তবে আমরা তেমন কোনো বেতন-ভাতা বা সুযোগ সুবিধা পাই না।’’

ইকবাল আরও বলেন, ‘‘আমরা ছয় ভাইবোন। চার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাইটি মানসিক প্রতিবন্ধী। মাত্র সাড়ে ৭ শতক জমিতে আমাদের বাড়ি। এছাড়া আর কোনো জমি নেই। মা ও ভাইয়ের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য খেলার পাশাপাশি একটি খাবার হোটেলে কাজ করতাম। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার পরে হোটেলটি বন্ধ হয়ে যায়। টুর্নামেন্টও বন্ধ। একইসঙ্গে উপার্জনও বন্ধ। 

‘সিডর ও আইলায় বাবার তৈরি কাঠের ঘরটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কোনোমতে সেখানে থাকি। বৃষ্টির পানি পড়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে পাওয়া ক্রেস্ট ও সনদপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যাট, প্যাডসহ খেলার সামগ্রী বহনের জন্য একটি ভালো ব্যাগও নেই। আমার মতো অসহায় শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের সহযোগিতার আওতায় আনার ব‌্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’’

ইকবালের প্রতিবেশী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হওয়ায় এলাকার ছেলেরা খেলতে নিতে চাইত না ইকবালকে। তারপরও একপ্রকার জোর করে এলাকার ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলত সে। গেল কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছে। কিন্তু ইকবালের বাড়ি ও পরিবারের অবস্থা খুবই নাজুক। মা-ভাইকে নিয়ে ঠিকমত খাবার জোগাড়ই করতে পারে না। তাদের ঘরে থাকার মতও ব্যবস্থা নেই।’

প্রতিবেশী মো. জামাল আকন বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ের একজন প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারের অবস্থা এত খারাপ এটা ভাবতেও কষ্ট লাগে। এলাকাবাসী হিসেবে আমরা সরকার ও স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের কাছে দাবি জানাই ইকবালের পরিবারকে থাকার জন্য অন্তত্য একটি ভাল ঘর দেওয়া হোক। পাশাপাশি ইকবালের ছোট ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রদানেরও দাবি জানাই।’

ইকবাল হোসেনের মা মোমেনা বেগম বলেন, ‘‘২০০২ সালে স্বামী মারা গেছেন। চার মেয়ে ও প্রতিবন্ধী দুই ছেলেকে নিয়ে সংগ্রাম শুরু হয়। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছি। এখনও কষ্ট কমেনি। এরই মধ‌্যে কোনমতে চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। বড় ছেলে ইকবাল যখন প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমে খেলা শুরু করে তখন ভেবেছিলাম, আমাদের সংসারে স্বচ্ছলতা আসবে। 

‘৪-৫ বছর ধরে খেলছে সে। তবু ভাঙা ঘর ভাঙাই রয়েছে। খাবার জোটে না তিন বেলা। থাকার মতো একটি ভালো ঘর, ঘরে একটা খাটও নেই আমাদের। একজন মানুষ বাড়ি এলে তাকে বসতে দেওয়ার মতো একটি চেয়ারও নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো মানবতার জননি। তার কাছে আমার প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য তাঁর কাছে দয়া ভিক্ষা চাই।”

বাগেরহাট জেলা ক্রীড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষ সরদার ওমর ফারুক বলেন, ‘বাগেরহাটের একটি প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় জাতীয় টিমে খেলছে এজন্য আমরা গর্বিত। ইকবাল হোসেনের আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য জাতীয় ক্রিড়া পরিষদ ও বিসিবির সঙ্গে যোগাযোগ করব।’