সারা বাংলা

ফুলের রাজ্য বিরুলিয়া

ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার একটি ইউনিয়ন বিরুলিয়া। তুরাগ নদ ঘেঁষা এই ইউনিয়নের ওপারেই রাজধানীর মিরপুর। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে বিরুলিয়ার প্রতিটি গ্রাম। বিরুলিয়া এখন ফুলের রাজ্য। 

এক সময় বিরুলিয়া ইউনিয়নের ২০-২৫টি গ্রামের কয়েকশ’ একর জমি পতিত পড়ে থাকতো। ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ভরা ছিলো এসব জমি। অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়ায় সেখানে সেচ সুবিধা না থাকায় চাষাবাদ হতো না বললেই চলে। তবে নব্বই দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে এই এলাকায় ফুলের চাষ শুরু হয়। এরপর কেটে যায় দশ বছর।  ঘটে যায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। একে একে সবাই ফুল চাষে উৎসাহী হয়ে ওঠে।

১৯৮৯ সালে বিরুলিয়ার সাদুল্ল্যাহপুর গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম গোলাপ চাষ শুরু করেন সাবেদ আলী। ওই সময় ২০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে সাবেদ গোলাপের বাগান করেন। তবে বৃদ্ধ সাবেদ থাকেন রাজধানীর মিরপুরের নবাবেরবাগ এলাকায়। সেখানেই তার বসতি। ১৯৭৯ সালে ১৬ বছর বয়সে সাবেদ আলী জাতীয় চিরিয়াখানার এক পরিচালকের বাসভবনের সহকারী মালি হিসেবে কাজ শুরু করেন। সকল ধরনের ফুল গাছের যত্ন ও পরিচর্যা করতেন সাবেদ। ওই বাগানে সকল ধরনের ফুল ছিল। তবে গোলাপের প্রতি ছিলো তার বাড়তি আকর্ষণ। তার নিজ বাড়িতে একটি ছোট গোলাপের বাগান স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। এরই মধ্যে গোলাপ চাষ ও পরিচর্যা পদ্ধতি রপ্ত করেন সাবেদ।

সাবেদ আলীর বর্ণনায়, ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে তিনি ৩৫০ টাকা দিয়ে দশটি গোলাপের চারা ক্রয় করে তার নিজ বাড়িতে রোপণ করেন। প্রথমে তিনি চারাগুলোকে টবে রোপণ করেছিলেন। ওই চারাগুলো থেকে আবার কলম শুরু করেন। এভাবে দুই বছরের মধ্য সাবেদ তার বাড়িতে একটা গোলাপ বাগান করে ফেলেন। তার বাগানের ফুল দেখতে প্রতিদিন আশপাশের লোকজন আসতো। কেউ কেউ তার বাগান থেকে শখ করে গোলাপ কিনতেন। তখন থেকেই গোলাপের চাহিদা সাবেদ আলীকে বাণিজ্যিক গোলাপ চাষের স্বপ্ন দেখায়। ১৯৮৯ সালে সাভারের সাদুল্লাহপুর এলাকায় ২০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে বাণিজ্যিক ভাবে গোলাপ চাষ শুরু করেন সাবেদ আলী।

তবে ওই সময় সাভারে ফুল চাষের শুরুটা সাবেদের জন্য খুব সহজ ছিল না। ফুলের বাণিজ্যিক বাজার সম্পর্কে স্থানীয়দের তেমন একটা ধারণা না থাকায় অনেকেই সাবেদ আলীকে উপহাস করতো। কিন্তু যখন তার বাগানের প্রচুর গোলাপ ফুল ফুটতে শুরু করলো। আর সেই ফুল সে রাজধানীর  শাহবাগের পাইকারি বাজারে ভাল দামে বিক্রি শুরু করলেন তখন স্থানীয়দের টনক নড়ে। পরের বছর সাবেদ আলী আরও ৩০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে বাগানের পরিধি বাড়ান। তার দেখাদেখি স্থানীয় কৃষকরাও ফুল চাষে আগ্রহী হন।

সাভার উপজেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর ও স্থানীয়দের তথ্য মতে, বিরুলিয়ার লাল মাটিতে প্রায় ৪০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল চাষ হচ্ছে। যার সিংহভাগই গোলাপ। এখানে চায়না গোলাপ, মিরিন্ডা গোলাপ, ইরানি গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্র মল্লিকা ফুল চাষের পাশাপাশি শুরু হয় অন্যান্য ফুলেরও আবাদ। আগে তুরাগ নদে খেয়া পার হয়ে রাজধানীর কাটাবনে ভোর রাতে ফুল নিয়ে যেত চাষিরা। ২০১১ সালের পর হতে বিরুলিয়া ইউনিয়নের ছোট কালিয়াকৈরে প্রতি রাতেই বসতো বিশাল ফুলের হাট। এরপর একটি বাজার চাহিদা পূরণ করতে না পারায় কয়েক কিলোমিটার দূরে মোস্তাপুর গ্রামে বসে আরো একটি ফুলের হাট। এভাবে গোলাপ চাষিদের উৎপাদনের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আয়ের পরিধি। এক সময়কার পরিত্যক্ত জমি নান্দনিক ওঠে নানা বাহারি ফুলের সৌন্দর্য্যে। 

প্রথমে সাদুল্ল্যাপুরকে মানুষ গোলাপ গ্রাম নামে চিনলেও বর্তমানে শ্যামপুর, মোস্তাপাড়া, বাগনীবাড়ী, কাকাবো, ছোট ও বড় কালিয়াকৈরসহ ২০-২৫টি গ্রামকে গোলাপ গ্রাম নামেই চেনে সবাই। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকদের আগমণও ঘটতে থাকে এই অঞ্চলে। এভাবেই বিরুলিয়া ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামই হয়ে ওঠে গোলাপ গ্রাম।

সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজিয়াত আহমেদ বলেন, এই বছর করোনার কারণে মাঝখানে ফুল বিক্রি হয়নি। এখন আবার বিক্রি হচ্ছে। তবে স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিক্রিটা আগের বছরের মতো এতটা হবে না। জাতীয় প্রোগ্রামগুলোও ওভাবে হচ্ছে না। গত বছর এই মৌসুমে ২০০ কোটি টাকার মতো ফুল বিক্রি হয়েছিল।  কিন্তু এবছর আমরা ইস্টিমেট করেছি ১০০-১২০ কোটি ফুল বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।