বৃদ্ধকালে ছেলে-ছেলের বউ যদি দেখভাল না করে তাহলে শ্বশুর-শাশুড়ির কষ্টের সীমা থাকে না। অনেকেই বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে বোঝা মনে করেন। এমন মনোভাবের কারণে পরিবারে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। বাবা-মাকে ছেড়ে পৃথক হওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটে।
এসব কারণে শেষ বয়সে এসে বিপাকে পড়তে হয় বৃদ্ধ বাবা-মাকে। অনেকের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। আবার অনেকে পুত্রবধূকে ভালো চোখে দেখেন না। এ কারণেও শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়।
তাই পরিবারে শান্তি ফেরাতে এবং শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে মিলেমিশে থেকে তাদের সেবাযত্ন করলেই করলেই উপহার পাচ্ছেন পুত্রবধূরা। ব্যতিক্রম এ উদ্যোগ নিয়েছেন টাঙ্গাইল সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মীর মোশারফ হোসেন। তিনি নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে উপহার পৌঁছে দিচ্ছেন পুত্রবধূদের হাতে। এমন ব্যতিক্রম উদ্যোগের জন্য অসংখ্য মানুষ মোশারফ হোসেনকে মোবাইল ফোনে উৎসাহ এবং অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
টাঙ্গাইল সদর থানা গেটের সামনে সম্প্রতি অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মীর মোশারফ হোসেন দুটি ফেস্টুন লাগিয়েছেন। তাতে লেখা রয়েছে ‘বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বাবা-মায়ের নিরাপদ আবাস। পুত্রবধূ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করে আল্লাহ তাকে আখিরাতে পুরস্কার প্রদান করবেন। শ্বশুর-শাশুড়িকে যে সেবা করবে এবং একসঙ্গে বসবাস করবে সেই ভাগ্যবতীকে পুরস্কৃত করা হবে।’
পুরস্কার গ্রহণের জন্য তার মোবাইল নম্বরও দেওয়া আছে সেখানে।
ইতোমধ্যে গত দুই দিনে (বুধবার বিকেল পর্যন্ত) সদর উপজেলার সাবালিয়া এলাকার তামান্না জাহান মিতু, পারভিন খান, থানাপাড়া এলাকার মির্জা সায়মা, আদি টাঙ্গাইলের সৈয়দ সুমাইয়া পারভিন, আকুরটাকুরপাড়া এলাকার মাহমুদা রহমান ও উম্মে সাদিকা, কলেজ পাড়ার শিউলি আক্তারসহ আট জনকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
পুরস্কার হিসেবে পুত্রবধূরা পাচ্ছেন টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, পোড়াবাড়ির চমচম ও ক্রেস্ট। একইসঙ্গে পরিবারকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছাও জানানো হচ্ছে।
সাবালিয়া এলাকার পুত্রবধূ তামান্না জাহান মিতু বলেন, ‘যেদিন থেকে স্বামীর ঘরে এসেছি সেদিন থেকে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নিজের বাবা মায়ের মতো মেনে নিয়েছি। তারও আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসে। আল্লাহর রহমতে তাদের নিয়ে খুব শান্তিতে আছি। পুলিশ কর্মকর্তার পুরস্কার পেয়ে আমি আরো উৎসাহ পেলাম।’
একই এলাকার পারভীন খান বলেন, ‘এক সময়ে আমি শাশুড়ি হব। সেই চিন্তা করেই বিয়ের পর থেকে শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। কোনো পুরস্কার পাওয়ার আশায় তাদের সম্মান করিনি। আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার আশায় সম্মান করি। ওসি সাহেবের পুরস্কার পেয়ে আমি খুব আনন্দিত।’
শহরের থানা পাড়া এলাকার মির্জা সায়মা বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পেরে পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বাসায় এসে পুরস্কার দিয়ে গেছেন। পুরস্কার পেয়ে আমার খুব ভাল লাগছে। তবে সকল পুত্রবধূর উচিৎ তার শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের বাবা মায়ের মতো সম্মান ও ভালবাসতে হবে। তাহলেই পরিবারে শান্তি ফিরবে বলে আমি মনে করি।’
তামান্না জাহান মিতুর শ্বশুর আবু সাইদ বলেন, ‘আমার ছেলের বউ আমাদের দুজনকে খুব সম্মান করে ভালবাসে। আমরাও তাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করি। আমার পুত্রবধূর মতো সবাই হলে বৃদ্ধকালে কাউকে আর বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হবে না।’
ওসি মীর মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আমি লক্ষ্য করেছি বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের অবহেলায় বাবা ও মা অযত্মে জীবন যাপন করেন। অনেকেই ঠিকমত খাবারও পান না। আর্থিক অবস্থা ভালো সন্তানেরা বাবা-মাকে ছেড়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে আলাদা বসবাস করে। অনেক সন্তানরাই ভুলে যায় এই বাবা-মা দিনরাত পরিশ্রম করে এই সন্তানের মুখে আহার তুলে দেন এবং উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। তারা এও ভুলে যায় তাদেরও একদিন বৃদ্ধ হতে হবে। অনেক সন্তান কাজের প্রয়োজনে বাইরে ব্যস্ত থাকে। তাদের বাবা-মা পুত্রবধূর কাছে বেশি সময় কাটান। আমার উদ্দেশ্য ওই পুত্রবধূদের উৎসাহিত করা। যাদের দেখে অন্য পুত্রবধূরাও তার শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মান করবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে চলে যায় এবং অনেকের একাধিক সন্তান থাকার কারণে বাবা-মাকে ভরণপোষণ নিয়ে ঠেলাঠেলি করে দূরে সরিয়ে দেয়। সেসব সন্তান ও পুত্রবধূর প্রতি প্রতিবাদ স্বরূপ এই আয়োজন করেছি। যাতে কোনো বাবা-মাকে অবহেলার শিকার বা বৃদ্ধাশ্রমে যেতে না হয়।’