সারা বাংলা

পাউবো’র ভুলে ‘কোমায়’ সুবন্ধি নদী, বিপাকে কৃষক-জেলেরা

নদীশাসনের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়ায় বরগুনার আমতলীর সুবন্ধি নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর তীর দখল করে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন পাকা-আধাপাকা স্থাপনা। এর ফলে নদীর যে অংশে সামান‌্য পানি রয়েছে, তা পরিণত হয়েছে হাজামজা জলাশয়ে। সেখানে জমে উঠেছে কুচুরিপানা। সেই কচুরিপানা ও স্থাপনার বর্জ‌্যে তৈরি হয়েছে মশার অভয়াশ্রম। আর আবর্জনা পচে দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এরফলে এককালের প্রমত্তা সুবন্ধি নদী এখন কোমায় চলে গেছে।

এতে একদিকে নদীতীরের বাসিন্দাদের পড়েছেন বিপাকে, অন‌্যদিকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। আর প্রয়োজনীয় পানির অভাবে কৃষিকাজও ব‌্যাহত হচ্ছে।       পাউবো-সূত্রে জানা গেছে, আমতলীর পায়রা নদী ও কলাপাড়ার রামনাবাদ চ্যানেলের সংযোগ স্থাপন করেছিল বরগুনার আমতলীর সুবন্ধি নদী। ত্রিভুজ আকৃতির এই নদীর দৈর্ঘ‌্য ৭২ কিলোমিটার। আর প্রস্থ ২০০ মিটার। এই নদী উপজেলার চারটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ২৫টি গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। 

দখলদারের কবলে সুবন্ধি নদী

১৯৬৩ সালে রামনাবাদ অংশে তীব্র ভাঙন দেখা দিলে সমাধান হিসেবে আমতলীর অংশ ভরাট করে নদীশাসন শুরু করে পাউবো। এরপরই যৌবন হারাতে থাকে সুবন্ধি। এর দীর্ঘদিন পর ৩০০৯ সালে জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার হাত থেকে কৃষিসম্পদ রক্ষার অজুহাতে  এই নদীর কলাপাড়ার অংশও আটকে দেয় পাউবো। স্থানীয়রা বলছেন, মূলত এরপরই ‘কোমায়’ চলে যায় সুবন্ধি।   সরেজমিনে দেখা গেছে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা পাকা স্থাপনা তৈরি করেছেন। কেউ কেউ করেছেন মাছের ঘের। ময়লা আবর্জনার স্তূপে চাপা পড়ে গেছে সুবন্ধির প্রাণ। কচুরিপানায় ঢেকে গেছে  পুরো সুবন্ধি। কচুরিপানা পচে পানি নষ্ট হওয়ায় তিন ফসলি জমি এখন এক ফসলিতে পরিণত হয়েছে।  

আমতলীর বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা মোতালেব সিকদার, রফিকুল ইসলামসহ স্থানীয়রা জানান, নদীর দুই পাশে বেড়িবাঁধ দেওয়ার পরই কচুরিপানা পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে এখানে প্রচুর মশা জন্ম নিচ্ছে। মশার কামড়ে টিকে থাকা দায়। পৌরসভা থেকে মাঝে মাঝে স্প্রে করার পরও কমছে না মশা। তারা আরও জানান, বাঁধ দেওয়ার পরই দখলদাররা নদীর প্রায় অর্ধেক দখল করে নিয়েছেন। কেউ কেউ নিজেদের মতো করে বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের করেছেন।

আমতলীর চাওড়া এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হাওলাদার, জাফর হাওলাদার, সোহাগ মিয়া, ছগির বলেন, ‘এক সময়ে সুবন্ধিতে মাছ ধরে সংসার চালাতাম। এখন নদীর দু’পাশে বাঁধ দেওয়ায় পুরনো পেশা ছাড়তে বাধ‌্য হয়েছি।’

দখলে পড়ে মৃত প্রায় নদী

একই এলাকার হাফিজুল ইসলাম, বারেক মিয়াসহ বেশ কয়েকজন কৃষক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বেড়িবাঁধ দেওয়ার আগে এসব জমিতে তিন ফসলি জমি ছিল। কিন্তু বাঁধ দেওয়ার পরে পানির অভাবে ৩ ফসলি জমি এখন দুই ফসলিতে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোথাও এক ফসলের বেশি হয় না।’   স্থানীয় কৃষকরা আরও বলেন, ‘বরিশাল বিভাগে তরমুজের জন‌্য বিখ্যাত ছিল আমতলী। তবে, ২০০৯ সালে কলাপাড়া অংশে বেড়িবাঁধ দেওয়ার পর থেকে তরমুজ চাষে ধস নামে।’

পিপলস ভয়েজ আমতলীর আহ্বায়ক শাহাবুদ্দিন পান্না রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পাউবো নদীশাসনের জন্য ভুল পরিকল্পনা করে নদীর দু’পাশ বন্ধ করে দিয়েছে। দেশের ইতিহাসে এমন খারাপভাবে আর কোথাও নদীশাসন হয়নি। দুই পাশ বন্ধ করে না দিয়ে শুধু ব্লক দিয়েই নদীশাসন করতে পারতো। সুবন্ধি নদীর থেকেও তীব্র ভাঙন ছিল পায়রা নদীর তালতলী অংশে। তালতলী উপজেলা রক্ষা করতে শুধু ব্লক দিয়েই নদী শাসন করেছে পাউবো। আর সুবন্ধি নদীর শাসনের ক্ষেত্রে পাউবোর ভুল পরিকল্পনার মাশুল গুনছেন আমতলীর বাসিন্দারা।  তরমুজ ও ধান নিয়ে কৃষি খাতে বছরে লোকসান হচ্ছে ২১৯ কোটি টাকা।’

পাউবোর ভুলে মরা নদী এখন হাজামজা জলাশয়, মশার অভয়াশ্রম

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনার পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কাইছার আলম বলেন, ‘১৯৬৩ সালে প্রথম এই নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়। তখন কী কারণে দেওয়া হয়েছিল, তা এখন আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এরপর দ্বিতীয় দফা ২০০৯ সালে নদীভাঙন ঠেকাতে বাঁধ দেওয়া হয়। ওই সময় যারা এই বাঁধ দিয়েছিলেন, তারাই বলতে পারবেন।’

নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘কচুরিপানা অপসারণ, সুবন্ধী ও এই নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১৩ খালের জোয়ার-ভাটার প্রবাহ স্বাভাবিক করতে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি।’ শিগগিরই নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার  উদ‌্যোগ নেওয়া হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ  করেন।