সারা বাংলা

‘পয়সা ইনকাম করতি পারলি সগলি দাম দেয়’

আপনি যদি একজনের ঘাড়ের পর বসে খান তালি দাম পাবেন না। যদি আয় করতি পারেন, আপনার কাছে যদি টাহা থাহে, তালি সগলি আপনারে দাম দিবি, আদর করবি, ভালোবাসপি—গড়গড় করে কথাগুলো বলছিলেন ফরিদা বেগম (৪৫)।

ফরিদা বেগমের বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরের সূর্যকুণ্ডু গ্রামে। দরিদ্র এই নারী বাড়ি বসে নানা কাজ করে বাড়তি আয় করেন। এভাবে তিনি স্বামীর সংসারের উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছেন।

স্বামীর আয়ের পাশাপাশি এক নারী হিসেবে তিনিও আয় করেন। স্বামীর নিজের আয়ের টাকা ও তার আয়ের টাকায় অভাব তাড়িয়েছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। সংসারে এসেছে কিছুটা সমৃদ্ধি।

মাত্র তেরো বছর বছর বয়সে স্বামী আনোয়ার মোল্যার সংসারে আসেন ফরিদা বেগম। এসে দেখেন স্বামীর চাল চুলো জায়গাজমি কিছুই নাই। চারদিক শুধু নাই আর নাই। দিনমজুরের কাজ পেলে ভাত জোটে, না হলে নয়। দুই ছেলে এক মেয়ে সংসারে যোগ হলে অভাব আরও বেড়ে যায়।

তিনি চিন্তা করলেন খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে হলে আয় করতে হবে। এই চিন্তা থেকে কিছু আয় করার চিন্তা করেন তিনি। এরপর রাস্তা-মাঠ থেকে গরুর গোবর সংগ্রহ শুরু করতে শুরু করেন ফরিদা বেগম। সেই গোবর দিয়ে জ্বালানি তৈরি শুরু করলেন তিনি। স্থানীয়ভাবে তা বোড়ে নামে পরিচিত। একটি গোবরের বোড়ে ২৫ টাকায় বিক্রি শুরু করলেন। মাসে দেড় থেকে দুই হাজার বোড়ে বিক্রি করে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা আয় করতে লাগলেন।

এ টাকায় গরুর বাছুর কিনলেন। একটি গরু থেকে তিনটি গরু হলো। গরু বিক্রির টাকায় টিনের ঘর তুললেন। এরপর একসময় স্বামীকে লিজের কৃষি জমি নিয়ে দিলেন। তিনি অন্যের জমিতে দিনমজুরের পরিবর্তে নিজের জমিতে কাজ শুরু করলেন। বছর সাতেক পরে ১৫ শতক কৃষি জমি কিনেন। এখন নিজের মোট কৃষি জমি দুই বিঘার ওপরে। তার স্বামী  আনোয়ার এখন চাষবাসের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। তিন ছেলে মেয়ের সবাই স্কুল-কলেজে পড়ছে।

সংসারের উন্নতির জন্য এ নারী জ্বালানি তৈরি, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি পালন থেকে শুরু করে ধান মাড়াই, পাট থেকে আঁশ সংগ্রহ, ছেলে-মেয়ের দেখাশোনাসহ সব কাজ করেন। কাকা ডাকা ভোরে সংসারের কাজ শুরু করেন এরপর তা চলে মধ্যে রাত পর্যন্ত।

নিজের নামটা পর্যন্ত লিখতে জানেন না ফরিরদা বেগম। তার ছেলে-মেয়েরা অনেক লেখা পড়ালেখা শিখছে ভেবে তার চোখ ভিজে ওঠে।

ফরিদা বেগম মনে করেন, সবই সম্ভব হয়েছে বাড়তি নিজের উপার্জনের জন্য। শুধু স্বামীর আয়ের ওপর বসে থাকলে তিনি অভাব তাড়াতে পারতেন না। প্রতিটি নারীর উচিত অর্থ উপার্জন করা, স্বাবলম্বী হওয়া ও নিজের পায়ে দাঁড়ানো। একজনের একার পক্ষে উন্নতি করা সম্ভব নয়। স্বামী-স্ত্রী মিলে কঠোর পরিশ্রম করলে সমৃদ্ধি আনা সম্ভব।তিনি নারী –পুরুষ বা ছেলে-মেয়েকে আলাদা করে ভাবেন না। সবাই যদি বুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে কাজ করেন তাহলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

৮ মার্চ আন্তজার্তিক নারী দিবস সম্পর্কে কিছু জানেন কীনা জিজ্ঞাসা করলে তিনি লজ্জায় মুখের কাপড় আরকেটু টেনে বলেন, ‘আমরা পড়া লেহা না জানা মানুষ, ওসব জানিনে। নারী দিবস কী সেটা বুঝি না।’

ফরিদার স্বামী আনোয়ার মোল্যা বলেন, ‘আমার ঘরে আসার পরদিন থেকে সে (ফরিদা) আমার সংসারের অর্ধেক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। প্রথমে অনেকে অনেক কথা বলতেন। এখন তারাই ফরিদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।’

ফরিদা বেগমের প্রতিবেশি মহম্মদপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নওশের আলী বলেন, ‘ফরিদা বেগম একজন কর্মঠ নারী হিসেবে এলাকায় ব্যাপক পরিচিত। দরিদ্র দিনমজুর স্বামীর সংসারে বাড়তি উপার্জন করার মাধ্যমে স্বচ্ছলতা এনেছেন তিনি। ফরিদাকে অনুকরণ করে এলাকার অনেক নারী আজ অর্থ উপার্জন করে সংসারে অবদান রাখছেন।’