সারা বাংলা

ব্র্যান্ডিং জেলা লালমনিরহাটেই ভুট্টা চাষিদের দুর্গতি

উত্তর জনপদের সীমান্ত জেলা লালমনিরহাটে ৯০ এর দশক থেকে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। ২০১৮ সালে থেকেই জেলাটি ভুট্টার জেলা হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে।

সময়ের ধারাবাহিকতায় ভুট্টা চাষে যুক্ত হয়েছেন এখানের প্রান্তিক চাষি ও কৃষি উদ্যোক্তা। সময় যত গড়িয়েছে, চাষ ততই বেড়েছে। বছরে বছরে তারা স্বপ্ন বুনেছেন। তবে,কৃষকদের সেই স্বপ্ন কাঙ্খিত সুফল পায়নি আজো।

জেলাতে এখন পর্যন্ত ভুট্টা কেন্দ্রিক কোনো কারখানা বা বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। যে শিল্পগুলোর প্রধান কাঁচামাল ভুট্টা, তারাও লালমনিরহাটে সরাসরি কোনো ক্রয় কেন্দ্র করেনি। সরকারি কোনো ক্রয় কেন্দ্রও নেই।

জেলা কৃষি দপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা হামিদুর রহমান বলেন, ২০২১ সালে লালমনিরহটে ৪০ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। এতে কৃষি বিভাগের লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়েছে। প্রতি শতাংশে ১ মণ এবং হেক্টরে ৯.৫ থেকে ১০ টন ভুট্টার উৎপাদন হয়েছে। জেলায় সব থেকে বেশি চাষ হয় হাতিবান্ধা এবং পাটগ্রাম এ দুই উপজেলায়।

কৃষি দপ্তরের এক তথ্য মতে, লালমনিরহাটে উৎপাদিত ভুট্টার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৫শ কোটি টাকা। ভুট্টার দাম মণপ্রতি ৯শ টাকা হলেও কৃষকরা পান ৭শ টাকা বা তারচেয়েও কম। দেখা যায়, কৃষকদের কাছ থেকে কেনেন ছোট ছোট ব্যবসায়িরা, আবার তাদের থেকে কেনেন বড় ট্রেডার্সরা। ফলে মাঠের কৃষক কখনোই ন্যায্যমূল্য পান না। এতে জেলা ভুট্টা কৃষকরা প্রতিবছরে সব মিলিয়ে অন্তত ২শ কোটি টাকা গচ্ছা দেন।

কৃষকরা জানান, তিস্তার চরাঞ্চলসহ কিছু উর্বর জমিতে ভুট্টার ফলন ১ শতাংশে দেড় মণ পর্যন্ত হচ্ছে। এই তথ্যে ক্ষতির পরিমাণটি আরও অনেক বেশি। আর এভাবেই বছরে বছরে অর্থমূল্যের মোটা একটি অংক কৃষকের হাত ছাড়া হচ্ছে।

জেলা মার্কেটিং কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানালেন, ভুট্টায় যে অনুপাতে লাভ হওয়ার কথা, তা হচ্ছেনা। এর বড় কারণ, ভুট্টাগুলো ঠিক মত শুকানো হচ্ছেনা। কারিগরি এবং লেবার সঙ্কটে শুকাতে পারছে না। এ কারণে ৪শ টাকা মণেও বেচতে হচ্ছে তাদের। বড় বড় কোম্পানিগুলো ক্রয় কেন্দ্র করেনি। তারা এজেন্ট নিয়োগ করে ক্রয় করছে। এজেন্টরা ৪শ টাকায় কিনে, একটু শুকিয়ে ৭শ-৮শ টাকায় বিক্রি করছেন।

এক মণ ভুট্টা শুকালে এত ঘাটতি হবেনা যে, প্রতি মণে এত টাকার ঘাটতি হতে হবে।এতেই কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়ছে।আমরা ঐ সব এজেন্টদের বিষয়ে কাজ করবো।কৃষি দপ্তর সহ অন্য দপ্তর গুলো যদি এগিয়ে আসে,তাহলে বাহিরের বড় কম্পানি গুলোকে জেলাতে প্রবেশ করানো যাবে।লাভের মূখ দেখবে কৃষক।

তবে,জেলাতে গেলো বছর থেকে একটি মাত্র কৃষিভিত্তিক বহুজাতিক কম্পানি ভুট্টা কিনছে।মাত্র দুটি কম্পানি তাদের ব্যবসায় শুরু করেছে।

নূর কুতুবুল একজন কৃষক এবং ভুট্টা ব্যবসায়ি। তিনি বলেন, ভুট্টার ময়েশ্চার (আদ্রতা) ১৪ হলে ৭৩০ টাকা মণ। ময়েশ্চারের পরিমান ১৬ হলে,মণে এক কেজি করে কেটে রাখা হয়। ডাস্ট এর জন্য কেটে রাখে। ভুট্টা বেচতে এখন অনেক বিড়ম্বনা। কাচা ভুট্টা কোম্পানি বা বড় ব্যবসায়িরা কেনেন না। তারা ভুট্টা ময়েশ্চারের ওপর নির্ভর করে কেনে। যদি সরকার নির্ধারিত দাম বা ক্রয়কেন্দ্র থাকতো, তাহলে কৃষকরা লাভবান হতো।

হাতিবান্ধার একজন বড় ট্রেডার্স আমজাত হোসেন। চুয়াডাঙ্গা থেকে এসে লালমনিরহাটে ২০ বছর থেকে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, ভুট্টা বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করি। সারা বছর শুকনা ভুট্টা ৭শ-৮শ টাকা মনে কিনি। কৃষকদের কাছ থেকে ফরিয়ারা কেনে, আমরা তাদের কাছে কিনি।

চর শৈলমারির কৃষক খোকন মিয়া বলেন, কাঁচা ভুট্টার দাম কম। তাই শুকনা ভুট্টা বিক্রি করি।৭ বিঘা জমিতে চাষ করেছি। গতবার শুকনা ভুট্টা ৯শ টাকা পর্যন্ত উঠেছিলো। তবু ৭শ টাকা মণে শুকনা ভুট্টা বিক্রি করতে হয়েছে।

জেলা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক আশরাফ আলী বলেন, আমাদের কাজ হলো কৃষকের হাতে নতুন নতুন ফসল তুলে দেয়া। মার্কেটিং এর কাজ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর করে। কৃষক এবং শিল্পের চ্যানেলটা যত ছোট হবে, ততই কৃষকের লাভ হবে। সরকার কাজ করছে। কর্ণফ্লেক্স আমরা বাজার থেকে আমদানি করে খাই। এর কারখানা করতে হবে। ভুট্টার দাম তখন আরও বাড়বে। কৃষকরা লাভবান হবে। হার্ভেস্ট করতে হবে। ফুড ভ্যালু অ্যাড করতে হবে। দায়িত্ব অন্য দপ্তরকে নিতে হবে।

জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগেই ভুট্টা ব্র্যান্ড করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় ভুট্টা ক্রয়কেন্দ্র করার কথা রয়েছে। আমরা মন্ত্রণালয়ে কয়েকবার লিখেছি। দিনাজপুরে কর্ণ অয়েল নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। টাঙ্গাইলেও শুরু হয়েছে। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসছে।