সারা বাংলা

ঈদের দিনেও ‘ঈদ’ আসে না যাদের জীবনে

এবারও ঈদ আনন্দ নেই বরগুনার নিখোঁজ ৬৬ জেলে পরিবারে।  ২০১৯ সালের ১৯  জুলাই ঘূর্ণিঝড়ে এসব জেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে প্রতিবছরই ঈদের দিন কাটে ‘ঈদবিহীন’ নিরানন্দের। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব‌্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারে শোক-দারিদ্র‌্য এখন ঝেঁকে বসেছে।  

বরগুনা সদর উপজেলার খাকবুনিয়া এলাকার অবুজ শিশু রাইসা। ৩ বছর আগে যেদিন রাইসা এসেছে পৃথিবীতে, এর দুই ঘণ্টা আগেই বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হন রাইসার বাবা সিদ্দিক মুন্সী। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা কপালে জোটেইনি, এখনসঙ্গে মায়ের কোলের আদর টুকুও নেই তার জন‌্য। কারণ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকায় বাধ্য হয়ে মা এখন বিত্তবানদের বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।  ৩ সন্তানের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দিতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। ঈদের দিনেও মা চলে গেছেন কাজে। তাই দাদার কোলেই সময় কাটলো রাইসার।

রাইসার দাদা মন্টু মিয়া (৬০) রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বুড়ো বয়সে  নির্ভরশীল   একমাত্র পুত্রবধূর ওপর। বয়সের ভারে কোনো কাজ করত পারি না। তাই রাইসাকে নিয়েই ঘরে থাকি। রাইসার মা বাড়িতে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান।  আমার নিখোঁজ হওয়ার পরে ট্রলার মালিকও কোনো খোঁজ নেননি। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কোনো সহায়তা পাইনি।’

রাইসার মা রুনা বেগম (৩৯) বলেন, ‘অভাবের তাড়নায় দিশেহারা আমি। বাচ্চাদের খাবার জোগাড় করতে বাড়ি বাড়ি কাজ করি। গ্রামের মধ্যে কাজ খুব কম পাওয়া যায়। যখন কাজ থাকে না, তখন অর্ধাহারে থাকতে হয়। আমাদের মতো গরিব-অসহায়দের কোনো ঈদ নাই।’

রাইসার বড় ভাই সাগর (১৪) বলে, ‘মায়ের রোজগারে আমাদের সংসার চলে না, তাই দিন মজুরের কাজ পেলেই আমরা তিন বেলা খেতে পারি। বাবা বেঁচে থাকতে আমাদের খাবারের অভাব হয়নি। বাবা সাগরে গিয়ে আর ফেরেননি। তিন বছর শেষ। কোনো সন্ধানও মেলেনি। সরকারের কোনো সহয়তাও পাইনি। আমার লেখা-পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ঈদে নতুন পোশাক কেনার কথা তো দূরের কথা, ঠিকমতো খাবারও পাই না। আমাদের বছরের সব দিনই সমান।’

রাইসার মতো শিশুর শেষ নেই জেলে পল্লীতে। হাবিব, মাহফুজ, সাইদুল, খাইরুলসহ একাধিক শিশুর পরিবারের একই অবস্থা। এরা কেউই বোঝে না, তারা বাবাকে হারিয়েছে। ঈদে প্রতিবেশী ও সহপাঠীরা নতুন পোশাক কিনলেও তাদের কেউ নতুন পোশাক কিনে দেয় না। তাই বছরের অন্যান্য দিনের মতোই পুরনো পোশাকেই ওদের সাজ।

নিখোঁজ জেলেদের স্বজনরা জানান, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারালেও এখন পর্যন্ত মেলেনি কোনো সহায়তা। মেলেনি এক কেজি চালও। তাই দু’বেলা খাবার সংগ্রহ করতেই কষ্ট  করতে হয়। ঈদ আনন্দ তাদের জীবনে অধরা। 

বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘জেলেরা ট্রলার মালিকদের প্রাণ। নিখোঁজ জেলেদের স্বজনদের পাশাপাশি ট্রলার মালিকরাও ঈদবঞ্চিত। তবে জেলেদের জীবন বীমা করা থাকলে এমন খারাপ পরিস্থিতিতে স্বজনদের পড়তে হতো না।’ 

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার বলেন, ‘আমি নতুন যোগ দিয়েছি।  বিষয়টি জানা ছিল না, দ্রুত  ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানাবো। নিখোঁজ জেলেদের সহায়তার পাশাপাশি অন্য জেলেদের জীবনবীমার বিষয়েও কাজ করবো।’

উল্লেখ‌্য, ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে বরগুনা সদরের খাকবুনিয়া এলাকার ইমরানের মালিকানাধীন ট্রলার এফবি মরিয়ম ডুবে যায়। এই ঘটনায় নিখোঁজ হন ১৮ জেলে। এই ঝড়ের কবলে পড়ে সবমিলিয়ে নিখোঁজ হন ৬৬ জন জেলে। এর মধ‌্যে ৪ জনের লাশ পাওয়া গেলেও বাকিদের খোঁজ মেলেনি।