উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে পানি বাড়ছে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোতে। অল্প দিনের মধ্যেই এসব নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে।
সোমবার (৫ জুলাই) বগুড়া, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম এবং সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
বগুড়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ৪০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৯০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১.২৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় নদ-নদীর পানি সামান্য বেড়েছে। চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে ১১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া, সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার এবং কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা এবং ধুনট যমুনা নদী তীরবর্তী উপজেলা। তবে গাবতলী উপজেলা সারিয়াকান্দির সঙ্গে লাগোয়া হওয়ায় এই উপজেলার বেশকিছু এলাকাও বন্যায় তলিয়ে যায়। প্রতি বছর বন্যায় বেশি আক্রান্ত হয় সারিয়কান্দি উপজেলা। এ উপজেলার কাজলা, কর্ণিবাড়ী, বোহাইল, চালুয়াবাড়ী, চন্দনবাইশা, হাটশেরপুর, কুতুবপুর, কামালপুর ইউনিয়ন বন্যাদুর্গত এলাকা। বন্যা বেশি হলে সারিয়াকান্দি সদরেও পানি প্রবেশ করে। এছাড়া, সোনাতলা উপজেলার পাকুল্যা, তেকানী চুকাইনগর, মধুপুর ইউনিয়নসহ আরও কয়েকটি এলাকায় প্রতি বছরই বন্যা হয়। ধুনট উপজেলার সহড়াবাড়ী, বৈশাখীর চর, রাধানগর, বথুয়ারভিটা, শিমুলবাড়ী, পুকুড়িয়া ইউনিয়নসহ আরও কিছু ইউনিয়নে বন্যার পানি প্রবেশ করে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান, যেভাবে পানি বাড়ছে, তাতে মাঝারি ধরনের বন্যা হতে পারে। চরাঞ্চলগুলো প্লাবিত হতে পারে।
তিনি আরও জানান, যে পানিতে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা বৃষ্টির পানি বা বাংলাদেশের পানি না। এটা ভারতের অরুণাচল, মেঘালায় এবং আসাম প্রদেশের বৃষ্টিপাতের পানি। এসব পানি যমুনা দিয়ে বয়ে যায়।
মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নদী তীরবর্তী এলাকার বাঁধগুলোর অবস্থা ভালো। পানি বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে গেলে, তখন আমরা চিন্তা করব যে, কী করতে হবে। গতবার যেরকম কয়েক দফা বন্যা হয়েছিল, সে তুলনায় এবারের অবস্থা কিছুটা ভালো থাকতে পারে।’
বগুড়ার ভারপ্রাপ্ত ত্রাণ ও পুনবার্সন কর্মকর্তা এবং এনডিসি জেএম রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমাদের প্রস্তুতি ভালো আছে। বগুড়ার তিনটি উপজেলায় বন্যা হয়। উপজেলাগুলো নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন। বিভিন্ন বরাদ্দ আসছে। আমাদের ত্রাণ স্টকে আছে। চাল আছে ২৫০ মেট্রিক টন। এছাড়া, ইউনিয়ন প্রতি এবং পৌরসভা প্রতি কিছু উপ-বরাদ্দ আজকালের মধ্যে দেওয়া হবে। এটা শুধু বন্যার্তদের জন্য না, এটা করোনা, বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার সকালের জন্য।’
লালমনিরহাটে নদীতে ভাঙন, হুমকির মুখের বসতভিটা
রাইজিংবিডির সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি অদিত্য রাসেল জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জের যমুনায় ১৫ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১.২৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিদিনই যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সদর, কাজিপুর, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার চরাঞ্চল ও নদীতীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। এদিকে, পানি বৃদ্ধির কারণে নদীতীরবর্তী এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। তলিয়ে গেছে এসব এলাকার বীজতলা এবং শাক-সবজি, পাট ও তিলের খেত।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, শনিবার (৩ জুলাই) সকাল থেকে যমুনা নদীর পানি কিছু কমলেও রোববার (৪ জুলাই) সকাল ৬টা থেকে সোমবার (৫ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ১৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১.২৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী কয়েক দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহিম জানিয়েছেন, যমুনায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলেও এখন পর্যন্ত জেলার কোথাও বন্যার পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। বন্যার জন্য আগাম প্রস্তুতি আছে। বর্তমানে ২ টন চাল ও নগদ সাড়ে ৭ লাখ টাকা মজুদ আছে।
রাইজিংবিডির কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি বাদশাহ্ সৈকত জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় এ জেলার নদ-নদীর পানি সামান্য বেড়েছে। চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে ১১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া, সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার এবং কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার সময় জেলার ৭২টি ইউনিয়নের ৫০টিরও বেশি ইউনিয়ন প্লাবিত হলেও সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে সাড়ে ৪ শতাধিক চরাঞ্চলের মানুষ।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ মুহূর্তে কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতি উজান থেকে নেমে আসা পানি ও স্থানীয় বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করছে। উজানে থেকে পানি নামতে শুরু করলে তা ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা এবং দুধকুমার নদীর মুখ দিয়ে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যদি ভারতের উজানে আর বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে বন্যার আশঙ্কা কম।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম জানিয়েছেন, যেহেতু কুড়িগ্রাম একটি বন্যাপ্রবণ জেলা, সেহেতু চরাঞ্চলের মানুষদের ত্রাণ দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। যাতে তারা খাদ্য সহায়তা পায় সে প্রস্তুতিও জেলা এবং উপজেলা প্রশাসন থেকে নেওয়া হয়েছে।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি ফারুক আলম জানিয়েছেন, নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অনেক মানুষ। ভাঙনের কারণে নদীতীরবর্তী বেশকিছু অঞ্চলে মানুষজন তাদের বসতভিটা সরিয়ে নিচ্ছেন। ভেঙেছে বেশ কিছু বসতভিটা। গরু-ছাগলসহ গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিচ্ছেন তারা।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, ‘পানি বাড়ছে আবার কমেও যাচ্ছে। বর্ষাতে কেউ জলকপাট খুলে রাখে না। আমরা যেমন তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রেখেছি, ঠিক তেমনই ভারতের গজলডোবায় জলকপাট তারা খুলে রেখেছে।’
জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেছেন, ‘প্রত্যেক উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঘর বরাদ্দ দেওয়া আছে। পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ৫৫ বান্ডিল করে ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’