সারা বাংলা

৩০ কে.জি. স্কুল বন্ধ: শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন 

করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে মৌলভীবাজার জেলার ৩০টি কিন্ডারগার্টেন (কে.জি.) স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। দেড় বছরের বন্ধে শিক্ষকরা বেতন-ভাতা না পাওয়ায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। অনেকে শিক্ষকতা ছেড়ে ঝুকেছেন বিভিন্ন কাজে। বেশিরভাগ শিক্ষক টিউশন করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবমতে, বন্ধের আগপর্যন্ত জেলায় মোট ৪১৪টি কিন্ডারগার্টেন চালু ছিলো। এই প্রতিষ্ঠানে ৪ হাজার ৬৬৫ জন শিক্ষক ও ৫২৫ জন কর্মচারী ছিলো। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০ হাজারেরও বেশি শিশু শিক্ষার্থী পাঠদানে অংশ নিতো। স্কুলগুলো করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে বন্ধ। ভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় বহু প্রতিষ্ঠানকে ভবন ছাড়তে হয়েছে।

জেলায় অন্তত ৩০টি প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি এহসান বিন মুজাহির।

শ্রীমঙ্গলের আব্দুল জব্বার আজিজুন্নেসা স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন সুকেন তাতী। স্কুলটি করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় করুণ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন তিনি। তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে জানা যায়, ২০১৮ সাল থেকে তিনি এই স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। সাত সদস্যের পরিবার তার। পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতেন তিনি। তার বাড়ি কালীঘাট চা বাগানে।

গত দেড় বছর ধরে তিনি বেকার। তার এক ছোট ভাই রয়েছেন, তিনি চা বাগানে কাজ করেন। তিনিই এখন পরিবার চালান৷ সুকেন গত কয়েকমাস থেকে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশন করাচ্ছেন। এই টিউশনির টাকায় কোনোরকমে চলছেন। তবে তিনি শিক্ষকতা পেশা ছাড়তে চাচ্ছেন না। আশায় আছেন, একদিন সুদিন আসবে। সেদিন ঠিক হয়ে যাবে।  

সুকেন তাতী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কয়েকদিন হলো স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি যে স্কুলে শিক্ষকতা করতাম, সেটি খোলেনি। উপজেলার বেশ কয়েকটি স্কুলে যোগাযোগ করেছি চাকরির জন্য। কিন্তু কেউ আশ্বাস দিতে পারেননি।’

তিনি বলেন, ‘এখন মানুষের বাসায়, বাসায় গিয়ে টিউশনি করাচ্ছি। এতদিন শিক্ষকতা করলাম, এখন অন্য পেশায় চলে যাবো, সেটাও মানতে পারছি না।’ সুকেন তাতীর মতো জেলার বেশিরভাগ শিক্ষকরা এখন বেকার হয়ে দিশেহারা। যে যা পারছেন টুকটাক করার চেষ্টা করছেন।

জুড়ী উপজেলার সমাই মডেল স্কুলও বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুলের শিক্ষক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘আমাদের স্কুলটি এলাকায় জনপ্রিয়তা পায়। শতখানেক শিক্ষার্থী ছিলো। কিন্তু করোনার কারণে যে বন্ধ হয়, এখনও খোলেনি। আর খুলবেও না।’ 

তিনি বলেন, ‘নিয়মিত স্কুলের ভাড়া দিতে না পারায় করোনা শুরুর দু’-এক মাসের মধ্যে সব কিছু ছেড়ে দিতে হয়। স্কুলের অনেক শিক্ষক এখন বেকার। শুধু চলার জন্য অনেকে টিউশনি করান। তাও স্বল্প বেতনে।’ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, ‘আমি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। করোনা শুরুর পর থেকে স্কুল বন্ধ। পরিবার চালাতে হলে কিছু একটা করতে হবে। এখন বাধ্য হয়ে মাছ শিকার করছি। মাছ বিক্রি করে যা আয় হয়, তাই দিয়ে কোনোরকমে চলছি।’ 

মৌলভীবাজার জেলা কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১৮ মাস বন্ধ থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে পড়ে। শিক্ষার্থী না আসায় বেতন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এতে গড়ে ৫০ ভাগ শিক্ষক-কর্মচারী চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন।

মনিরুল ইসলাম বলেন, কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করে মাছ শিকার, রিকশা চালানো, দোকান দেওয়ার মতো পেশা বেচে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কিছু শিক্ষক রয়েছেন, যারা বিভিন্ন এনজিওতে চাকরি করছেন। তবে বেশিরভাগই বেকার। 

অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, এ পর্যন্ত জেলার ৩০টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। আরও অনেক স্কুল অর্থাভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও শিক্ষকরা হয় চলে গেছেন, নয়তো ছাটাই করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি এহসান বিন মুজাহির বলেন, করোনার প্রভাবে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এখন নিয়মিত পড়ালেখা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। 

তিনি বলেন, বন্ধ হওয়া স্কুলগুলো চলতো ব্যক্তি মালিকানায় ভাড়া নেওয়া বাসা বা ভবনে। শিক্ষক-কর্মচারীদেন বেতন, ভবন ভাড়া দিতে না পারায় স্কুলগুলো বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।