সারা বাংলা

স্কুলের শ্রেণিকক্ষ এখন আনসারদের বাসস্থান!

হাইকোর্টের রুল জারি এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের হস্তক্ষেপে খুলে দেওয়া নারায়ণগঞ্জ শহরের কিল্লারপুলস্থ ৩৩ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ড্রেজার জুনিয়র হাইস্কুলটি আবারও বন্ধের পায়তারা চলছে। করোনার কারণে সরকার যেখানে দেড় বছর পরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, সেখানে ড্রেজার পরিদপ্তর কর্তৃপক্ষ স্কুলটির শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণার্থী আনসারদের বাসস্থানের জন্য অনুমতি দিয়েছে। যে কারণে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ৩৩ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ড্রেজার জুনিয়র হাইস্কুলটি আকস্মিক বন্ধ ঘোষণার পরে শিক্ষাজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি স্কুলটি হঠাৎ করে বন্ধের কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। দুই সপ্তাহের মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ও নারায়ণগঞ্জের ড্রেজার অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৗশলীকে এ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। এছাড়া, নারায়ণগঞ্জের স্কুলটি বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন আদালত। চার সপ্তাহের মধ্যে মামলা বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরে হাইকোর্টের রুল জারি এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের হস্তক্ষেপে ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ড্রেজার পরিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শামসুদ্দিন আহমদ স্কুলটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে তালা খুলে দেন। পরে ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি স্কুলটি পরিদর্শনে আসেন নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর ও বন্দর) আসনের সংসদ সদস্য ও বিকেএমইএ’র সভাপতি সেলিম ওসমান।

ওই সময় সেলিম ওসমান জানিয়েছিলেন, স্কুলটি আগে ড্রেজার পরিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি দেখিয়ে স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে খুললেও স্কুলটি কীভাবে চলবে, কারা পরিচালনা করবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা ছিল না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজার কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের কাছে লিখিত দায়িত্ব দেয় তাহলে আমি (সংসদ সদস্য) ও জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা মিলে যৌথভাবে সভা করে সিদ্ধান্ত নিবো। সেক্ষেত্রে স্কুল ও এর সামনের মাঠটিসহ স্কুলের জন্য লিখিতভাবে বরাদ্দ দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পারভীন আক্তার মালা বলেন, ‘ওই সময় স্কুলটি খুলে দেওয়া হলেও ড্রেজার পরিদপ্তর কর্তৃপক্ষ স্কুলটি পরিচালনার জন্য লিখিত অনুমতি না দেওয়ায় এমপি সেলিম ওসমান স্কুলটির দায়িত্ব নিতে পারেননি। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হওয়ার সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষকদের বেতনও। শিক্ষকরা মানবেতর জীবন-যাপন করেছি।’

চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজ খুলে দেয় সরকার। সে অনুযায়ী ড্রেজার জুনিয়র হাইস্কুলটিও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে পাঠদান চালু করেন শিক্ষকরা। তবে ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পরে স্কুলটির দ্বিতীয় তলার ৪টি শ্রেণিকক্ষে অবস্থান নেয় প্রশিক্ষণার্থী আনসার সদস্যরা। ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে স্কুলটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা স্কুলে এসে দেখতে পান তাদের স্কুলের সামনে প্রশিক্ষণার্থী আনসার সদস্যরা কুচকাওয়াজ করছে। দ্বিতীয় তলার ৪টি শ্রেণিকক্ষের সব বেঞ্চ টেবিল বারান্দায় রেখে প্রশিক্ষণার্থীদের বাসস্থান বানানো হয়েছে। এছাড়া, স্কুলটির বেশ কিছু টেবিলে ও বেঞ্চও অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। 

পারভীন আক্তার মালা জানান, ২০১৯ সাল থেকে স্কুলটি বন্ধের পায়তারা চলছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল চালুর পরে ২য় শ্রেণি থেকে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে এসেছে। তবে ড্রেজারের প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা আনসার সদস্যরা শিক্ষার্থীদের দেখলেই বলে ‘তোমাদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হবে অন্যত্র চলে যাও’। যে কারণে অনেক শিক্ষার্থীই এখন অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এখানে পড়াশোনায় আগ্রহ হারাচ্ছে। 

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জানান, স্কুলটিতে ৬টি শ্রেণিকক্ষের মধ্যে দ্বিতীয় তলার ৪টিতে বর্তমানে আনসার প্রশিক্ষণার্থীদের দখলে। যে কারণে ২টি শ্রেণিকক্ষে গাদাগাদি করে ক্লাস করাতে হচ্ছে। পাশাপাশি আনসার প্রশিক্ষণার্থীরাও মাস্ক ছাড়াই অবাধে ঘোরাফেরা করছেন। এতে তাদের যেমন পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে তেমনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি দ্রুত স্কুলটির স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।

প্রশিক্ষণার্থীদের দায়িত্বে থাকা আনসার কমান্ড্যান্ট সোনারগাঁ উপজেলার টিআই উত্তম কুমার দেবনাথ জানান, ড্রেজার পরিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আজিজুল হকের অনুমতি সাপেক্ষেই তারা স্কুলের শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণার্থীদের থাকতে দিয়েছেন। প্রশিক্ষণের বিষয়টি জেলা প্রশাসক অবগত আছেন। স্কুলটির দ্বিতীয় তলায় বর্তমানে ৪২ জন আনসার প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন। তবে আনসারের পক্ষ থেকে যখন অনুমতি নেওয়া হয় তখন তিনি জানতেন স্কুলটিতে তেমন  শিক্ষার্থী নেই। ক্লাসরুমগুলো অব্যবহৃত পড়ে আছে। তিনিও চান না শিক্ষার্থীদের পাঠদানে কোনো ধরনের ক্ষতি হোক।

শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষণের সময়ে মাস্ক পরে প্রশিক্ষণ করা যায় না। তবে বাকি সময় প্রশিক্ষণার্থীরা মাস্ক পরে।’

এ বিষয়ে জানতে ড্রেজার পরিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আজিজুল হকের অফিসে গেলেও তিনি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।